৩০ বছরের উত্তম চন্দ্র দাস শারীরিক প্রতিবন্ধী। ডান হাত দিয়ে তেমন কাজ করতে পারেন না। ডান পা দিয়েও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। সব সময় পরনে থাকে ময়লা পোশাক আর পুরনো স্যান্ডেল। এই উত্তমই ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির এক চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সকাল সন্ধ্যার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঢাকার বিমানবন্দর ও কমলাপুর রেল স্টেশন ঘিরে গড়ে উঠা উত্তম-সেলিমের ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির নানা তথ্য। উত্তম-সেলিমসহ চক্রের ১৪ জন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে বৃহস্পতিবার।
এর আগের দিন বুধবার এক যাত্রীকে নিয়ে বিমানবন্দর রেলস্টেশন গিয়ে কোনও টিকিট পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায় টিকেট কালোবাজারি চক্রের তথ্য। কালোবাজারির টিকেট কোথায় কোথায় রাখা হয়, সে তথ্যও পায় সকাল সন্ধ্যা।
যেভাবে সামনে এলেন উত্তম
বুধবার বিমানবন্দর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, অগ্রিম টিকেট কাটার কাউন্টারের প্রবেশ মুখে পাবলিক টয়লেটের চেয়ারে বসা এক যুবক। তার কাছে টিকেট পাওয়ার উপায় জানতে চাইলেই তিনি বলেন, ‘একটু বসেন’।
মিনিট পাঁচেক পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটি লাল রঙয়ের চাদর গায়ে দিয়ে সামনে এলেন উত্তম। এসেই অস্পষ্ট ভাষায় বললেন, কোন স্টেশনের টিকিট লাগবে?
জানানো হলো, সিলেটের। জবাবে উত্তম বলেন, “আগামীকাল এসে নিয়ে যাবেন।” অর্থাৎ যাত্রার দিনই হাতে পাওয়া যাবে।
উত্তমের শারীরিক অবস্থা দেখে ভরসা না পেলেও তার কথাই ঠিক ছিল। পরের দিন টিকেট পাওয়া গেল।
বিমানবন্দর স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, স্টেশনের ভেতর-বাইরে ব্যাপক পরিচিতি উত্তমের। তাকে চেনেন না স্টেশনের এমন কেউ নেই। ফুটপাত থেকে শুরু করে প্লাটফর্মের ব্যবসায়ী, স্টেশনের দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি), আনসার ও জিআরপি পুলিশ সবাই যেন তার পরিচিত।
টিকেট কালোবাজারিতে বিভিন্নজনের সহযোগিতা পাওয়ার কথা সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন উত্তম নিজেই।
উত্তমের চক্রে যারা
বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় উত্তমের সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন মো. মোর্শিদ মিয়া ওরফে জাকির (৪৫), আব্দুল আলী (২২), মো. জোবায়ের (২৫), সাগর (২০), মামুন (৩০) ও লাখপতি (২৮) নামে এক যুবক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ে স্টেশনের ফুটপাতের পান-সিগারেট ব্যবসায়ী, ঝালমুড়ি ব্যবসায়ী, মুচি দোকানদার, চা বিক্রেতা, প্লাটফর্ম ঝাড়ুদার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে টাকা তোলার লোক, প্লাটফর্মে থাকা হকার, স্টেশনের বাইরে থাকা ভাসমান অসহায় মানুষসহ আশেপাশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী উত্তমের টিকেট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত।
কে কোন দায়িত্বে
চক্রের প্রত্যেক সদস্যকে দেওয়া হয় আলাদা আলাদা ট্রেনের টিকেট। নিজ ট্রেনের বাইরে টিকেটের গ্রাহক এলে যেতে হয় চক্রের হোতা উত্তমের কাছে। চট্টগ্রাম, সিলেটের দায়িত্বে জাকির ও লাখপতি। উত্তরবঙ্গের টিকেটের দায়িত্ব আব্দুল আলী ও মো. জোবায়েরের। এভাবে চক্রের সদস্যদের ট্রেন ভাগ করে টিকিট দেওয়া হয়। উত্তম নিজে কখনও টিকেট বহন করেন না।
উত্তম চক্রকে টিকিট দেয় কারা
টিকেট কালোবাজারিতে কাউন্টারের কারা জড়িত, উত্তম গ্রেপ্তার হওয়ার আগে সকাল-সন্ধ্যাকে তাদের কারও নাম প্রকাশ করেননি।
তবে তিনি নিশ্চিত করেন, কাউন্টারের ভেতরের সবাই তাদের হাতে টিকেট দেন বিক্রির জন্য। বিনিময়ে টিকেট প্রতি ৪০-৫০ টাকা কমিশন দিতে হয়।
উত্তম সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “স্যার আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। কয়েকটা টিকেট বিক্রি করে চলি। আমার পেটে লাথি দিবেন না। আরও বড় বড়রা জড়িত আছে তাদের ধরেন স্যার।
“বিভিন্ন মানুষকে দাঁড় করিয়ে একটি এনআইডি দিয়ে চারটা করে টিকেট কেটে নিতে হয়। এজন্য তাদের টিকিট প্রতি ২০-২৫ টাকা করে কমিশন দিতে হয়।”
টিকেট রাখা হয় যেখানে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাবলিক টয়লেটের ক্যাশবাক্স, স্টেশনের আশেপাশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের দোকান, কনফেকশনারির দোকান, মুচির ক্যাশবাক্স, রেলস্টেশনের ফুটপাতে শুয়ে থাকা মানুষের মাথার নিচে থাকে এসব টিকেট। যেন এর প্রত্যেকটা স্থানই এক একটি বুথ। প্রয়োজন শুধু বাড়তি টাকা।
উত্তম-সেলিমের রাজত্বে র্যাবের থাবা
বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব-৩ এর একটি দল উত্তম ও সেলিমসহ চক্রের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। এ বিষয়ে শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, সেলিম ও উত্তমের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা প্রথমত ট্রেনের কাউন্টারে ভ্রাম্যমাণ যাত্রী, স্টেশনের কুলি, আশেপাশের পথশিশু, রিকশাওয়ালা ও দিনমজুরদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে টিকেট সংগ্রহ করে। প্রত্যেককে চারটি করে টিকেট সংগ্রহ করার বিনিময়ে ১০০ টাকা দেওয়া হতো।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এছাড়া কাউন্টারে থাকা কিছু অসাধু টিকিট বুকিং কর্মচারীদের দিয়ে বিভিন্ন সাধারণ যাত্রীর টিকিট কাটার সময় এনআইডি সংগ্রহ করে। পরে সেগুলো ব্যবহার করে প্রতিটি এনআইডির বিপরীতে চারটি করে টিকেট নেয়। এভাবে তারা দিনে পাঁচ শতাধিক টিকেট সংগ্রহ করে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে আসছে।
গ্রেপ্তারের পর র্যাবের কাছে দেওয়া তথ্য ও সকাল সন্ধ্যার অনুসন্ধান বলছে, কমলাপুর স্টেশনে সেলিম এবং বিমানবন্দর স্টেশনে উত্তমের নেতৃত্বে চক্রটি দীর্ঘদিন টিকেট কালোবাজারি করছে।
কমলাপুরে সেলিমের কারসাজি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কমলাপুর রেল স্টেশন এলাকাজুড়ে টিকেট কালোবাজারি চক্র আছে সেলিমের। সময় বুঝে সংগ্রহকৃত টিকেট নিয়ে স্টেশনের ভেতরে অবস্থান নেয় তারা। টিকেট না পাওয়া যাত্রীদের কাছে টিকেট বিক্রির জন্য ঘোরাঘুরি করে। সুযোগ বুঝে বাড়তি দামে বিক্রি করে। ট্রেন ছাড়ার সময় যত ঘনিয়ে আসে তাদের টিকেটের দাম তত বাড়তে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করে।
৫০ বছর বয়সী মো. সেলিমের চক্রে রয়েছেন আনোয়ার হোসেন ওরফে কাশেম (৬২), অবনী সরকার সুমন (৩৫), মো. হারুন মিয়া (৬০), মো. মান্নান (৫০), মো. আনোয়ার হোসেন ওরফে ডাবলু (৫০), মো. ফারুক (৬২) ও মো. শহীদুল ইসলাম বাবু (২২)।
যাত্রীদের যত অভিযোগ
সাগর নামের এক ট্রেনযাত্রী অভিযোগ করে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা ৬-৭ দিন আগেও টিকেট কাটতে কাউন্টারে গেলে তারা মনিটর দেখিয়ে বলেন সিট খালি নাই। অনলাইনে পাওয়া যায় না টিকেট।”
উত্তমের কাছ থেকে টিকেট নেওয়া মাসুম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উত্তমের কাছ থেকে ২২০ টাকার টিকেট ৩৮০ টাকায় নিয়েছি। সেটা ছিল শ্রীমঙ্গলের। কিন্তু আমার গন্তব্য ছিল সিলেট। অর্থাৎ এটা দিয়ে আমার হবে না।
“পরে লাখপতি নামে এক দালালের মাধমে সিলেটের ৩২০ টাকার একটি টিকেট সংগ্রহ করি ৪৫০ টাকায়। পরে জানতে পারি সেও উত্তম সিন্ডিকেটের সদস্য। অনলাইনে পেলে আর এত টাকা দিতে হতো না আমাকে।”
রেলওয়ের নিয়ম অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকেট কিনতে হয়। আর সেই টিকেট যেন কাউকে হস্তান্তর করা না যায়, সেজন্য ট্রেনে তা পরীক্ষা করা হবে।
ট্রেনে এনআইডি কার্ড দেখা হয় কি না- জানতে চাইলে রাকিব নামে এক নিয়মিত যাত্রী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথম দিকে একবার দেখেছি এনআইডি দেখে টিকিট চেক করতে। পরে এনআইডি চেক করা তো দূরের কথা টিকেটই চেক করে না ঠিকমতো।”
যুথি আক্তার নামের এক ট্রেনযাত্রী বলেন, “এনআইডি ছাড়া ট্রেনে ভ্রমণ করা যাবে না শুনে নিজের এনআইডি দিয়ে অনলাইন নিবন্ধন করে নিই। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দিন কেউ চেক করেনি এনআইডি।”