জর্ডানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাঘাঁটিতে ড্রোন হামলার ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থানে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। ইসলামি প্রতিরোধ নামে ইরাকের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এই হামলা চালায়। ইরান সমর্থিত ইরাকি সশস্ত্র সংগঠন কাতাইব হিজবুল্লাহ এই গোষ্ঠীর প্রধান সদস্য। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার জন্য ইরানকেও দায়ী করছে। এতে দেশ দুটির মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত রবিবার জর্ডানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সেনাঘাঁটিতে ওই হামলায় ৩ মার্কিন সেনা নিহত ও ৪০ জনের বেশি আহত হয়। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন সেনাদের ওপর এটিই সবচেয়ে বড় হামলা।
এই হামলার পরপরই এর জন্য ইরান সমর্থিত ইরাক ও সিরিয়ার সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে দায়ী করে বিবৃতি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। হামলার কড়া জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেন তিনি।
এরপর মঙ্গলবার জো বাইডেন জানান, “জর্ডানে আমাদের সেনাদের ওপর ড্রোন হামলার ঘটনায় কীভাবে জবাব দেওয়া হবে সে ব্যাপারে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।”
প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনসহ যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর মঙ্গলবার সাংবাদিকদের একথা বলেন বাইডেন।
বাইডেন সাংবাদিকদের আরও জানান, রবিবার জর্ডান-সিরীয় সীমান্তে মার্কিন ঘাঁটিতে ড্রোন হামলার জন্য তিনি ইরানকেও দায়ী করছেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ কাতাইব হিজবুল্লাহসহ ইরাকের কথিত ইসলামি প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে অস্ত্র দেয় তেহরান।
বিবিসি বলছে, ইসলামি প্রতিরোধ গোষ্ঠী মূলত ইরান সমর্থিত কয়েকটি মিলিশিয়া সংগঠনের একটি জোট। এর আগে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে লড়েছিল।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর ওপর বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি ইরানের ভেতরেও কোনও সামরিক স্থাপনায় হামলা হতে পারে।
অন্যদিকে, আক্রান্ত হলে পাল্টা হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে ইরান। মঙ্গলবার দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে, ইরানের মাটিতে আঘাত করা হলে তেহরানও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও অবস্থানগুলোর উপর আঘাত হানবে।
এরপর বুধবার ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামিও যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ধরনের হুমকির জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
আইআরজিসি প্রধান বলেন, “ইরানকে টার্গেট করার ব্যাপারে আমেরিকান কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু হুমকি শুনতে পাচ্ছি। আমরা তাদের বলছি যে, আপনারা আমাদের পরীক্ষা করেছেন এবং আমরা এখন একে অপরকে জানি। আমরা সব হুমকিরই জবাব দেই। আমরা যুদ্ধ চাই না। তবে আমরা যুদ্ধকে ভয়ও পাই না। আর এটা সবাই জানে।”
তবে, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর কোনও ইচ্ছা নেই বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি না যে, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের নতুন করে বড় কোনও যুদ্ধের প্রয়োজন আছে। আমি তেমন কিছু চাই না।”
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, ইরানের ভূখণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হামলা চালানোর সম্ভাবনা খুব কম।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত ইরানের বাইরে সক্রিয় থাকা ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) সদস্যদের ওপর হামলা চালাতে পারে। যেমন, সিরিয়ায় আইআরজিসির বেশ কয়েকটি ঘাঁটি রয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, ইরানের ভেতরে না হলেও এই ধরনের হামলায়ও উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি আছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে।
এদিকে, ইরাকের সশস্ত্র শিয়া সংগঠন কাতাইব হিজবুল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের বিরুদ্ধে তাদের সমস্ত সামরিক অভিযান স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। মঙ্গলবারই তারা এই ঘোষণা দেয়। ইরাকের সরকারকে বিব্রত না করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে সশস্ত্র সংগঠনটি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন সেনা ঘাঁটিগুলোতে ১৬০টিরও বেশি হামলা চালায় ইরান সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠনগুলো। তবে ইরান এসব হামলায় তাদের জড়িত থাকার কথা বরাবরের মতোই অস্বীকার করে আসছে।
এসব হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে জবাব দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেনের ওপর চাপ বাড়ছে। তবে দ্য গার্ডিয়ান বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে ইচ্ছুক নয় বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের ভূখণ্ডের ভেতরে হামলা চালায় তাহলে তেহরানও কড়া জবাব দেবে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইরানও প্রধানত তাদের সিরিয়ার অবস্থানগুলোর উপরই হামলার আশঙ্কা করছে। ইরানের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ মাজিদ মিরাহমাদিও মঙ্গলবার সিরিয়ার উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে তিনি কথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ বা ইরান সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা প্রতিরোধ ও বিজয়ের প্রস্তুতি নেওয়া আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ইরান পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সামরিক অশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। তবে ইরান বরাবরের মতো এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলে যে, সশস্ত্র সংগঠনগুলো স্বাধীনভাবেই কাজ করে। তাদের পেছনে ইরানের কোনও হাত নেই। তবে, ইরান এই সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে “প্রতিরোধের অক্ষ” বলে আখ্যায়িত করে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স