রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, তিনি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য একটি বিকল্প ‘নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা’ গড়ে তুলতে চান। আর বলপ্রয়োগ নয় বরং শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ মেটানোর নীতিই হবে সেই ব্যবস্থার ভিত্তি। এ ছাড়া কোনও আবদ্ধ সামরিক-রাজনৈতিক জোট থাকবে না।
বৃহস্পতিবার ভিয়েতনামে এক রাষ্ট্রীয় সফরের সময় একথা বলেন পুতিন।
রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একঘরে করার জন্য হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। দৃশ্যত সেই প্রচেষ্টার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনেই গত মাসে চীনের পর গত সপ্তাহের বুধবার ও বৃহস্পতিবার পুতিন উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম সফর করেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তীব্র সমালোচনার মুখেও ভিয়েতনাম পুতিনকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিয়েছে। লাল গালিচা সংবর্ধনা সহ বৃহস্পতিবার এক সামরিক অনুষ্ঠানে পুতিনকে ২১ বন্দুকের স্যালুট দেওয়া হয়। দেশটির শীর্ষ দুই কমিউনিস্ট নেতা তাকে আলিঙ্গন করেন এবং তাদের একজন তার ভূয়সী প্রশংসাও করেন।
ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বলেন, পুতিন এই অঞ্চলসহ বিশ্বে ‘শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে’ অবদান রেখেছেন।
পুতিনের এই সফরে রাশিয়া ও ভিয়েতনামের মধ্যে তেল, গ্যাস, পারমাণবিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং শিক্ষাসহ আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে ১১টি চুক্তি হয়েছে।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলে আসছিলেন। এই সফরের মধ্য দিয়ে পুতিন সেই প্রচেষ্টা আরও জোরদার করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে, পুতিন ন্যাটো সামরিক জোটকে এশিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা হুমকি তৈরির জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
ভিয়েতনামের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১১টি চুক্তিতে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সাক্ষরিত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তির মতো বড় ও যুগান্তকারী চুক্তি ছিল না।
তবে ভিয়েতনাম পুতিনকে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েছে তাও তার একটি বড় সাফল্য। ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। তার মধ্যেই তাকে ভিয়েতনামের এই সাদর সম্ভাষণ তার জন্য একটি বড় জনসংযোগ অর্জন।
অবশ্য রাশিয়া বা ভিয়েতনাম কেউই আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্য নয়।
অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্স ফোর্স একাডেমির ইমেরিটাস অধ্যাপক কার্লাইল থায়ার বলেন, সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ইউক্রেন শান্তি সম্মেলন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার জন্য দুটি বড় আঘাত ছিল। ওই বিপর্যয়ের মধ্যে হ্যানয়ে পুতিনের বিজয়ী সংবর্ধনার মাধ্যমে রাশিয়া বিশ্ব মঞ্চে অনেকটাই ঘুরে দাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাচারি আবুজা বলেন, উত্তর কোরিয়া বিশ্বমঞ্চে যতটা বিচ্ছিন্ন ভিয়েতনাম ততটা বিচ্ছিন্ন নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গেও ভিয়েতনামের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ফলে ভিয়েতনামে উষ্ণ সংবর্ধনা পুতিনের জন্য একটি বিজয় হয়ে দেখা দেবে।
আবুজা বলেন, “যদিও ভিয়েতনামে উত্তর কোরিয়ার তুলনায় ধুমধাম এবং পারফরম্যান্সের দিকগুলো অনেক কম ছিল, তথাপি এই সফর পুতিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল। কারণ ভিয়েতনাম বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, উত্তর কোরিয়ার মতো হাস্যকর ও বিচ্ছিন্ন কোনও রাষ্ট্র নয়।”
গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ভিয়েতনাম সফর করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাইডেনের সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ককে ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্কও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা করেছে, পুতিনের এই সফরের পর আগামী সপ্তাহে শীর্ষ মার্কিন কুটনীতিকরা ভিয়েতনাম সফর করবেন। ওই সফরে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে মুক্ত ও উন্মুক্ত রাখতে দেশটির সঙ্গে কাজ করার ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুতির ওপর জোর দেওয়া হবে।
পৃথকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বের জন্য ভিয়েতনামের রাশিয়া বা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রয়োজন নেই।
ভিয়েতনামে ইইউ প্রতিনিধি দলের মুখপাত্র বলেছেন, হ্যানয়ের নিজস্ব বৈদেশিক নীতি বিকাশের অধিকার রয়েছে। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে, মস্কো আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান করে না।
ওয়াশিংটনের স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ সেন্টারের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র সহযোগী মারে হাইবার্ট বলেছেন, পুতিনের সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও, হ্যানয় সঠিকভাবে হিসাব-নিকাশ করেছে যে, এ কারণে তাদের কোনও বস্তুগত পরিণতি ভোগ করতে হবে না।
হাইবার্ট বলেন, “আমি মনে করি না এটা দীর্ঘমেয়াদী কোনও প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায়শই তাদের কিছুটা ছাড় দেয়। কারণ এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রেরও ভিয়েতনামকে প্রয়োজন।”
বর্তমানে ভিয়েতনামের অর্থনীতি বিশ্ব বাজারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের উন্নতি করছে। দেশটির বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে চীন, এশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে রাশিয়া। তথাপি ভিয়েতনাম এখনও প্রধানত রাশিয়ার তৈরি সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে তেল অনুসন্ধানের জন্য রাশিয়ান তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বের উপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে, এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রেরও ভিয়েতনামকে প্রয়োজন এবং দেশটি ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভিয়েতনামও বাণিজ্যিকভাবে চীনের উপর তার অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমাতে চায়। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ থেকেও উপকৃত হতে আগ্রহী দেশটি।
ভিয়েতনামের ভূকৌশলগত গুরুত্ব দেশটিকে তিনটি পরাশক্তির কাছেই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আর ভিয়েতনামও সেই সুযোগে সবার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের উন্নতির কৌশল গ্রহণ করেছে।
বিকল্প বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পুতিনের জোর প্রচেষ্টা
গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডে ইউক্রেন নিয়ে বৈশ্বিক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত থাকা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের একটি ভিয়েতনাম।
পুতিন বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার এবং পশ্চিমাদের বিপরীতে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বাড়িয়ে তুলেছেন। ফলে রাশিয়াকে একঘরে করার পশ্চিমা আশাও পূরণ হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই মে মাসে পুতিন চীন সফর করেন। ওই সফরে দুই দেশের নেতা যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতায় তাদের কৌশলগত অংশীদারত্বকে আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর পুতিন চীনের দুই প্রতিবেশী দেশে সফর করলেন। এ ছাড়া এই বছর রাশিয়া ব্রিকস অর্থনৈতিক জোটেরও সভাপতিত্ব পেয়েছে। অক্টোবরে রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাজানে ব্রিকস সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে।
তিন ডজনেরও বেশি দেশ এই ব্লকে প্রবেশের চেষ্টা করছে। এ বছরের শুরুতে ব্রিকস জোট বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বলয় আরও সম্প্রসারিত করেছে। ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইথিওপিয়া এবং মিশর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে যোগদান করেছে। এর পরই রাশিয়া সংস্থাটির তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব পেল।
ব্রিকসের এই সম্প্রসারণকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন জি-৭ এর পাল্টা ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এবং মস্কো ও বেইজিংয়ের নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরির প্রচেষ্টায় একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়াও ব্রিকসে যোগদানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। ভিয়েতনামও গত মাসে ব্রিকস নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গত সপ্তাহে ভিয়েতনাম রাশিয়ায় ব্রিকস পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে তার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে ভিয়েতনামের চেয়ে রাশিয়া এই সফর থেকে বেশি লাভবান হতে পারে। আর হ্যানয় উত্তর কোরিয়া সফরের পরে পুতিনকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে সুনাম হারানোর ক্ষতির শিকার হতে পারে।
লে হং হিপ বলেন, “যদি কোনও সারগর্ভ চুক্তি নাও হয়, তথাপি এই সফরটি প্রতীকীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হবে। এর মধ্য দিয়ে পুতিন ও রাশিয়া বিশ্বকে দেখাতে পারবে যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো কাজ করছে না। আর সেই প্রতীকবাদ পুতিনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
তথ্যসূত্র : রয়টার্স, সিএনএন