গাজায় সংঘাতের মধ্যে জর্ডানে ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তিন সৈন্য প্রাণ হারানোর পর এখন যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের যুদ্ধ বুঝি লেগেই যাচ্ছে। ওয়াশিংটন সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের স্বার্থের উপর হামলার ছক এঁটে ফেলেছে বলে বিবিসিতে খবর এসেছে। আর তাহলে ইরানও যে ছেড়ে কথা কইবে না, তা স্পষ্ট।
গত চার দশকের ইতিহাসে চোখ বোলালে এই দেশ দুটির বৈরী সম্পর্কই দেখা যাবে। এখন অদ্ভুত শোনালেও এককালে এই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তেহরান-ওয়াশিংটন ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। সেই সম্পর্ক চলে প্রায় দুই যুগ। এরপর ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর সম্পর্কে যে যতি পড়ে, তা আর কাটেনি, বরং দূরত্ব ক্রমেই বেড়েছে।
দুই দেশের ঘনিষ্ঠতার শুরুটা হয়েছিল যে ঘটনার মধ্য দিয়ে, তা ইরানের জনগণের জন্য প্রত্যাশিত ছিল না।
১৯৫৩ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাত করে দেশটির সেনাবাহিনী। মনে করা হয়, সেই সেনা অভ্যুত্থানে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।
মোসাদ্দেককে উৎখাত পশ্চিমাদের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, কেননা তিনি যুক্তরাজ্য মালিকানাধীন অ্যাংলো-পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তার ওই সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত হয়ে যুক্তরাজ্য ইরানের তেলের উপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছিল। শেষে মোসাদ্দেককে সরিয়ে দিয়ে স্থায়ী সমাধানের পথ বের করা হয় বলে মনে করা হয়।
মোসাদ্দেককে হটিয়ে ইরানে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়, তাতে ক্ষমতায় বসেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। তিনি দেশে জনপ্রিয় ছিলেন না, তাই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তাকে পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করে চলতে হত।
মনে করা হয়, ক্ষমতায় আনার বিনিময়ে রেজা ইরানের প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে তেলের নিয়ন্ত্রণের ভার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালে শাহ একটি চুক্তিতে সই করেন, যাতে ইরানের তেল সম্পদের ৪০ শতাংশের মালিকানা ২৫ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফরাসি কোম্পানির হাতে চলে যায়।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ভিতও গড়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য ১৯৫৭ সালে দুই দেশের এক চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইসেনহাওয়ার তখন ইরান সফর করেছিলেন।
১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইরান সফরে যান। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ইরানের ভূমিকা চেয়েছিলেন। কেননা তখন ইরাক চলে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকে। নিক্সন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ইরান যে কোনও ধরনের পরমাণু অস্ত্র তার অস্ত্র ভাণ্ডারে যোগ করতে পারবে। শাহ পাহলভি তখন বেশ কিছু আধুনিক অস্ত্রও কিনেছিলেন।
কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। শাহ পাহলভির বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে থাকে জনগণ। ১৯৭৯ সালে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফেরেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। এদিকে শাহ পাহলভি পালিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে।
এসময় ইরানের একদল তরুণ তেহরানে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে দেশটির ৫২ নাগরিককে জিম্মি করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, যুক্তরাষ্ট্রে ইরানের সম্পদও ক্রোক করে।
৪৪৪ দিন পর এক চুক্তির অধীনে জিম্মিরা মুক্তি পায়। তবে তখন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, তারা ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না।
শিয়া ধর্মীয় নেতা খোমেনি ক্ষমতা নিয়ে ইরানকে ইসলামী দেশে পরিণত করেন। শুধু তাই নয়, তিনি ইরানের বিপ্লব আশপাশের দেশেও ‘রপ্তানি’র ঘোষণা দেন। তার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে ওঠে বিভিন্ন দল, যারা ইরানের অনুগত হিসেবেই চিহ্নিত।
সেই যে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভাঙল, তা জোড়া লাগার কোনও সুযোগ আর তৈরি হয়নি। বরং দূরত্ব আরও বেড়ে তা এখন সরাসরি যুদ্ধের দিকে গড়িয়েছে।
তথ্যসূত্র : স্কাই নিউজ, ফরেইন অ্যাফেয়ার্স