Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

‘নিরেট ঐক্যে’ বিজয় দিবস উদযাপন

বিজয় দিবসে সোমবার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন সংগঠন। ছবি : হারুন অর রশীদ
বিজয় দিবসে সোমবার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন সংগঠন। ছবি : হারুন অর রশীদ
[publishpress_authors_box]

গণঅভ্যুত্থানের পর ভিন্ন আবহে বিজয় দিবস উদযাপন হলো বাংলাদেশে, যা জাতির ‘নিরেট ঐক্যে’ স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।  

সোমবার বিজয় দিবসে সরকারি কোনও আয়োজনে স্মরিত হননি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগকেও জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে ছন্নছাড়া অবস্থায় কোনও কর্মসূচি পালনে দেখা যায়নি।

বরাবরের মতো সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। অগুনতি মানুষের শ্রদ্ধার ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতিসৗধ।

বিজয় দিবসে রাজধানী ঢাকায় শোভাযাত্রা বের করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শোভাযাত্রার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পাশাপাশি ১৯৪৭ সালের কথাও ছিল, যে সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের ভাগে পড়ার পর শোষণ-বঞ্চনার শিকার বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে হারানোর মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতির মিনার। ছবি : হারুন অর রশীদ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতির মিনার। ছবি : হারুন অর রশীদ

নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ তার মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আর অনেক অভিযোগ নিয়ে টানা দেড় দশক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট উৎখাত হয়।

শেখ হাসিনা পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে; অভ্যুত্থানের নেতাদের প্রতিরোধের ঘোষণায় আওয়ামী লীগও এখনও সক্রিয় হতে পারেনি রাজনৈতিক কার্যক্রমে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরের ঘটনাপ্রবাহের মতো এবারও বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত দিকে নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করছে আওয়ামী লীগ।

বিজয় দিবসে অগুনতি মানুষে মুখর সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ছবি : হারুন অর রশীদ
বিজয় দিবসে অগুনতি মানুষে মুখর সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ছবি : হারুন অর রশীদ

তবে বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নেই আসে এবারের জুলাই অভ্যুত্থান এবং সেই কারণে এ বছরের বিজয় দিবস মহা আনন্দের।

“মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে আমাদের দোষে সম্পূর্ণতা দিতে পারিনি। সর্বশেষ এবং প্রচণ্ডতম আঘাত হানল এক স্বৈরাচারী সরকার। সে প্রতিজ্ঞা করেই বসেছিল এদেশের মঙ্গল হতে পারে, এমন কিছুই সে অবশিষ্ট থাকতে দেবে না। এ বছরের বিজয় দিবস বিশেষ কারণে মহা আনন্দের দিন।”

ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই জুলাই অভ্যুত্থানে বিজয় এনেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পৃথিবীর ঘৃণ্যতম স্বৈরাচারী শাসককে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করেছে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থান। হাজার হাজার শহীদ এবং আহতদের আত্মত্যাগ এবং ছাত্র-জনতার অটুট ঐক্যের মাধ্যমে এই গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হলো।

“জাতির এই নিরেট ঐক্য এই বছরের বিজয় দিবসকে স্মরণীয় করে রাখবে। ইতিহাসের অনন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে রাখবে।”

অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা, বর্তমানে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “১৯৭১ সালে আমাদের বিজয় এলেও সেই স্বাধীনতা অরক্ষিত ছিল। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেয়েছে।”

বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। ছবি : হারুন অর রশীদ
বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। ছবি : হারুন অর রশীদ

ভোরে সাভার স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ফুল দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিজয় দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ফুল দেওয়ার সময় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল তাকে গার্ড অব অনার দেয়। তিন বাহিনী প্রধানও এই সময় উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতির পর ফুল দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস; তার সঙ্গে ফুল দেন সফরত তিমুর লেস্তের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস-হোর্তা। তিনি ফুল দেওয়ার পর স্মৃতিসৌধে দর্শনার্থী বইয়ে সই করেন।

তিমুর-লেস্তের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ আগমনের প্রসঙ্গে ভাষণে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, “এই বিজয় মাসে আমাদের গণঅভ্যুত্থানকে অভিনন্দন জানাবার জন্য, আমাদের বিজয় দিবসে যোগ দেবার জন্য ঢাকায় এসেছেন পূর্ব তিমুরের রাষ্ট্রপতি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা।

“তিনি তার দেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ২০০২ সালে পূর্ব তিমুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের জাতীয় উৎসবে শরিক হবার জন্য জাতির পক্ষ থেকে তাকে স্বাগত জানাচ্ছি।”

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেন তিমুর-লেস্তের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস-হোর্তা।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেন তিমুর-লেস্তের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস-হোর্তা।

রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বিদেশি মিশন প্রধানদের ফুল দেওয়ার পর স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর একে একে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অগুনতি মানুষ।

অভ্যুত্থারে পর এবারের বিজয় দিবস উদযাপনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, “নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিতের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, একটি বৈষম্যহীন দেশ গড়ার তাগিদে ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রক্ত দিয়ে চার মাস আগে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, সে ঐক্য এখনও পাথরের মতো মজবুত আছে। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতি আবার গর্জে উঠে সমগ্র পৃথিবীকে সেকথা জানিয়ে দিয়েছে।

“যখন পরাজিত শক্তি নড়েচড়ে ওঠার চেষ্টা করছিল, সকল রাজনৈতিক দলের এবং সকল ধর্মের শীর্ষ ব্যক্তিদের এবং ছাত্রদের সমাবেশের মাধ্যমে এক কণ্ঠে সজোরে ঘোষণা দিয়েছিল, আমরা যে নিরেট ঐক্যের মাধ্যমে অভ্যুত্থান করেছি, সেই ঐক্য আরও জোরদার হয়েছে। চার মাসের ব্যবধানে আমাদের ঐক্য কোথাও শিথিল হয়নি। নতুন বাংলাদেশ গড়ার সংকল্পে আমরা অটুট আছি।”

তবে এই ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলছে বলে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, “পরাজিত শক্তি তাদের পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তারা প্রতিদিন দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকে জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে নানা ভঙ্গিতে তাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের আয়ত্তে রয়েছে।

“তাদের সুবিধাভোগীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের ঐক্য অটুট থাকলে তারা আমাদেরকে আমাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে ব্যর্থ করতে পারবে না। সজাগ থাকুন। নিজের লক্ষ্যকে জাতির লক্ষ্যের সঙ্গে একীভূত করুন।”

দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে সংবাদকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “বিশ্বের কাছে দেশের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরুন। অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সত্যই হোক আমাদের হাতিয়ার।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত