Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪

ট্রাম্প না কমলা? ইতিহাস গড়ার ভোটে যুক্তরাষ্ট্র

trump-kamala-harris-us-election-051124
[publishpress_authors_box]

যদি কমলা হ্যারিস জেতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র আড়াইশ বছরের ইতিহাসে পাবে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প জেতেন, তাহলে দুই বার অভিশংসনের ধাক্কা পেরিয়ে প্রথম পুনর্নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হবেন তিনি। অর্থাৎ যেই জিতুক, তা হবে নতুন ইতিহাস।

সেই ইতিহাস গড়ার নির্বাচনে ভোট দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রবাসী। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র সময় ভোরে (বাংলাদেশ সময় বিকালে) ভোট শুরু হয়েছে। বিশাল এই দেশে নানা সময় অঞ্চলে থাকা একের পর এক রাজ্যে ভোট শুরু হবে এরপর। সর্ব পশ্চিমের রাজ্য আলাস্কায় ভোট শেষ হতে হতে বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল হয়ে যাবে।

তারপর গণনা শেষে ফল ঘোষণা হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য ইলেকটোরাল কলেজের ২৭০টি ভোট নিশ্চিত করতে হবে কোনও প্রার্থীকে। যিনি তা পাবেন, তিনিই হবেন দেশটির ৪৬তম প্রেসিডেন্ট।

বরাবরের মতো এবারও মঙ্গলবার ভোর ৫টায় ভোটকেন্দ্র খোলে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের শহরগুলোতে। কানাডা সীমান্তের নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যের ছোট্ট শহর ডিক্সভিল নচে প্রথম ভোট নেওয়া হয়। সেই কেন্দ্রে মোট ছয়টি ভোট তিনটি-তিনটি করে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন ট্রাম্প ও কমলা।

উপকূল দিয়ে শুরু হয়ে একে একে পশ্চিম দিকের রাজ্যগুলোতে ভোটকেন্দ্র খুলতে থাকবে। মোটামুটি ভোর ৫টা থেকে ১০টার মধ্যে সবখানে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে যাবে। ব্যতিক্রম শুধু ওরেগন রাজ্য। সেখানের বাসিন্দারা সবাই ডাকযোগে ভোট দেন। ফলে সেখানে নেই কোনও ভোটকেন্দ্র।

পূর্বাঞ্চলীয় ইন্ডিয়ানা এবং কেন্টাকির কাউন্টিগুলোতে ভোটগ্রহণ শেষ হবে সন্ধ্যা ৬টায়। এরপর রাত ৭ টায় জর্জিয়া, ভারমন্ট এবং ভার্জিনিয়াসহ বাকি রাজ্যগুলোর ভোট শেষ হবে। তবে রাজ্যভেদে কোথাও কোথাও ভোটকেন্দ্র বন্ধ হবে মাঝরাতে। আলাস্কাতেই ভোট দেওয়া শেষ হবে রাত ১টায়, মানে বাংলাদেশ সময় দুপুর হয়ে যাবে তখন।

যুক্তরাষ্ট্রে আগাম ভোট দেওয়ার রীতি থাকায় এরই মধ্যে প্রায় ৮ কোটি ভোটার তাদের ভোট দিয়েছেন। বুথফেরত জরিপগুলো বলছে, অর্ধেক ভোটারের আগাম ভোটে এগিয়ে আছেন কমলা হ্যারিস। এখন দেখার বিষয় ভোটের দিন বাকি ভোটারদের ভোটে কে নির্বাচিত হন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস।

প্রার্থী কারা

এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হলেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।

কথা ছিল দলের হয়ে ভোট করবেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি প্রচারও শুরু করেছিলেন। কিন্তু শারীরিক সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর তিনি ক্ষ্যান্ত দেন। এরপর ৬০ বছর বয়সী কমলা হ্যারিস চলে আসেন ভোটের মঞ্চে।

ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে কমলা বেছে নিয়েছেন মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজকে।

১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম প্রেসিডেন্ট পাওয়ার পর এই পর্যন্ত কোনও নারী এই পদে বসতে পারেনি। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন কাছাকাছি গিয়েও রেকর্ডটি গড়তে পারেননি।

দেশটির ১৭টি রাজ্যে কোনও নারী এখনও সেনেটর হতে পারেনি, ১৮টি রাজ্য এখনও পায়নি কোনও নারী গভর্নর।

নারীদের জন্য সেই বেড়াজাল ভেঙে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন আইনজীবী কমলা হ্যারিস। সেই ইতিহাস গড়ার পর এখন নতুন ইতিহাস গড়ার পথে তিনি।

রিপাবলিকান পার্টি থেকে তৃতীয়বারের মতো প্রার্থী হয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৬ সালে নিজের প্রথম নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে বসেন বাইডেনের কাছে।

প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় দুই বার অভিসংশিত হন ট্রাম্প। ফৌজদারি মামলায় দোষি সাব্যস্তও হয়েছেন তিনি। এত কিছুর পরও ব্যবসায়ী ট্রাম্পের ওপর আবার বাজি ধরেছে রিপাবলিকানরা।

ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাইকেল পেন্স। এবার তিনি রানিংমেট হিসাবে বেছে নিয়েছেন ওহাইওর সেনেটর জেডি ভান্সকে।

এর বাইরে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একজন। তবে গত আগস্টে তিনি প্রচার অভিযান স্থগিত করে ট্রাম্পকে সমর্থন দেন।

ভোটার কারা

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৩ কোটি ৩০ লাখের বেশি নাগরিক ভোট দেওয়ার যোগ্য। তবে এর মধ্যে প্রায় ১৬ কোটি নাগরিক হলেন নিবন্ধিত ভোটার। তবে তারা সবাই যে ভোট দেন বা দেবেন, তা নয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল প্রায় ৬৬ শতাংশ।

দেশটিতে ১৮ বছর বয়স হলেই সেই নাগরিককে ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। প্রত্যেক রাজ্যের নিজস্ব ভোটার নিবন্ধন প্রক্রিয়া ও নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে।

বিদেশে বসবাসরত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা নিবন্ধন করে ডাকযোগে অনুপস্থিতি ব্যালটের জন্য আবেদন করতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে মঙ্গলবার।

কার কী প্রতিশ্রুতি

ঐতিহ্যগতভাবেই ডেমোক্রেটিক পার্টি একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল। এটি নাগরিক অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার পক্ষে অবস্থান নেয়।

এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের প্রতিশ্রুত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে জীবনযাত্রার ব্যয় সংকট মোকাবেলা ও গর্ভপাতের অধিকার সমর্থন।

ডেমোক্রেট কমলা হ্যারিস প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, প্রথম নারী এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব, যিনি ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

যুক্তরাষ্ট্রে এশীয়-আমেকিরান ভোটারদের মধ্যে বৃহত্তম এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় গোষ্ঠী হলো ভারতীয় আমেরিকানরা। এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে যে কোনও এক পক্ষের দিকে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

এশিয়ান-আমেরিকান সম্প্রদায় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহকারী সংস্থা ‘এএপিআই ডাটা’-র তথ্য অনুযায়ী, গত দুই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এশিয়ান-আমেরিকানদের মধ্যে ভারতীয় আমেরিকান ভোটারের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি এবং এই সংখ্যা শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের তুলনায়ও বেশি।

এই এশিয়ান-আমেরিকান ভোটারদের সমর্থন এবার কমলার দিকে।

অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টি একটি রক্ষণশীল দল। তারা কম কর, ছোট সরকার ও বন্দুক রাখার অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

ট্রাম্পের প্রচারে গুরুত্ব পেয়েছে অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রন ও মুদ্রাস্ফীতি বন্ধ করা। এক্ষেত্রে দলটি এবার ‘মেইক আমেরিকা অ্যাফোর্ডেবল এগেইন’ স্লোগান নিয়ে প্রচার চালিয়েছে।

অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যের জেরে ট্রাম্প অভিবাসীদের ভোট এবার কম পেতে পারেন। তবে গাজা ইস্যুতে আরব-আমেরিকানদের ভোট এবার তার থলেতেই যাবে, এমনটাই ধারণা অনেকের।

৬ বিষয়ে কমলা ও ট্রাম্পের অবস্থান

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য এখন প্রধান সমস্যা হলো জীবনযাত্রার ব্যয়। করোনাভাইরাস মহামারীর পর জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। এই বিষয়টিকে আমলে নিয়ে ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্কারোপের কথা বলেছেন। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এতে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়তে পারে। অবশ্য জরিপ অনুসারে, অর্থনৈতিক বিষয়ে কমলার তুলনায় ট্রাম্পের বাড়তি সুবিধা রয়েছে।

কমলা হ্যারিস বলেছেন, তিনি ‘সুযোগের অর্থনীতি’ গড়ে তুলতে চান, যেখানে মধ্যবিত্তের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা, মূল্যস্ফীতি কমানো, আবাসন উন্নয়নকে উৎসাহিত করা, প্রথমবারের মতো বাড়ির ক্রেতাদের অর্থ সহায়তা এবং নতুন বাবা-মার জন্য ট্যাক্স ক্রেডিট প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

হ্যারিস লাখ লাখ মধ্য ও নিম্ন-আয়ের পরিবারের জন্য কর কমানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি উদ্যোক্তা এবং ছোট ব্যবসার মালিকদের জন্য ট্যাক্স বিরতি সমর্থন করেন।

বিপরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য তেল ও গ্যাস উত্তোলন বাড়িয়ে জ্বালানি খরচ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, শুল্ক বৃদ্ধি এবং গণ নির্বাসনের জন্য তার পরিকল্পনা আসলে খরচ বাড়াতে পারে।

মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান হাতিয়ার উচ্চ সুদের হারের বিরুদ্ধেও ট্রাম্প সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টেরও একটি বক্তব্য থাকা উচিত, যা ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতি থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে।

কমলার সমর্থকদের জন্য গর্ভপাত বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের আমলে নিয়োগ পাওয়া এক তৃতীয়াংশ বিচারক নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট যখন ‘রো ভার্সেস ওয়েড’ রদ করে, তখন কমলা গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়টিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয় হিসেবে তুলে ধরেন। পাশাপাশি এই অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন।

অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছেন, গর্ভপাতের বিষয়টি অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। তবে তিনি জাতীয়ভাবে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করবেন না এবং আইভিএফ নারীদের জন্য ফ্রি করে দেবেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা অতীতে আইভিএফ সংক্রান্ত আইন বারবার আটকে দিয়েছে।

কমলা হ্যারিসও বাইডেনের মতোই ট্রাম্পকে গণতন্ত্রের জন্য সরাসরি হুমকি হিসাবে দেখেন। এ প্রসঙ্গে তিনি এক পর্নস্টারকে ঘুষ দেওয়া লুকাতে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক নথিতে জালিয়াতি, ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি এবং পার্লামেন্ট ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার মতো বিষয়গুলো বারবার উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে, ট্রাম্প বারবারই ফের প্রেসিডেন্ট হতে পারলে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিবেন কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলেও ট্রাম্প কোনও উত্তর দেননি, যেনবা কারচুপি ছাড়া কেউ তাকে হারাতে পারবে না। পার্লামেন্ট ভবনে হামলকারীদেরও ক্ষমা করে দেবেন বলে জানান ট্রাম্প।

কমলা হ্যারিস ব্যাপক অভিবাসন সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বাস করা মানুষদের, বিশেষ করে যাদের শিশু অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়েছে তাদের নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

অন্যদিকে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীন অবৈধ অভিবাসী নির্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। এ ছাড়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করবেন।

কমলা হ্যারিস বাইডেনের মতোই যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক মিত্রদের সঙ্গে এবং বিশেষ করে ন্যাটো জোটের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিও বাইডেন প্রশাসনের মতোই সমর্থন দিয়েছেন কমলা। যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও হ্যারিস বলেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। 

অন্যদিকে ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদী। তিনি বারবার বলেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালীন বিশ্ব আরও শান্তিপূর্ণ জায়গা ছিল, যুদ্ধ কম ছিল। তিনি দীর্ঘকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক জোট নিয়ে সংশয়বাদী। ন্যাটো তার অবজ্ঞার শীর্ষ টার্গেট হতে চলেছে।

ট্রাম্প বলেছেন, দ্বিতীয় মেয়াদে চীনের প্রতি তিনি আরও কঠোর হবেন, যদিও শি জিনপিংয়ের প্রশংসা করেছেন এবং চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করলে তিনি সেনা পাঠাবেন কিনা তা বলেননি।

কমলা হ্যারিস দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, জলবায়ু সংকট মানুষের কার্যকলাপের কারণেই সৃষ্ট এবং মানবজাতি ও পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। তার সরকারই ২০২২ সালে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এখনও পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইন পাশ করেছে।

আর ট্রাম্প প্রতিষ্ঠিত জলবায়ু বিজ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। জলবায়ু সংকটকে ভুয়া এবং ব্যয়বহুল প্রতারণা বলেও উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন যে, জলবায়ুর উষ্ণায়ন চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়িয়ে তোলার জন্য দায়ী নয়। ট্রাম্প যতবেশি সম্ভব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া

প্রতি চার বছর পরপর যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে প্রায় দুই বছর সময় লাগে। এর মধ্যে রয়েছে ককাস ও প্রাইমারি, কনভেনশন, সাধারণ নির্বাচন, ইলেক্টোরাল কলেজ এবং আরও অনেক কিছু। তবে প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া একটি সাধারণ চক্র অনুসরণ করে সম্পন্ন হয়। এই চক্র শুরু হয় নির্বাচনী বছরের আগের বছরের মার্চে, আর শেষ হয় পরের বছরের জানুয়ারিতে (মোট ২২ মাস সময়কাল)।

অন্য অনেক দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হন না। উভয় প্রার্থীকে ৫০টি রাজ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়। প্রত্যেক রাজ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকটোরাল কলেজ ভোট থাকে। মোট ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে যিনি ২৭০ তার এর অধিক ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হন।

অধিকাংশ রাজ্যে ‘জয়ী সব পাবে’ এই নীতিই চলে। অর্থাৎ যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পাবেন, তিনিই ওই রাজ্যের সব ইলেকটোরাল ভোট পাবেন। বেশিরভাগ রাজ্য একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি সমর্থন দেন। ফলে সবার মনোযোগ থাকে সাতটি অঙ্গরাজ্যে। এই রাজ্যগুলোকে ব্যাটলগ্রাউন্ড বা সুইং স্টেট বলা হয়। এগুলোতে উভয় প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা থাকে।

কেন্দ্রীয়ভাবে সর্বাধিক ভোট পেলেও একজন প্রার্থী হেরে যেতে পারেন। যেমনটা ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের ক্ষেত্রে হয়েছিল।

বিকল্প ব্যবস্থা

তবে কোনও প্রার্থী ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট না পেলে একটি বিকল্প নির্বাচন হবে। এতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব হাউসের ওপর বর্তায়। সেখানে প্রতিটি রাজ্য এক ভোট দেয়। আর ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব পড়ে সেনেটের ওপর। হাউসে প্রার্থীকে জিততে ২৬টি রাজ্যের সমর্থন প্রয়োজন।

অবশ্য ১৮২৪ সালের পর কোনো নির্বাচনে এমনটা হয়নি। সেবার জন কুইন্সি অ্যাডামস হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। যদিও অ্যান্ড্রু জ্যাকসন বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এবং ইলেকটোরাল ভোটে জয়ীও হয়েছিলেন। তবে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার ভোটার ১৮ কোটির মতো।

ইলেকটোরাল ভোট

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন এবং ভোটাররা কীভাবে তাদের নেতা নির্বাচন করেন তা বুঝতে ইলেকটোরাল কলেজ সম্পর্কে বুঝতে হয়। দেশটির কংগ্রেসের সদস্যরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।

কিন্তু প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে সরাসরি জাতীয় ভোট হয় না। দেশটির ভোটাররা যখন ভোট দেন, তারা তাদের রাজ্যের নির্দিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একদল ‘ইলেক্টর’ নির্বাচন করেন। নির্বাচনের আগেই প্রতিটি রাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলো একদল ইলেক্টর নির্বাচন করে।

রাজ্যে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে ওই ইলেক্টররা নির্দিষ্ট প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য ভোট দেন।

ভোট গণনা ও অনুমোদনের পর এই ইলেক্টররা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ভোট দেন। তবে এই ভোট তারা দেন নির্বাচনের প্রায় এক মাস পর ডিসেম্বরে দেন। এরপর জানুয়ারির শুরুতে কংগ্রেস তাদের ভোট অনুমোদন দেয়। তখনই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পদ নিশ্চিত হয় এবং তিনি দায়িত্ব নেন।

দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য

নর্থ ক্যারোলাইনা, নেভাডা, উইসকনসিন, পেনসিলভেনিয়া, অ্যারিজোনা, মিশিগান ও জর্জিয়া-মুলত এই সাত রাজ্যই নির্ধারণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মসনদের সম্রাটকে। শেষ সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিস দুজনই চষে বেড়িয়েছেন এখানে।

নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও মিশিগানে সবশেষ সমাবেশ করেছেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি বলেছেন, “আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি পড়েছি, সেগুলোর সমাধান করা সম্ভব। দেশের ভাগ্য এখন আপনাদের হাতে।”

আর মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে দেওয়া ভাষণে কমলা বলেছেন, গাজা যুদ্ধ বন্ধে নিজের ক্ষমতার আওতায় সবকিছু করবেন তিনি।

এই ৭ অঙ্গরাজ্যে মোট ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ৯৩। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট পেনসিলভেনিয়ায়। সেখানে বসবাসরত আরব মুসলিমরা এবার ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছেন গাজা যুদ্ধের জেরে। কারণ গাজা যুদ্ধ বন্ধে বর্তমান ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট ইডেন কার্যকর কোনও উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। উল্টো তিনি ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন।

শেষ মুহূর্তের জরিপে ৪টি সুইং স্টেটেই এগিয়ে ট্রাম্প, আর একটিতে দু’জন সমানে-সমান।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেষ মুহূর্তে ভোটারের মন আর ভোট দুইই পাল্টে যেতে পারে।

কী ঘটবে ৫ নভেম্বরের পর

৫ নভেম্বরের পর কী ঘটবে তা নির্ভর করে বিজয়ীর ওপর। ২০২০ সালের নির্বাচনের পর ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা নিজেদের পরাজয় চ্যালেঞ্জ করতে ৬০টির বেশি মামলা করেছিলেন। এর মধ্যে একটি বাদে সবগুলো মামলা খারিজ হয়ে যায়।

এবার ট্রাম্প পরাজিত হলে তিনি ও তার সহযোগীরা আবার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। এরই মধ্যে তারা ব্যাপক ভোট জালিয়াতির দাবি তুলে কিছু মামলা করেছেন এবং কিছু ভোটারের যোগ্যতা চ্যালেঞ্জও করেছেন।

ভোটিং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মামলা চলতে থাকবে এবং আরও নতুন মামলা করা হতে পারে।

নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মতে, তারা নির্বাচনের সপ্তাহে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কারণ রাজনৈতিক সহিংসতার কোনও ঝুঁকি তারা নিতে চান না।

৫ নভেম্বরের পরে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ রয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে রাজ্যগুলোর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির শেষ সময়সীমা ১১ ডিসেম্বর। ইলেক্টররা প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের জন্য ভোট দেবেন ১৭ ডিসেম্বর। ৬ জানুয়ারি কংগ্রেসের নতুন সদস্যরা ইলেকটোরাল কলেজ ভোট গণনা করবেন। আর নিয়ম অনুসারে ২০ জানুয়ারি নতুন প্রেসিডেন্ট শপথ নেবেন।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত