ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কার্যকারিতা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে বিশ্বের এমন সব সমস্যা নিয়ে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৈরি করা এক বার্ষিক প্রতিবেদনে নেতানিয়াহু সম্পর্কে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে উপস্থাপন করা হয় বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদ মাধ্যম সিএনএন।
ওই বার্ষিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, “নেতানিয়াহুর শাসন করার সক্ষমতার প্রতি অবিশ্বাস ইসরায়েলের জনসাধারণের মধ্যে আরও গভীর এবং বিস্তৃত হয়েছে। গাজা যুদ্ধের আগে থেকেই তার প্রতি ব্যাপক অবিশ্বাস ছিল। সেই অবিশ্বাস এবার চরমে উঠেছে। আমরা হয়তো শিগগিরই তার পদত্যাগ এবং নতুন নির্বাচনের দাবিতে দেশটিতে বড় ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখতে পাব। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলে একটি ভিন্ন এবং আরও মধ্যপন্থী একটি সরকার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাও তৈরি হবে।”
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামাসের ভয়াবহ হামলার পূর্বাভাস দিতে বা তা প্রতিরোধে তার সরকারের ব্যর্থতার জন্য নেতানিয়াহু ইসরায়েলের ভেতরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ওই হামলায় ১২০০ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছিল। এ ছাড়া আরও ২৪০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায় হামাস।
বিভিন্ন জনমত জরিপেও দেখা যাচ্ছে, হামাসের হামলার প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু গাজায় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন, সেটাই জিম্মিদের পুনরুদ্ধারের সর্বোত্তম উপায় কিনা, এমন প্রশ্নও তুলছেন ইসরায়েলি নাগরিকরা। গত সপ্তাহেই গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ পঞ্চম মাস পেরিয়ে ষষ্ঠ মাসে গড়িয়েছে। গত পাঁচ মাসে ইসরায়েলি সেনাদের নিষ্ঠুর হামলায় গাজা প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। নিহত হয়েছেন ৩১ হাজার ১৮৪ ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও ৭২ হাজার ৮৮৯ জন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলি জনগণ হামাসের ধ্বংস চায় তা সত্য। কিন্তু নেতানিয়াহুকে তারা খুব কমই বিশ্বাস করেন।
কিছুদিন আগেও খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও যাকে ভালোবাসেন বলে দাবি করেছিলেন, তেমন একজন নেতার বিষয়ে দেশটির গোয়েন্দাদের এমন কড়া মূল্যায়ন বেশ চমকে দেওয়ার মতোই ব্যাপার।
গাজায় ব্যাপক সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক হতাহতের বিষয় নিয়ে বাইডেন ও নেতানিয়াহুর মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও প্রকাশ্য বিরোধের মধ্যেই এই প্রতিবেদন এলো।
সম্প্রতি গাজায় বেসামরিক মানুষ হতাহতের ঘটনা বেড়ে চলার এবং খাদ্য সংকট ও রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ার খবর বাড়তে থাকায় বাইডেন প্রশাসন সেখানে আরও ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দিচ্ছে।
কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন হুঁশিয়ারি দেন, নেতানিয়াহু ইসরায়েলের উপকারের চেয়ে বরং ক্ষতিই বেশি করছেন।
এর জবাবে নেতানিয়াহু পাল্টা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাইডেন যদি ভেবে থাকেন যে, “আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসরায়েলিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও নীতি অনুসরণ করছি এবং তা ইসরায়েলের স্বার্থে আঘাত হানছে, তবে তিনি উভয় ক্ষেত্রেই ভুল।”
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও সতর্ক করা হয়েছে, হামাসকে সামরিকভাবে পরাজিত করা ইসরায়েলের জন্য অনেক কঠিন হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ইসরায়েল সম্ভবত আগামী কয়েক বছর ধরে হামাসের কাছ থেকে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হবে। হামাসের ভূগর্ভস্থ অবকাঠামোগুলোও ধ্বংস করা কঠিন হবে। গাজার মাটির নিচের গোপন সুড়ঙ্গগুলোতে লুকিয়ে থেকে হামাস সদস্যরা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ইসরায়েলি বাহিনীকে বারবার চমকে দেবে।”
সামরিক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরাও সতর্ক করেছেন, গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসী বোমা হামলা শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আরও বেশি হারে সন্ত্রাসবাদী হতে অনুপ্রাণিত করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) উভয়ই হামাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং তাদের সমর্থকদের ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশনা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ফের সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বাড়ছে
৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি অনেকে বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন এফবিআই পরিচালক ক্রিস রে। সোমবারের প্রতিবেদন প্রকাশকে ঘিরে শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সেনেটের গোয়েন্দা কমিটির কাছে তিনি একথা বলেন।
ক্রিস রে বলেন, “এমনকি ৭ অক্টোবরের আগে হলেও আমি এই কমিটিকে বলতাম যে, আমরা সন্ত্রাসবাদের দিক থেকে থেকে উচ্চতর হুমকির স্তরে রয়েছি। এই অর্থে যে, আমি অনেক দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এই প্রথম স্বদেশি সহিংস চরমপন্থীদের হুমকি দেখছি। সেটা হলো, জিহাদী-অনুপ্রাণিত চরমপন্থী, দেশীয় সহিংস চরমপন্থী, বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠন সবার একই সময়ে উত্থান ঘটছে।”
এই বার্ষিক হুমকি মূল্যায়ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জনসাধারণের মুখোমুখি হয়ে বার্তা দেয়। এসময় পার্লামেন্টের নেতারাও দেশের শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে প্রশ্ন করার সুযোগ পান। এই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপী দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে এমন সব সমস্যা তুলে ধরেন।
ইউক্রেন নিয়েও কড়া হুঁশিয়ারি
সেনেটের গোয়েন্দা কমিটির শুনানিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক এভ্রিল হেইনস ও সিআইএ পরিচালক বিল বার্নস উভয়ই ইউক্রেন যুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তারা বলেন, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে অগ্রগতি অর্জন করছে। কিন্তু ইউক্রেন প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ পাচ্ছে না।
বার্নস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি সহায়তা ছাড়া ইউক্রেন সম্ভবত ২০২৪ সালে আরও ভূখণ্ড হারাতে পারে। রিপাবলিকানদের বিরোধিতায় ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ৬০ বিলিয়ন ডলারের একটি সহায়তা প্যাকেজ দেশটির পার্লামেন্টে আটকে গেছে।
সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়ার একটি শহর দখলের কথা উল্লেখ করে বার্নস বলেন, “আমি মনে করি, ২০২৪ সালে ইউক্রেনকে আর কোনও সহায়তা না দিলে আমরা আভদিভকার মতো করে ইউক্রেনের আরও কিছু অঞ্চল রাশিয়ার দখলে যেতে দেখব। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিশাল এবং ঐতিহাসিক ভুল বলে মনে হচ্ছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের প্রতিবেদন অনুসারে, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সামরিক সহায়তার ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অচলাবস্থা উভয় ক্ষেত্রেই রাশিয়া উপকৃত হচ্ছে। এতে রাশিয়া সামরিক কৌশলগত সুবিধা পাচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে সার্বিক ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থান অর্জন করছে।
প্রতিবেদনটিতে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার প্রতি চীনের সহায়তার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া সম্পর্কেও একটি কৌতূহলোদ্দীপক ইঙ্গিত দেওয়া হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে চীন রাশিয়ায় সামরিক ব্যবহারযোগ্য পণ্য রপ্তানি তিনগুণেরও বেশি বাড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পকে সহায়তার মাধ্যমে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহায়তা দিচ্ছে। যার মধ্যে অস্ত্রের জন্য দুবার ব্যবহারযোগ্য সরঞ্জাম ও উপাদান সরবরাহও রয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যও অনেক বেড়েছে। ২০২৩ সালে তাদের মধ্যে ২২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্যিক লেনদেন হয়েছে, যা ২০২২ সালের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। বিনিময়ে, রাশিয়া চীনকে সস্তায় জ্বালানি তেল এবং আর্কটিক অঞ্চলে আরও বেশি প্রবেশাধিকার দিচ্ছে।
তথ্যসূত্র: সিএনএন