কক্সবাজারের কলাতলীর হোটেল-মোটেল এলাকা গত ৩ মাসে ৪ বার জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে। সর্বশেষ শুক্রবার রেকর্ড বৃষ্টিতে ডুবে যায় পর্যটন জোন নামে পরিচিত এই এলাকার সব সড়ক, সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকা ও মার্কেট এলাকা।
পাশাপাশি কক্সবাজার শহরের পাঁচ কিলোমিটারের প্রধান সড়কও এদিন জলমগ্ন হয়ে পড়ে। বাজারঘাটা, বড়বাজার, অ্যান্ডারসন, টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট এলাকা, বৌদ্ধমন্দির সড়ক পানিতে ডুবে যায়।
গোলদিঘিরপাড় এলাকার দোকানপাট, অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেক ঘরবাড়ি শুক্রবারের বৃষ্টিতে পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
কক্সবাজারে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা থেকে শুক্রবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় ৫০১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এর ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা আগে কখনও দেখেনি শহরবাসী। এর জন্য শহরের হলিডের মোড় থেকে বাজারঘাটা হয়ে লারপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়ক ও লাবণীর মোড় থেকে কলাতলী হয়ে লিংক রোড পর্যন্ত নেওয়া প্রায় ৬ কোটি টাকার অদূরদর্শী সড়ক প্রকল্পকেই দায়ী করছেন তারা।
এনিয়ে সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা হয় কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদারের।
তিনি বলেন, “ভারী বর্ষণ হলেই পর্যটন জোনে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। সেখানে চার লেনের সড়ক নির্মাণ এর জন্য দায়ী বলে মনে করি। সড়কটি নির্মাণের সময় এটিকে আগের চেয়ে অস্বাভাবিক উঁচু করা হয়েছে এবং নালার অংশ ছোট করে ফেলা হয়েছে।
“একই সঙ্গে নালার ওপর স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সড়কের পানি নালা দিয়ে নেমে যাওয়ার পথ রাখা হয়নি। তার ওপর পাহাড় কাটার মাটি নেমে এসে নালা ভরাট করে দিচ্ছে, যা পরিষ্কার করারও সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে বৃষ্টির পানি দ্রুত সাগর-নদীতে নেমে যেতে পারছে না। জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। গত জুলাই মাসেও কয়েক দফায় ভারী বৃষ্টি হয়েছিল। তখনও শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।”
কক্সবাজার শহরের হলিডের মোড় থেকে বাজারঘাটা হয়ে লারপাড়া বাস টার্মিনাল পর্যন্ত প্রধান সড়কের সংস্কার প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ২৯৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে।
আর লাবণীর মোড় হয়ে কলাতলী-লিংক রোড পর্যন্ত ৪ লেনের সড়কটি নির্মাণ করে কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগ। ২০১৯ সালের নভেম্বরে নির্মাণ শুরু হওয়া সড়কটি উদ্বোধন হয় ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর। ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক চার লেন করতে ব্যয় ধরা হয় ২৮৮ কোটি টাকা।
কক্সবাজার সড়ক ও জনপদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মাঝখানে ১০ ফুট ডিভাইডার, দু’পাশে ৬ ফুট করে ড্রেনসহ লাবণীর মোড় হয়ে কলাতলী-লিংক রোড পর্যন্ত ৪ লেনের এই সড়ক প্রশস্ত হয়েছে ৭১ ফুট।
কক্সবাজার শহরের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ভারি বৃষ্টির প্রভাবে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে, তা এবারই প্রথম প্রত্যক্ষ করেন স্থানীয় সংগঠন কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি, আইনজীবী আয়াছুর রহমান।
কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়ক সংস্কারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “লাবণীর মোড় থেকে কলাতলী-লিংক রোড সড়কের মতো কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কও জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সড়ক সংস্কারে সময় গেছে ৩ বছরের বেশি। প্রধান সড়কটি আগের অবস্থার চেয়ে কম করে হলেও ৩ ফুট উঁচু করা হয়েছে। এতে নিচে পড়ে গেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মার্কেটগুলো।
“যে নালা করা হয়েছে, সেখানে ময়লা আবর্জনায় ভরে আছে। স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা নালা পরিষ্কার করার সুযোগ নেই। উঁচু হওয়া সড়কের দক্ষিণ এলাকার পানি অতিক্রম করে উত্তরের বাঁকখালী নদীতে যে যাবে, তাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ভারী বর্ষণ ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নালা দিয়ে নেমে যেতে পারছে না বলেই শহরজুড়ে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।”
একই মত পোষণ করেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা।
তিনি বলেন, “অপরিকল্পিত ও অস্বাভাবিক উঁচু স্ল্যাব দিয়ে ঢাকা প্রায় ৬ কোটি টাকার সড়ক প্রকল্প এখন জনগণের ভোগান্তির একমাত্র কারণ। কলাতলী ও প্রধান সড়কের নালা এখন বন্ধ। পানি নেমে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে।”
কক্সবাজারের প্রধান সড়কে এবারের বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার ভুক্তভোগী মোটেল লাবণী মাকের্টের ব্যবসায়ী সিফাত। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানে গত ৩ মাসে ৪ বার বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছে। নালা বন্ধ হওয়ায় পানি নিষ্কাশনের পথ নেই।
শহরের প্রধান সড়ক সংস্কার প্রকল্প নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট রিদুয়ান আলী।
তিনি বলেন, “প্রধান সড়ক সংস্কারের সময় জোর প্রতিবাদ এসেছিল অস্বাভাবিক উঁচু না করতে। কিন্তু কেউ তা শোনেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বাসিন্দাদের এখন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।”
এদিকে, শুক্রবারের পর বৃষ্টি কিছুটা কমে যাওয়ায় কক্সবাজার শহর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে এখনও জেলা সদরসহ ৬ উপজেলার অন্তত ২ শতাধিক গ্রাম পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।