দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু।
গত ১০ জুন ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বুধবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে ভয়েস অব আমেরিকা।
ডোনাল্ড লু গত মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন। তার এই সফরের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
এ প্রসঙ্গে ডোনাল্ড লু বলেন, “আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ২০ মে, আমরা ৭০৩১ (সি) ধারার অধীনে সাবেক জেনারেল আজিজ আহমেদের উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে ‘পাবলিক ডেজিগনেশন’ (এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা) ঘোষণা করি।
“দুর্নীতির এ অভিযোগগুলোর ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হবে বলে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা বিবৃতি দিয়েছেন, আমরা এ ব্যাপারটি স্বাগত জানাই।”
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং বাহিনীর সাবেক ও কর্মরত সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ছিলেন ওই নিষেধাজ্ঞার আওতায়, যিনি ওই সময়ে র্যাবপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে বেনজীরের বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। তারপর বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানে আদালতে আবেদনও হয়। এরপর তৎপর হয় দুদকও। পরে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তালিকা জমা পড়ে আদালতে। তারপর বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকায় ফ্ল্যাট ও কোম্পানির আংশিক শেয়ার জব্দের নির্দেশ দেয় ঢাকার আদালত।
এত জমি কেনার টাকার জোগানের ব্যাখ্যা দিতে বেনজীরকে গত ৬ জুন হাজির হতে তলব করেছিল দুদক। তবে তিনি হাজির না হয়ে সময় চেয়ে আবেদন করেন। এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে তিনি বিদেশে চলে গেছেন।
বেনজীরের মতো ঘটনার নজির এর আগে আলবেনিয়াতে দেখা গেছে বলে উঠে আসে ডোনাল্ড লুর কথায়। তিনি বলেন, “আমি যখন আলবেনিয়া ও কিরগিজ প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রদূত ছিলাম, আমরা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশান) দিয়েছিলাম। এটি তখনকার (আলবেনীয়) সরকারের কাছে জনপ্রিয় ছিল না, কিন্তু এখন সেই নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত সাবেক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা সবাই কারাগারে। সারা বিশ্বের সমাজ দুর্নীতির বিচার দেখতে আগ্রহী।”
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে দেশটির শীর্ষস্থানীয় এই কূটনীতিক বলেন, “যখন আমাদের কাছে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকে, তখন আমরা সারা বিশ্বেই নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা বিধিনিষেধের আকারে প্রকাশ্যে পদক্ষেপ নিই। আমাদের আইনগুলো আমাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ বা তাদের দুর্নীতির অর্থের গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট।”
“আমি আশা করি, আমরা বাংলাদেশের জনগণের সাথে মিলে সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করে যাব,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ‘অনেক টানাপোড়েন’ তৈরি হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে ডোনাল্ড লু জানান, যুক্তরাষ্ট্র আর পেছনে নয়, সামনে তাকাতে চায়।
এ প্রসঙ্গে ভয়েস অব আমেরিকাকে তিনি বলেন, “আমরা বিস্তৃত পরিসরে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্বকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত এবং আগ্রহী। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও গভীর হবে।
“নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় আমরা আমাদের অভিন্ন স্বার্থকে এগিয়ে নিতে চাই। আমরা ইতোমধ্যে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় একসঙ্গে কাজ করছি। আমরা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দুদেশের মধ্যে নিজেদের অভিন্ন অগ্রাধিকারগুলো নিয়ে একসঙ্গে কাজ করে যাওবার ব্যাপারে আশাবাদী।”
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন যু্ক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি অগ্রাধিকার– একথা জানিয়ে লু বলেন, “আমরা সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ কাজকে সমর্থন করে যাব এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রাখব।”
ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সফর করে যাওয়ার পর গত ২৩ মে গণভবনে ১৪ দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশে একটি বিমান ঘাঁটি করতে দেওয়ার প্রস্তাব তার কাছে এসেছিল এবং বলা হয়েছিল, ঘাঁটি করতে দিলে তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা তারাই করবে।
শেখ হাসিনা কোনও দেশের নাম উল্লেখ না করলেও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে এ বক্তব্য দিয়েছিলেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডোনাল্ড লু ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, “এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। নির্বাচনের সময় আমাদের অগ্রাধিকার ছিল শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করা।”
যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে সমর্থন করে জানিয়ে তিনি মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের অন্তত ছয় মাস আগ থেকে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র, যার অংশ হিসেবে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্তকারী ব্যক্তিকে ভিসা নিষেধাজ্ঞায় আনার ঘোষণাও এসেছিল দেশটির পক্ষ থেকে। নির্বাচনের আগে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
এ প্রসঙ্গে ডোনাল্ড লু বলেন, “পুরো নির্বাচনকালীন চক্রজুড়ে আমরা নিয়মিত বাংলাদেশের সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার কাজে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে তাদেরকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি।”
তিনি বলেন, “নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্তকারী সহিংসতার নিন্দায় আমরা সোচ্চার ছিলাম এবং আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহিংসতার ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করতে এবং যারা এসবের সঙ্গে জড়িত, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্যও অনুরোধ করেছি।” এই বিষয়গুলি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে বলেও জানান ডোনাল্ড লু।