ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী নিকোলাস মাদুরো নয়, বিরোধী জোটের প্রার্থীই জয়ী হয়েছেন। আর তার অসংখ্য প্রমাণও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন এক বিবৃতিতে এই মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, “উপচে পড়া প্রমাণ রয়েছে যে, ভেনেজুয়েলার সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দল জিতেছে।”
বিবৃতিতে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, “এটি স্পষ্ট যে এডমুন্ডো গঞ্জালেস সর্বাধিক ভোটে জিতেছেন। অথচ বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো নিজের বিজয় ঘোষণা করেছেন।
“যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার জনগণের কাছে পরিষ্কার যে, দেশটির ২৮ জুলাইয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এডমুন্ডো গঞ্জালেন উরুতিয়া সবচেয়ে বেশি ভোটে জিতেছেন।”
ব্রাজিল, মেক্সিকো ও কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্টরা ভেনেজুয়েলার সরকারকে নির্বাচনের সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশের আহ্বান জানানোর পর ব্লিনকেন এই বিবৃতি দেন।
ভেনেজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হয় গত রবিবার। সোমবার ফল প্রকাশের পরে দেখা যায়, ৫১ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন মাদুরো। আর বিরোধী জোটের প্রার্থী পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোট।
কিন্তু বিরোধী জোট দাবি করে, তাদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এডমুন্ডো গঞ্জালেস উরুশিয়া ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। কারচুপি করে বদলে দেওয়া হয়েছে নির্বাচনের ফল।
বিরোধীরা বলেছে, তাদের নিজস্ব ভোটের পরিসংখ্যান দেখায় যে, তারা ব্যাপক ব্যবধানে নির্বাচনে জিতেছে। নির্বাচনের আগে জনমত জরিপগুলোতেও বিরোধী জোটের প্রার্থীর স্পষ্ট জয়ের ইঙ্গিত মিলেছে।
প্রেসিডেন্ট মাদুরো এর আগে বিদেশি সরকারগুলোর বিরুদ্ধে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছেন।
মাদুরোর বিজয়ের ঘোষণায় ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসসহ দেশজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ সহ বিশ্বের অনেক সরকারও ভেনেজুয়েলা সরকারের কাছে নির্বাচনের ফলের প্রমাণ প্রকাশের দাবি জানিয়েছে। একই দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জি-সেভেন এর সদস্য দেশগুলো।
মাদুরো সরকারের ঘোষিত ফলকে শুধু স্বীকৃতি দিয়েছে ভেনেজুয়েলার মিত্র চীন, রাশিয়া ও ইরান।
সোশাল মিডিয়ায় এক পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, “ভেনেজুয়েলার জনগণ ভোট দিয়েছে। তাদের ভোট অবশ্যই গণনা করা উচিৎ।”
ব্লিনকেনের এই হস্তক্ষেপ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১৮ সালের নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে ব্যাপকভাবে অভিযোগ উঠেছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো তৎকালীন বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং ভেনেজুয়েলার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ব্লিনকেন বলেন, “ভেনেজুয়েলার দলগুলোর জন্য দেশের নির্বাচনী আইন ও জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী একটি সম্মানজনক, শান্তিপূর্ণ উত্তরণ নিয়ে আলোচনা শুরু করার সময় এসেছে।”
ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া করিনা মাচাদো জানিয়েছেন, তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন এবং শনিবার আবারও গণবিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। গত সোমবার থেকে দেশটিতে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সঙ্গে কথা বলার সময় মাচাদো বলেন, “মাদুরো নির্বাচনে জয়ী হননি।”
মাচাদোর দাবি, তার দলের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের প্রার্থী গঞ্জালেস ভূমিধস জয় পেয়েছেন। কিন্তু মাদুরো সরকার তা অস্বীকার করেছে।
মাচাদো জানান, তার কাছে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট কেন্দ্রের ভোটের রসিদ রয়েছে। তিনি সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়ে বলেন, এই অবৈধ সরকারকে সহ্য করবে কিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখন সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নিকোলাস মাদুরো ১১ বছর ও তার সমাজতান্ত্রিক দল ২৫ বছর ধরে দেশটির ক্ষমতায় আছে। এর শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের হাত ধরে। ২০১৩ সালে শ্যাভেজের মৃত্যুর পর মাদুরো দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। মাদুরো ছিলেন শ্যাভেজের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার সময়ে দেশটি ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে।
অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত ভেনেজুয়েলার বিরোধী দলগুলো এবার মাদুরো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য জোট বেধেছে।
মাদুরো তার দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী বলয় কিউবা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা গড়ে তুলেছেন।
নির্বাচনের আগে পরিচালিত জনমত জরিপগুলোতে দেখা যায়, গঞ্জালেস এবার প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে স্পষ্ট ব্যাবধানে পরাজিত করতে চলেছেন।
ফলে মাদুরো সরকারের ভোট জালিয়াতির ব্যাপক আশঙ্কা সত্ত্বেও বিরোধীদের আশা ছিল, তারা এতো বেশি ভোট পাবে যে, মাদুরো প্রশাসনের ভোট কারচুপির চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কিন্তু তাদের সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে।
ভেনেজুয়েলায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হয়। সেই মেশিন থেকে ভোটের ফল সরাসরি জাতীয় নির্বাচনী পরিষদের সদরদপ্তরে চলে যায়। তবে প্রতিটি ভোটের বিপরীতে মেশিনটি থেকে একটি কাগজের রসিদও বের হয়, যা একটি ব্যালট বাক্সে রাখা হয়।
আইন অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে এই কাগজের রসিদ গণনার জন্য তাদের সাক্ষী বা এজেন্ট রাখতে পারেন।
বিরোধীদের অভিযোগ, এবার তারা তাদের নিজস্ব ভোট গণনার জন্য দেশে হাজার হাজার এজেন্টকে ভোট কেন্দ্রে মোতায়েন করা হলেও তাদেরকে ভোট গণনা করতে দেওয়া হয়নি।
গঞ্জালেসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্র থেকেই তাদের এজেন্টদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তথসূত্র : বিবিসি