আন্দোলনের কারণে আটকে গিয়েছিল এবারের এইচএসসি পরীক্ষা; সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে পরীক্ষায় বসতে অনীহা জানানোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও আর এগোয়নি। তাই বিশেষ পদ্ধতিতে মূল্যায়নের মাধ্যমে এবার এই পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হচ্ছে।
ফল ঘোষণার আগের দিন সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানালেন, কেন শিক্ষার্থীরা অটোপাসের দাবি মেনে নিতে পারেননি।
এইচএসসির বাকি পরীক্ষাগুলো নিতে পারলে ভালো হতো, সেই সঙ্গে বললেন তিনি।
এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি, আলিম ও এইচএসসি-ভোকেশনালে ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন পরীক্ষার্থী ছিল, তাদের ফল ঘোষণা হবে মঙ্গলবার।
ফল প্রকাশের আগের দিন উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন সরকার নেয়নি, তা বাসসকে বলেন।
“সবাইকে এখন অটোপাস করিয়ে দিলে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ যে শিক্ষার্থীরা কৃতকার্য হয়েছে, তাদের ফলাফলকে অবমূল্যায়ন করা হবে। কাজেই এ ধরনের দাবির কোনও যৌক্তিকতা দেখি না।”
ছাত্রদের নেতৃত্বে রক্তাক্ত আন্দোলনের পর একদল পরীক্ষার্থী সচিবালয়ে গিয়ে পরীক্ষা না নেওয়ার দাবি তুলেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়।
সে বিষয়ে ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, “সচিবালয়ে একটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মধ্যে কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিক পরীক্ষাগুলো বাতিলের ঘোষণা দিতে হয়েছিল।”
মঙ্গলবার কোন প্রক্রিয়ায় ফল প্রকাশ হবে- সে বিষয়ে তিনি বলেন, “বোর্ড কর্তৃপক্ষ এখন পূর্বেকার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এইচএসসির যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল হয়েছিল; তার সঙ্গে এসএসসির সম্পর্কিত বিষয়ের ফলাফল সমন্বয়ে করে চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করেছে বলে আমাকে জানিয়েছে।”
বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার এর আগে জানিয়েছিলেন, যে কয়টি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে, সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়নে আসবে। যেগুলোর পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর এসএসসিতে যে নম্বর পেয়েছে শিক্ষার্থীরা, সেটাই সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, এসএসসিতে যারা কোনও বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হওয়ার কারণে পরবর্তী বছরে আবার পরীক্ষার সুযোগ নিয়েছে, সেই ফলাফলও নেওয়া হয়েছে। কাজেই চূড়ান্ত ফলাফলে যারা উত্তীর্ণ হবে না, তারা বঞ্চিত হয়েছে বলা যাবে না।
ফল প্রকাশ যেভাবে
অন্য সব বার ঘটা করে এইচএসসির ফল প্রকাশিত হলেও এবার তেমন কোনও আয়োজন থাকছে না। শিক্ষামন্ত্রীদের মতো কোনও সংবাদ সম্মেলনেও আসবেন না শিক্ষা উপদেষ্টা।
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় এক যোগে সব বোর্ডের ফল প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে বাসস।
অধ্যাপক তপন সরকার বলেন, “আনুষ্ঠানিকতা বলতে আগের মতো কিছু না; শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কিছু হবে না, কোথাও কোনও কিছু হবে না। সাংবাদিকদের পরিসংখ্যান দিয়ে দেব আমরা।”
তিনি জানান, সকাল ১১টায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ফলাফল দেওয়ার পাশাপাশি আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের ফলাফলের পরিসংখ্যানও দিয়ে দেবেন তারা। একই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনলাইনে ফল প্রকাশ করা হবে।
যেভাবে জানা যাবে ফলাফল
এবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইটের পাশাপাশি যে কোনও মোবাইল নম্বর থেকে এসএমএস করে পরীক্ষার ফল জানা যাবে।
ঢাকা বোর্ডের ওয়েবসাইট (www.dhakaeducationboard.gov.bd) ও বোর্ডগুলোর সমন্বিত ওয়েবসাইটে (www.educationboardresults.gov.bd) গিয়ে রেজাল্ট কর্নারে ক্লিক করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম এন্ট্রির পর প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ফলাফল পাওয়া যাবে।
এছাড়া পরীক্ষার্থীরা রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর টাইপ করে ফল জানতে পারবে।
মোবাইলে ফল জানতে ইংরেজিতে এইচএসসি লিখে স্পেস দিয়ে শিক্ষা বোর্ডের নামের প্রথম তিন অক্ষর লিখে স্পেস দিয়ে রোল নম্বর লিখে স্পেস দিয়ে ২০২৪ লিখে ১৬২২২ নম্বরে পাঠাতে হবে। ফিরতি এসএমএসে আসবে ফল।
যেভাবে আটকে গিয়েছিল পরীক্ষা
এবছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছিল গত ৩০ জুন। তবে বন্যার কারণে সিলেট বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হয় ৯ জুলাই।
সব মিলিয়ে পরীক্ষার্থী ছিল ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ২৮ হাজার ২৮১ জন। অন্যদিকে মাদরাসা বোর্ডের আলিমে ৮৮ হাজার ৭৬ জন এবং কারিগরি বোর্ডের পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৩ জন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংসতায় গড়ানোর পর ১৮ জুলাই এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। তখন পর্যন্ত সাতটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল।
এরপর আন্দোলন আরও তীব্র হয়। কয়েকশ মানুষের মৃত্যুতে সেই বিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। তার জেরে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে।
এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পরীক্ষা পুনরায় শুরুর তোড়জোড় হচ্ছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর সহিংসতায় বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নপত্র পুড়ে যাওয়ায় পরীক্ষা ফের শুরুতে দেরি হচ্ছিল।
পরে স্থগিত পরীক্ষাগুলো ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সেজন্য নতুন সূচিও প্রকাশ করেছিল কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু পরীক্ষা দিতে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। তাদের যুক্তি ছিল, সহিংস আন্দোলনের যে ট্রমা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠে পরীক্ষায় বসার মতো অবস্থায় নেই তারা।
তখন অন্তর্বর্তী সরকার তা আরও দুই সপ্তাহ পিছিয়ে অর্ধেক প্রশ্নে পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
কিন্তু ২০ আগস্ট ৫ শতাধিক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ঢুকে পরীক্ষা না দেওয়ার দাবি তোলে। সেদিনই কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি মেনে নিয়ে বাকি পরীক্ষাগুলো না নেওয়ার ঘোষণা দেয়।