গত বছর ভ্যালেন্টাইন দিবসে আপনার ভ্যালেন্টাইনকে যে ইলেকট্রিক চেয়ার উপহার দিয়েছিলেন তিনি তা ব্যবহার করেননি। তারপরও আপনি তাকে বিশ্বাস করবেন?
‘বন্ধুত্ব তিন ধরনের : খাবারের মতো— যাদের ছাড়া চলে না, ওষুধের মতো— যাদের মাঝে মাঝে দরকার হয়, অসুখের মতো— আসলে যাদের কেউ চায় না।’ ভ্যালেন্টাইন দিবসে তিন ধরনের বন্ধুই আপনাকে প্রত্যাশা করে, তাদের মধ্যে দু’চারজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রয়েছেন যারা আপনি সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত পরীক্ষায় ফেল করানোর হুমকি দিয়েই যাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সদ্য ঘটে যাওয়া একটি ধর্ষণের কথা স্মরণ করুন। ‘কমন গুড’ বা সবার মঙ্গলের প্রশ্নে এ কালের বাস্তবতা হচ্ছে— একটি তরুণীকে ধর্ষণের প্রশ্নে দশজনের ঐকমত্যে পৌঁছতে তেমন সময় লাগবে না। কিন্তু ধর্ষণকারীদের হাত থেকে তরুণীটিকে রক্ষা করার জন্য দশজনকে একত্র করা যাবে না। শতধর্ষণে নাম কামানো একজনের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা নাকি বলেছিলেন, থ্রি ডিজিট হবে না, ডাঁট দেখাতে গিয়ে ও একটু বাড়িয়ে বলেছে। আসলে হবে নিরানব্বই ধর্ষণ; বাড়িয়ে বলে আমাদের ইমেজ নষ্ট করার এসব রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্ত রুখতে হবে।
ভ্যালেন্টাইন রসায়ন, বন্ধুত্বের সমাজতত্ত্ব, বন্ধুত্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি, বন্ধুত্বের প্যাথলজি, বন্ধুত্বের মনস্তত্ত্ব, বন্ধুত্বের দর্শন— এসব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং হতেই থাকবে। বন্ধুত্বকে অনেক ধরনের তত্ত্বকথায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘সোশ্যাল এক্সচেঞ্জ থিওরি’, ‘রিলেশনাল ডায়ালেকটিক্স’, ‘সোশ্যাল সাইকোলজি’, ‘ইউটিলিটি থিওরি’ ইত্যাদি।
‘শরীফ-শরীফা’ থেকে শুরু করে ভ্যালেন্টাইন সম্পর্কে নিত্যই নতুন নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। ভারতে সদ্য স্বীকৃত ‘গে ম্যারেজ’ নিয়ে একটি ‘দর্জি কৌতুক’ প্রি-ভ্যালেন্টাইন ডে-তে সবার মুখে মুখে। দুজন যুবক খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিল। আইন পাস হয়ে যাওয়ার পর হয়ে গেল স্বামী ও স্ত্রী। একজন কাপড় নিয়ে এল দর্জির দোকানে ট্রাউজার বানাবে। মাপ নেওয়া শেষ হলে দর্জি জিজ্ঞেস করল— ‘জিপার সামনে থাকবে না পেছনে?’
সত্যিকারের বন্ধু কে? অস্কার ওয়াইল্ড লিখেছেন, ‘যে তোমাকে পেছন থেকে নয়, সামনে থেকে ছুরি মারতে পারে—সেই।’
‘সত্যিকারের বন্ধু পাওয়া কষ্টকর, ছেড়ে আসা কঠিন আর ভুলে যাওয়া একেবারে অসম্ভব।’
‘বন্ধু সে-ই যে তোমার অতীত বোঝে, তোমার ভবিষ্যতে বিশ্বাস করে এবং তুমি এখন যেমন আছ তেমনটাই মেনে নেয়।’
বন্ধু কে? কাঁচা হাতের একটি প্রেমপত্র লিখে যেদিন প্রত্যাখ্যাত হলে, সবাই তোমাকে নিয়ে কী সব বলাবলি করছিল— আর তুমি যখন ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললে, যে এসে তোমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়েছিল— প্রবোধ দিয়ে বলেছিল—এর চেয়ে অনেক যোগ্য প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা তোমার জীবনে আসবে— সে-ই ভালো বন্ধু!
বন্ধুত্বের অভিধানে ঢুকে পড়েছে ‘টক্সিক ফ্রেন্ডস’। বন্ধু সন্দেহ নেই, কিন্তু হজম করা কষ্টকর। একটু বিষাক্তও।
বন্ধুত্বের অভিধানে সংযোজন ঘটেছে ‘ফ্রেন্ডেনেমি’, ‘ফ্রেনেমি’ জাতীয় শব্দের। friendenemy, frenemy শব্দের ভেতর লুকিয়ে আছে বন্ধু ও শক্র উভয়ই।
নাগরিক অভিধানে আর একটি শব্দ এসেছে Frienvy ‘ফ্রেনভি’। এটি হচ্ছে এক ধরনের ঈর্ষাপরায়ণ অনুভূতি, যা বন্ধুদের কেউ কেউ লালন করে।
বন্ধুত্বের যতো তত্ত্বই থাকুক সাধু ভ্যালেন্টাইন দিবসে টক্সিক ভ্যালেন্টাইনকে এড়িয়ে চলার কিছু দোহাই মিলেছে, অন্তত একটি বেছে নিন সম্ভাব্য ভ্যালেন্টাইন লাঞ্ছনা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন।
তাকে বলুন:
১. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার হুজুরের নিষেধ আছে, যে সব দিনের ইংরেজি নামের শেষ অক্ষরটা ওয়াই (Y), সেসব দিন ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে বের হওয়া যাবে না।
২. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু কী যে সমস্যা! আমাদের বুয়ার বাথরুমে ইংলিশ কমোড ফিট করা হয়েছে। এটার একটা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমাকে আবার সে অনুষ্ঠানের স্পেশাল গেস্ট করা হয়েছে।
৩. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু একটা থ্রিলিং কাজ শেষ করতে হবে বলে যেতে পারছি না। আমার রুমে একটা তেলাপোকা ঢুকে পড়েছে। এটাকে জীবিত কিংবা মৃত ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছি। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে কিনা?
৪. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজ আমাকে বাসায় থাকতেই হচ্ছে। আমার বিড়ালটার দাঁত খিলাল করতে হবে। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ কি অন্য কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়।
৫. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু বিটিভির দুপুরের খবরটা কীভাবে মিস করি, তুমিই বলো। বিটিভির খবর আমার সবচেয়ে প্রিয়, স্ট্যান্ড আপ কমেডির মতো।
৬. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজকে আমার শরীরটা এত খারাপ যে কী বলব। আমার বাম পায়ের বুড়ো আঙুলটা ছ’ঘণ্টা পরপর কেমন যেন চিনচিন করে উঠছে।
৭. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু আজই যে আমাকে ‘বাকবাকুম পায়রা মাথায় দিয়ে টায়রা’ ছড়াটা যে করেই হোক মুখস্থ করতে হবে। আগামী পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় এটা আমার আবৃত্তি করার কথা।
৮. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজ কুকটিভিতে রান্নাবান্নার অনুষ্ঠানে পরাবাস্তববাদী ঘটিগরম চানাচুর বানানোর একটা রেসিপি দেবে। তাই আজ না হয় থাক।
৯. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে ঢাকা মহানগরীর ভিখিরিরা কী ভাবছে তা বোঝার জন্য একটা খসড়া কোশ্চেনিয়ার তৈরির কাজে আমার বাসায় থাকা প্রয়োজন।
১০. তোমার সঙ্গে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজ আমার বিশেষ একটা এসাইনমেন্ট রয়েছে। এবার ভ্যালেন্টাইস ডে-তে যে কার্ডগুলো পেয়েছি তার একটা প্রদর্শনী করতে হবে। শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি পাওয়া যাবে কিনা সেই খোঁজ আজকের মধ্যেই নিতে হচ্ছে।
তারপরও যদি যেতেই হয় কোথায় যাবেন?
নতুন কোথাও। আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা হাতে নিন। আপনার হাতিয়ার গুগল আর্থ। ক্রোয়েশিয়ার কাছে আড্রিয়াটিক সাগরের অনেক দ্বীপের একটির নাম ‘লাভার্স আইল্যান্ড’। ১ লাখ ১০ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে এ দ্বীপ। চারদিকে অথৈ সাগর। দ্বীপের মালিক ভ্লাদো জুরেস্কো। তিনি যখন দ্বীপটি ক্রয় করেন কেবল কত বড় তাই জেনে সন্তষ্ট ছিলেন। দ্বীপে নেমে হাঁটাহাঁটি করে বুঝতে পারেননি। এটি দেখতে কেমন। উপায় দুটো—আকাশে উঠে দেখা অথবা গুগল আর্থ চালিয়ে দেখা। ভ্লাদো জুরেস্কো নিশ্চিত হলেন দ্বীপটা দেখতে একেবারে হৃৎপিণ্ডের মতো। তাহলে আর অপেক্ষা কেন? নাম দিয়ে দিলেন, লাভার্স আইল্যান্ড— গন্তব্য হবে এই প্রেম-দ্বীপ।
কোথাও যান বা না-ই যান ভালবাসতে হলে হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখুন।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন পৃথিবীসুদ্ধ সব প্রেমিক-প্রেমিকাকে ভ্যালেনটাইনস ডে’র শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছে, ভালবাসতে হলে হৃৎপিণ্ড সুস্থ ও সবল থাকতে হবে। নতুবা মানসিক-শারীরিক কোনও ধরনের অনুভূতিই জাগ্রত হবে না। হলেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী। হৃৎপিণ্ড ঠিক রাখার জন্য এই অ্যাসোসিয়েশন সাতটি সহজ, কিন্তু খানিকটা কষ্টসাধ্য প্রেসক্রিপশন পাঠিয়েছে। এমনকি আপনি যদি প্রেমে নাও পড়তে চান সুস্থ থাকার জন্য প্রেসক্রিপশন মেনে চলুন :
১. সচল থাকুন, কাজ করুন: শুয়ে শুয়ে কুড়ের বাদশাহ খেতাব পেতে পারেন। কিন্তু ভালোবাসা পাবেন না। কাজেই কাজ করুন। সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করুন। দিনে মাত্র ৩০ মিনিট।
২. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করুন: সাবধান! যা খাচ্ছেন তাতে আপনার রক্তনালী চর্বিতে ভরাট হয়ে আসছে। যেকোনও সময় হৃৎপিণ্ড কিংবা মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পরের পর্বটা ভয়াবহ। কাজেই এই ভ্যালেন্টাইনস দিবসেই কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের শপথ নিন।
৩. ভালো খাবার খান: শাকসবজি, ফলফুল, শস্যদানা, আঁশযুক্ত খাবার খাবেন। যে খাবারটি আপনার খুব খেতে ইচ্ছা করছে, সেটিই আপনার ঘাতক।
৪. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: প্রতি তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের একজন উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন এবং যারা ভুগছেন তাদের অনেকে জানেনও না যে তাদের এই সমস্যাটি রয়েছে। যখন ধরা পড়ছে তখন শরীরের আরও বড় কোনও ক্ষতিসাধিত হয়েছে। কাজেই নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করুন এবং তা ১২০/৮০-ও মধ্যেই রাখতে উদ্যোগ নিন।
৫. ওজন কমান: আপনি পুরুষ হোন কী নারী হোন যদি স্থূলকায় হোন এমনিতে আপনার ভ্যালেন্টাইনস জুটবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা আপনিও অসুস্থ হয়ে পড়বেন, উঁচু রক্তচাপ, উঁচু কোলেস্টেরল এবং হৃদরোগ আপনাকে ছাড়বে না। কাজেই ওজন কমান।
৬. রক্তের চিনি কমান: একবার মধুমেহ রোগগ্রস্ত হয়ে পড়লে মুক্তির সহজ পথ নেই। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে দুই থেকে চারগুণ।
৭. সিগারেট ছাড়ুন: অকালমৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ ধূমপান। প্রেমিক বা প্রেমিকা সিগারেট যে-ই খান না কেন ধূমপান নিয়ে ঝগড়া এড়াতে পারবেন না। তার চেয়ে ঘন কালো চকোলেট খান। সিগারেট বছরে কমপক্ষে ৪০ লাখ লোককে হত্যা করে। তবে এই হত্যাকাণ্ডটি খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটানো হয় না। ব্যাপারটা ঘটে নীরবে-নিভৃতে। তাই অবিশ্বাস্য ঠেকে। যেখানে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও সিগারেটের প্রাণহরা বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে, সেখানে সিগারেটকে ঘাতক মনে না করারই কথা। উল্টো এই ধূম্রদণ্ডটিকে মনে হবে অফুরন্ত শক্তিদাতা প্রাণ সঞ্জীবনী।
অভিধানের আর একটি সংযোজন ‘ফ্রেন্ডশিপ সাবাটিক্যাল’ বন্ধুত্ব থেকে কিছু সময়ের জন্য ছুটি। এবারের ভ্যালেন্টাইন ডে-তে সাবাটিক্যাল নিয়ে আপনার হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে আগামীবারের প্রস্তুতি নিন। তারপরও টক্সিক ভ্যালেন্টাইনকে এড়াতে না পারলে এবার আর একটি ইলেকট্রিক চেয়ার কিনুন এবং তাকে তাতে বসিয়ে সুইচ অন করে দিন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: momen98765@gmail.com