Beta
শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৪

ভোট তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হলেই ভালো, বিদায়ী বক্তব্যে সিইসি

নির্বাচন ভবনে বৃহস্পতিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
নির্বাচন ভবনে বৃহস্পতিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
Picture of সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

সকাল সন্ধ্যা প্রতিবেদন

দেশের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার পক্ষে মত দিয়ে গেলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) পদ থেকে পদত্যাগ করা কাজী হাবিবুল আউয়াল।

বৃহস্পতিবার ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে তার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার আগে এই অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

হাবিবুল আউয়াল বলেন, “প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।”

সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব ও মো. আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। বাকি দুই নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে না থাকলেও হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কমিশনই পদত্যাগ করেছে।

লিখিত বক্তব্যে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে ছিল বিতর্ক।

“১৯৯১ সালের নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।”

২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সেই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। এই নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বা সেইফ এক্সিট বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ হয়েছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না।”

হাবিবুল আউয়াল বলেন, “২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। এই নির্বাচনও ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। আসন পেয়েছিল মাত্র ৬টি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮ টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।”

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান কমিশনের অধীনে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধ দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি।”

বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি জানিয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়। নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনও সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না।

“সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কতদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে, তাও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনই কোনও কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেনি।”

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে। দলের মধ্যে নয়। ২৯৯ আসনে ১ হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।”

নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অত্যন্ত কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ– মন্তব্য করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ বা দায়-দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে, কিন্তু সবসময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে।

“বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশি শক্তিবিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।”

১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের অন্যান্য সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তার নেতৃত্বাধীন কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচন সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।

দুই নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব ও মো. আলমগীরকে সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

তিনি বলেন, “জাতীয় এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে দিনের বেলায় ব্যালট পেপার প্রেরণ, কতিপয় উপনির্বাচনে ভিডিও পর্যবেক্ষণ, ইভিএম ব্যবহার, দেশের সব জেলায় একই দিনে, তবে প্রতিটি জেলার প্রশাসনিক সীমানার মধ্যে মাঝে ৩/৫ দিন বিরতি দিয়ে ৫/৬টি ধাপে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপকভাবে রদবদল ইত্যাদি গৃহীত ব্যবস্থা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল।

“নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে, মধ্যে হয়নি। উইদিন হয়েছে, নট বিটুউন।”

হাবিবুল আউয়াল বলেন, “কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দু’বছর সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। নির্বাচনগুলোর সততা, সিদ্ধতা, নিরপেক্ষতা অবাধ হওয়া নিয়ে অতীতের ন্যায় ব্যাপক বিতর্ক বা সমালোচনা হয়নি।

“উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে কমিশন নির্বাচন করেছে। দলীয়ভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে। এটি সঠিক ও যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনও নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি– এমন উদাহরণ নেই।”

তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার বারবার বলছে– ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথার মধ্যেই নিহিত। কমিশনের সদস্যরা সংবিধান মেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আমাদের কর্মকালে আমরা সংবাদমাধ্যম, প্রশাসন, আইশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনীসহ আবশ্যক সবার সহযোগিতা পেয়েছি। কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্মরণ করছি।”

বর্তমান ও অতীত থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাবনা সরকারের বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া কর্তব্য মনে করেছেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানান কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয় ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে ৩/৫ দিনের বিরতি রেখে আয়োজন করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে।

“এছাড়া প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।”

সংবাদ সম্মেলনের একেবারে শেষ ভাগে পদত্যাগের ঘোষণা দেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, “সবশেষে জানাতে চাই– আমিসহ মাননীয় কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থির করেছি। আমরা আজ পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপনের নিমিত্তে কমিশনের সচিবের হাতে দেব।”

পরে কাজী হাবিবুল আউয়াল পদত্যাগ পত্রে সই করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষ করেই হাবিবুল আউয়াল ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে চলে যান।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত