আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই ঘটনায় আইসিসি ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পাশাপাশি হামাস-ইসরায়েল বিষয়টিও নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খান সম্প্রতি সংস্থাটির কাছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ও হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। মূলত এরই প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে কোনও তুলনা চলে না। তবে এই তুলনা কোন কোন ক্ষেত্রে চলে না, সেবিষয়ে দেশটির কর্মকর্তারা খোলাখুলি করে কোনও বিবৃতি বা বক্তব্য দেয়নি।
করিম খানের ওই আবেদনের পর ইসরায়েল সাফ জানিয়ে দেয়, তারা এ ব্যাপারে আইসিসিকে কোনও সহযোগিতা করবে না। বরং আইসিসির বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে। ইসরায়েলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একদিন পর যুক্তরাষ্ট্রও একই কথা বলে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন জানান, তারা আইসিসির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারিতে বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির সেনেটরদের সঙ্গেও কাজ করতে রাজি আছেন।
আইসিসির কৌঁসুলিরা হামাস ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর পরই চলতি মাসের শুরুর দিকে ১২ জন রিপাবলিকান সেনেটর একটি চিঠিতে তাদের হুমকি দেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, “আপনারা ইসরায়েলকে টার্গেট করলে আমরা আপনাদের টার্গেট করব।” চিঠিতে আইসিসির কর্মচারী ও সহযোগীদের এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেওয়া হয়।
অবশ্য আইসিসির কৌঁসুলিরা এই হুমকিতে কান দেননি। গত ২০ মে তারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে হামাসের শীর্ষ তিন নেতার পাশাপাশি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন।
ওই আবেদনের পরই যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সেনেটররা আইসিসির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা শুরু করেন। আর এতে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সায় দেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টে ভোটাভুটিও হতে পারে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলে তা দেশটির জন্য মারাত্মক ভুল হবে। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘ডোন্ট গো টু ওয়ার উইথ দ্য আইসিসি’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনেও সতর্ক করা হয়েছে।
ফরেন অ্যাফেয়ার্স বলছে, আইসিসিকে পাল্টা আক্রমণ করা হবে ভুল কাজ। কারণ বাইডেন প্রশাসনও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোকে একেবারে ভিত্তিহীন বলেনি এবং তা বলতেও পারে না। গত কয়েক মাস ধরে বাইডেন প্রশাসনও গাজায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে অনুমতি দিতে নেতানিয়াহু সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করে আসছে।
এই মাসের শুরুতে বাইডেন প্রশাসন এনিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী মানবিক ত্রাণ সহায়তা সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর কর্মীদের ও তাদের স্থাপনায় হামলা করেছে।
এছাড়া অসংখ্য প্রতিবেদনে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে।
ফরেন অ্যাফেয়ার্স সতর্ক করেছে, আইসিসি ও এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে বার্তা এমন দেওয়া হবে যে, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নীতিগত নয়, বরং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক।
আইসিসির কৌঁসুলিদের আগে জাতিসংঘও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠতে পারে বলে সতর্ক করেছিল। গত ১৯ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেছিলেন, গাজায় ত্রাণ সহায়তার প্রবাহ সীমিত করার ইসরায়েলি নীতিগুলো যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য হতে পারে।
একই মাসে বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে কাজ করা সংস্থা অক্সফাম এক বিবৃতিতে অভিযোগ করে, ইসরায়েল পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজার মানুষদের অনাহারে রাখাকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও দুই মাস আগে বলেছিলেন, “সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের ফলে গাজার ১১ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধার মুখোমুখি হচ্ছে, যা এ পর্যন্ত যে কোনও জায়গায় যে কোনও সময়ে এমন সংকটে পড়া মানুষের সর্বোচ্চ সংখ্যা।”
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইনও রিপোর্ট করেছেন, উত্তর গাজায় ‘পুরোমাত্রার দুর্ভিক্ষ’ চলছে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএস এইড) প্রশাসক সামান্থা পাওয়ারও বলেছিলেন, গাজার কিছু অংশে দুর্ভিক্ষ চলছে।
গাজায় হামলা শুরুর পর গত বছরের ৯ অক্টোবর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইউভ গ্যালান্ত একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন, যেটিকে কেউ কেউ ইসরায়েলের এই অপরাধের সুনির্দিষ্ট স্বীকারোক্তি হিসেবে দেখছেন।
গ্যালান্ত ঘোষণা করেছিলেন, “আমি গাজার ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। বিদ্যুৎ থাকবে না, খাবার থাকবে না, জ্বালানি থাকবে না, সবকিছু বন্ধ। আমরা মানব পশুদের সঙ্গে লড়াই করছি এবং আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি।”
এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলে তা হবে চুড়ান্ত নির্লজ্জতার শামিল এবং বিশ্ব মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এর পরিণতি ভালো হবে না।
ফরেন অ্যাফেয়ার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে বাঁচাতে আইসিসির কর্মীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ইউক্রেনে অপরাধের জন্য রাশিয়াকে বিচারের আওতায় আনার ওয়াশিংটনের প্রচেষ্টাকেও দুর্বল করবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে ২০২৩ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সঙ্গে কাজ করছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে আইসিসি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জবাবে আইসিসির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিলে ভবিষ্যতে অন্য পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের পক্ষে ওকালতি করার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে যুক্তরাষ্ট্র।
আইসিসির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন ও প্রায় একঘরে হয়ে যাবে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি সমর্থনের দাবি তুলে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে, সেই নীতি যুক্তরাষ্ট্রকেও মেনে চলতে হবে।
আর এমনটা না করে গাজা প্রশ্নে আইসিসিকে পাল্টা আক্রমণ করলে ফল হবে উল্টো। এতে প্রমাণ হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র শুধু তখনই বৈশ্বিক ন্যায়বিচারকে সমর্থন করে যখন সেটা তার প্রতিপক্ষের ওপর প্রয়োগ করা হয়।
এতে আরও প্রমাণিত হবে, আইনের শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি কেবলমাত্র যতক্ষণ তার নিজের স্বার্থ ঠিক থাকে ততক্ষণই বজায় থাকে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, ফরেন অ্যাফেয়ার্স