Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

গান গেয়ে পিটিয়ে হত্যা : ৩ জন গ্রেপ্তার হলেও কারণ অজানা

শাহদাত হত্যায় মঙ্গলবার তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছবি : সংগৃহীত
শাহদাত হত্যায় মঙ্গলবার তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছবি : সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘মধু হই হই আঁরে বিষ হাওয়াইলা’ গান গেয়ে শাহাদাত হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশ মঙ্গলবার তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে গানের তালে নেচে গেয়ে সড়কে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ভিডিও করে কেন শাহাদাতকে হত্যা করা হলো সেই রহস্যের কিনারা হয়নি।

গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে একজনকে হত্যাকাণ্ডের ‘মূল হোতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, শাহাদাতের সঙ্গে তাদের পূর্বপরিচয় ছিল না। ছিনতাইকারী সন্দেহে তাকে পেটানো হয়।

অন্যদিকে শাহাদাতের স্ত্রীর দাবি, শাহাদাতকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে চোর আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

এই অবস্থায় পুলিশ বলছে, কী কারণে হত্যা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে বাকি আসামিদের ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

শাহাদাতকে পিটিয়ে মারার ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামের দুই নম্বর গেইটের ব্যস্ততম মোড়ে, গত ১৩ আগস্ট রাতে। হত্যার পর রাতের অন্ধকারে পাঁচলাইশ থানাধীন বদনাশাহ মাজারসংলগ্ন সড়কের সামনে শাহাদাতকে মৃত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায় অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকজন।

পাঁচলাইশ থানা পুলিশ ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। ১৫ আগস্ট লাশ খুঁজে পেয়ে থানায় গিয়ে হত্যা মামলা করে শাহাদাতের পরিবার। ঘটনাটি এক মাসেরও বেশি আগে ঘটলেও শাহদাতকে পিটিয়ে মারার একটি ভিডিটি সম্প্রতি ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি আলোচনায় আসে।

গত ১৩ আগস্ট রাতে এমন এক সময়ে শাহাদাতকে পিটিয়ে মারা হয়, যখন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনী মাঠপর্যায়ে সক্রিয় ছিল না। রাস্তায় ছিল না ট্রাফিক পুলিশও। সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছিল শিক্ষার্থীরা। আর রাতের বেলা শাহাদাতকে যখন পিটিয়ে মারা হচ্ছিল, তখন সেই সড়কেও লোকজন খুবই কম ছিল।

শাহাদাতকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় তার চাচা বাদী হয়ে ১৪ আগস্ট অজ্ঞাত আসামিদের নামে থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে শাহাদাতের স্ত্রী শারমিন আকতার দাবি করেন, তার স্বামীকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে নিয়ে চোর আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে।

এ ঘটনায় লালখান বাজার এলাকার সাগর নামে এক যুবক জড়িত দাবি করে শারমিন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, পাওনা টাকা নিয়ে সাগরের সঙ্গে শাহাদাতের আগে থেকে বিরোধ ছিল। এর জের ধরে শাহাদাতকে ডেকে নিয়ে খুন করা হয়েছে।

এছাড়া সাগর নামের ওই যুবক গান গাইতে গাইতে শাহাদাতকে পেটানোর পর তার মোবাইল ফোনে ভিডিও পাঠিয়ে মুক্তিপণ চেয়েছিল বলেও দাবি করেন শারমিন।

তবে শাহাদাতকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় পুলিশ মঙ্গলবার রাতে যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তাদের মধ্যে সাগর নামে কেউ নেই। গ্রেপ্তার তিনজন হলেন– ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী জুয়েলকে (৪২), আনিসুর রহমান ইফাত (১৯) ও সালমান (১৬)।

পুলিশ বলছে, নিহত শাহাদাত হোসেনের নামে চট্টগ্রামের নগরীর বিভিন্ন থানায় অস্ত্র, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে নয়টি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে তাকে ডেকে নিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে যার বিরুদ্ধে, সেই সাগরও পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী।

শাহদাত হত্যার মামলায় তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী তারেক আজিজ।

তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ গত ২১ আগস্ট থেকে ফেইসবুকে প্রচারিত হলে তা ভাইরাল হয়। ওই ভিডিওর সূত্র ধরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ‘চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’ নামে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ শনাক্ত করা হয়। গ্রুপটির অ্যাডমিন এবং হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ফরহাদ আহমেদ চৌধুরী জুয়েলকে ২৪ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় ২নং গেইট সংলগ্ন বিপ্লব উদ্যান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

খুঁটির সঙ্গে দুই হাত বেঁধে পিটিয়ে মারা হয় শাহাদাতকে। ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি

পরে জুয়েলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’-এর সদস্য এবং হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী সালমান ও আনিসুর রহমান ইফাতকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

তারেক আজিজ বলেন, গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে জুয়েল ইট-বালুর ব্যবসা করেন। আনিসুর রহমান নগরীর একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়েন। গ্রেপ্তার কিশোর এসএসসি পাস করেছে কি না, নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কী কারণে হত্যাকাণ্ড তা তদন্ত করছে পুলিশ।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জুয়েল ‘চট্টগ্রাম ছাত্র জনতা ট্রাফিক গ্রুপ’ নামে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি তৈরি করেন। সেই গ্রুপের সদস্য ছিল ১৩০ জন। জুয়েল ছিলেন সেই গ্রুপের এডমিন।

শাহাদাতকে পেটানোর আগে এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঘোষণা দেওয়া হয় জানিয়ে নগর পুলিশের মুখপাত্র তারেক আজিজ বলেন, “ভিকটিমকে বেঁধে পেটানোর সময় চট্টগ্রাম ছাত্র-জনতা ট্রাফিক গ্রুপে ভিডিওটা শেয়ার করা হয়। তখন গ্রুপে বলা হয় একজনকে ধরা হয়েছে যিনি মোবাইল চোর বা ছিনতাইকারী। তাকে মারতে হবে সবাই আসেন। এরপর দলে দলে গিয়ে তাকে পেটানো হয়।”

আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “গ্রেপ্তার তিনজনসহ আনুমানিক ২০ জনের বেশি ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট আছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। পুলিশ বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। তবে গ্রেপ্তার আসামিরা দাবি করেছে, ভিকটিমের সাথে তাদের কোনও ধরনের পূর্বপরিচয় ছিল না। ভিকটিমকে ছিনতাইকারী সন্দেহে মারধর করা হয়। এক দলের পর আরেক দল এসে এসে তাকে মারধর করে।”

তবে আসলেই ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে নাকি এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে বাকি আসামিদের ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান তারেক আজিজ।

ভিডিওতে কী ছিল

ঘটনাটি ঘটে ১৩ আগস্ট রাত ১০টা থেকে দেড়টার মধ্যে। ঘটনাস্থল ছিল পাঁচলাইশ থানার ২ নম্বর গেট এলাকা। ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া ২০ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, এক যুবককে ছিনতাইকারী সন্দেহে ট্রাফিক পোস্টের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক পেটানো হচ্ছে।

এসময় কয়েকজন যুবককে গোল হয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ‘মধু হই হই আঁরে বিষ হাওয়াইলা’ গাইতে শোনা যায়। কেউ মুখ দিয়ে বাজাচ্ছিলেন বাঁশি, কেউ করছিলেন উল্লাস।

ঠিক তাদের মাঝখানেই খুঁটিতে বেঁধে পেটানো হচ্ছিল নীল রঙের গেঞ্জি ও জিন্স প্যান্ট পড়া এক যুবককে। মারার একপর্যায়ে যুবকটি ঢলে পড়।

ওই যুবককে পেটানোর সময় হামলাকারীদের একজন আশপাশের পথচারীদের ডেকে বলছিল, “ভাইয়া, সবাই একটা সেলফি তুলে চলে যান।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত