Beta
সোমবার, ১২ মে, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১২ মে, ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে চিন্তা করা কঠিন: অধ্যাপক ‍রুকসানা

অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া
অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া
[publishpress_authors_box]

তিন দশক আগে স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর এককেন্দ্রিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। এখন দেশটিকে শক্ত চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে চীন। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে দুই পরাশক্তির রেষারেষিতে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও পড়ে যাচ্ছে। আধিপত্যের লড়াইয়ে ওয়াশিংটন কোন পথ ধরতে পারে, তা তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফরেইন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত এক নিবন্ধে। এই লড়াইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিৎ, তা নিয়ে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া। অনুলিখনে সকাল সন্ধ্যার প্রতিবেদক জেসমিন মলি।

সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরকমই একটি নীতিগত ব্যাপার রয়েছে। কাজেই সব দেশের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে, এটাই আমাদের এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা। কোনও একটি বিশেষ দেশের প্রতি ঝুঁকে যাবে না, সব দেশকেই সমদূরত্ব রাখবে, আমাদের নীতিটি এরকম। এখন এই নীতি কীভাবে পালন করা হবে, সেটা অন্য জিনিস। 

আমার ইচ্ছা আর আমার সাফল্য, দুটি দুই রকম বিষয়। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার বিষয়টি ভালো কথা, তবে এটা খুব চ্যালেঞ্জিং। সেই চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। 

যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই চেয়েছে এশিয়ায় তাদের প্রভাব বিস্তার করতে। এটা গত ৭০-৮০ বছর ধরেই চলে আসছে। প্রভাব বিস্তারে চীনও চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে। তবে সেক্ষেত্রে তারা সফল হচ্ছে কি না, সেটি অন্য বিষয়। 

এখন যুক্তরাষ্ট্রকে যতখানি দেখানো হচ্ছে যে তাদের প্রভাব দুর্বল হয়ে গেছে বা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, এটা আসলে কতখানি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে, সেটি অন্য প্রশ্ন। আমাদের বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হয়েছে আগের থেকে। কতখানি দুর্বল হয়েছে, সেটা আমাদের পক্ষে যাচাই করা কঠিন।

আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য মূলত পোশাকখাত নির্ভর। যুক্তরাষ্ট্রেই যাচ্ছে বেশিরভাগ রপ্তানি পণ্য। এখন যদি তারা বলে আমাদের আর কোনও গার্মেন্টস অর্ডার দেবে না, তাহলে আমাদের অর্থনীতির অবস্থা কী হবে? আমাদের ৮০ ভাগের বেশি বৈদেশিক বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। সেখানে বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য দেশে থেকেও তাদের আমদানি করার সুযোগ আছে। এজন্যই বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি খুব চ্যালেঞ্জিং। 

আমাদের সব দেশকে একই লেভেলে রেখে নীতি নির্ধারণ করা বা কূটনীতি পরিচালনা করাও চ্যালেঞ্জিং হবে। আমাদের সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাস্তবতা অনেক কঠিন। ক্ষমতা যার কাছে থাকে, সেই প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগ পাবে। দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অনেক দুর্বল, সেখানে বিরাট ক্ষমতাধর দেশের সঙ্গে বৈরী সর্ম্পক স্থাপন করা হবে আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদের সেই চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে। এটি এক ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে, আমরা কীভাবে ম্যানেজ করব?

আমাদের নীতিতেই বলা আছে, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। এটি মেনে চললে কতগুলো দেশকে আমাদের মিত্রতার মধ্যে রাখতে হবে? সেটিও একটি জিজ্ঞাসা। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া এই চারটি দেশ শক্তিশীলী। এদের সবাইকে ব্যালেন্স করে রাখা আমাদের জন্য কঠিন কাজ। কিন্তু সফল হওয়ার প্রয়োজন আছে। সেটা হতে পারব কি না? সেই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করতে হবে সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। 

বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ প্রতি পদে পদে। সেটি মোকাবেলা করব কীভাবে? ট্যালেন্ট বা রিসোর্সেস, সব ক্ষেত্রেই আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে। ভৌগোলিকভাবে আয়তনও আমাদের এক ধরনের সীমাবদ্ধতা। সেখানে ভারতের অসুবিধা হবে, এমন কোনও কাজ আমাদের পক্ষে করা সম্ভব না। যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা হবে, সেটিও করতে পারব না। পৃথিবীর প্রায় সব সাগর মহাসাগরই যুক্তরাষ্ট্রেরে নিয়ন্ত্রণে। সব থেকে শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও কাজ করতে আমরা পারব তো না-ই, চিন্তা করতেও সমস্যা হবে। 

এই অঞ্চলে চীন সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি। আমাদের দেশের আমদানির একটি বড় অংশই আসে চীন থেকে। ছোটখাটো জিনিস থেকে শুরু করে প্রায় সবই চীন থেকে আসছে। চীনের স্বার্থের বিপরীতেও আমরা কিছু করতে পারব না। সেখানে একটি সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হবে।

সে কারণে আমাদের অপশনগুলো খুবই লিমিটেড। অবস্থা এমন হয়েছে গাড়ি চালাচ্ছি খুব সরু রাস্তা দিয়ে, ব্রিজে কোনও রেলিং নেই। এখন আমাদের খুব সাবধানে চলতে হবে, যাতে নিচে পড়ে না যায়। আমরা যদি ঠিকমতো আমাদের পলিসি না চালাতে পারি, তাহলে আমাদের অবস্থা এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে। দেখা যাবে, আমাদের দেশের জাতীয় স্বার্থের যে গাড়ি সেটিই পড়ে যাবে খাদের মধ্যে। আমাদের স্বার্থ হল গাড়িটি যাতে ঠিকমতো চলতে পারে সোজা। 

কিন্তু আমাদের করার সুযোগও বেশ সীমিত। ছোট শক্তির দুর্বল দেশের পক্ষে পররাষ্ট্র নীতি খুব কঠিন ব্যাপার। আমাদের ডমেস্টিক পলিসিতে আমরা অনেক কিছু করতে পারব, আমাদের সেই ক্ষমতা আছে। আপনি অন্য দেশের সঙ্গে ইন্ট্যারেক্ট বিশেষ করে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে, তখন আমরা বুঝতে পারি আমাদের ক্ষমতা সীমিত। সেজন্য আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে বিরাট বড় একটা সীমাবদ্ধতা আমাদের গতিকে কিছুটা কমিয়ে দেয়। ইচ্ছা করলেই সবকিছু করা সম্ভব না, অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। আমাদের আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করতে হয়। 

জাতিসংঘ যদি বলে ওই ধরনের পলিসি নিতে হবে আমরা যেমন তার বিরুদ্ধে যেতে পারব না। সেরকমভাবে জীবনের সবক্ষেত্রেই ক্ষমতাই প্রধান। দেশের ভেতরেও যার হাতে ক্ষমতা বেশি তারই প্রাধান্য- সেটা রাজনৈতিক ক্ষমতা হতে পারে, অর্থনৈতিক ক্ষমতাও হতে পারে। যার হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা, যার অনেক টাকা-পয়সা আছে,তার সঙ্গে একজন গরিব লোক বৈরী সম্পর্ক রাখতে পারবে না।

এখানে নীতি যাই হোক, নীতির দ্বন্দ্ব থাকলেও দুর্বল শক্তির পক্ষে বৃহৎ শক্তির সঙ্গে লড়াই করা দুরূহ।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত