Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে গুপ্তচর ‘তরমুজ’ বদলে দিচ্ছে হিসাব

tARMUJJ
[publishpress_authors_box]

মিয়ানমারের এক সময়কার শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ভেতর থেকে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাহিনীর অনেকেই গোপনে গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহীদের জন্য কাজ করছে।

তাদের ‘তরমুজ’ নামের গুপ্তচর নেটওয়ার্কের তথ্যের কারণে বদলে যাচ্ছে যুদ্ধের হিসাব। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের মাত্র এক-চতুর্থাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে জান্তা বাহিনী।

জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ জানিয়েছেন, জান্তারা বড় শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখলেও তা এখনও ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’। গত এক বছরে তারা উল্লেখযোগ্য অঞ্চল হারিয়েছে।

বিদ্রোহীদের প্রতীকী রঙ লাল। গোপনে বিদ্রোহীদের জন্য কাজ করা সেনাদের তাই ‘তরমুজ’ বলা হয়।

মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের এক মেজর জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর নৃশংস আচরণই তাকে পক্ষ পরিবর্তনে বাধ্য করেছে।

কিয়াও (ছদ্মনাম) নামের ওই মেজর বলেন, “আমি নির্যাতিত সাধারণ মানুষের লাশ দেখেছি। চোখে জল এসেছে। মানুষদের সঙ্গে এত নিষ্ঠুরতা কীভাবে সম্ভব? আমাদের তো সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার কথা। কিন্তু এখন আমরা তাদের হত্যা করছি। এটা আর সেনাবাহিনী নয়, এটা এখন সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী শক্তি।”

জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে এবং হাজারো মানুষ নিহত হয়েছে। এ ঘটনা দেশে বিদ্রোহের জন্ম দিয়েছে।

প্রথমে কিয়াও সেনাবাহিনী ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। পরে স্ত্রীকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, গুপ্তচর হওয়াই বিপ্লবে সেবা করার সেরা উপায়।

নিজেকে যখন তিনি নিরাপদ মনে করেন, তখন সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ তথ্য পিপলস ডিফেন্স ফোর্সকে (পিডিএফ) সরবরাহ করেন। এই তথ্য বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালাতে বা আক্রমণ এড়াতে ব্যবহার করে।

কিয়াও তার বেতন থেকে কিছু অর্থও বিদ্রোহীদের অস্ত্র কিনতে পাঠান।

এই গুপ্তচররা আন্দোলনকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা একসময় অসম্ভব মনে করা হতো।

গুপ্তচর উইন অং।

চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমারের ১৪ হাজার গ্রামীণ অঞ্চলের মধ্যে সামরিক বাহিনী কেবল ২১ শতাংশ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে। জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ৪২ শতাংশ এলাকা। বাকি এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘাত চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডাটা প্রজেক্ট (এসিএলইডি) জানিয়েছে, ১৯৬২ সালে প্রথম ক্ষমতা দখলের পর থেকে বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।

জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী এবং বেসামরিক মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সমন্বিত অভিযান সামরিক বাহিনীকে চাপের মধ্যে ফেলেছে।

উল্লেখযোগ্য ভূখণ্ড হারানোর পর এই বছরের শুরুতে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং এক বিরল স্বীকারোক্তিতে জানান, তার বাহিনী কঠিন চাপে রয়েছে।

সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে ফাঁস হওয়া ‘তরমুজ’ গোয়েন্দা তথ্য প্রতিরোধ আন্দোলনের দিক বদলে ভূমিকা রাখছে। দুই বছর আগে পিডিএফ গুপ্তচর নেটওয়ার্ক পরিচালনা এবং আরও গুপ্তচর নিয়োগের জন্য একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করে।

উইন অংয়ের (ছদ্মনাম) মতো এজেন্টরা তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্রোহী নেতাদের কাছে পাঠান।

উইন অং একসময়ের সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা। তিনি অভ্যুত্থানের পর প্রতিরোধ বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি জানান, প্রতিদিন নতুন ‘তরমুজ’ যোগ দিচ্ছে। সোশাল মিডিয়া গুপ্তচর নিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

গুপ্তচরদের মধ্যে নিম্নপদস্থ সৈনিক থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমনকি জান্তা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে গ্রামপ্রধান পর্যায়েও তাদের ‘তরমুজ’ রয়েছে বলে দাবি করা হয়। তারা নিশ্চিত করেন কেউ যেন ডাবল এজেন্ট না হয়। এজন্য কঠোর যাচাই প্রক্রিয়া আছে।

একেক জন গুপ্তচর হন একেক কারণে। কিয়াওর ক্ষেত্রে এটি ছিল ক্রোধ। আর মো (ছদ্মনাম) নামের এক নৌবাহিনীর কনস্টেবলের জন্য এটি শুধু তার ছোট পরিবারের জীবিকা রক্ষার ইচ্ছা।

মো’র স্ত্রী যখন গর্ভবতী, তখন তিনি গুপ্তচর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সামরিক বাহিনী হেরে যাচ্ছে এবং তিনি যুদ্ধে মারা যেতে পারেন। তিনি অস্ত্র ও সৈন্যদের গতিবিধি ‘তরমুজ’ ইউনিটকে ফাঁস করতে শুরু করেন।

এ ধরনের গোয়েন্দা তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, জানান গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহী নেতা ডাইভা।

বিদ্রোহীদের সঙ্গে ডাইভা।

তার প্রতিরোধ ইউনিটের মূল লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ও পুরনো শহর ইয়াঙ্গুন দখল করা। তবে তারা এখনও লক্ষ্যের অনেক দূরে।

সামরিক বাহিনী এখনও প্রধান শহরগুলোর অধিকাংশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কারণ, সেখানেই আছে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও রাজস্ব আদায়ের বন্দোবস্ত।

ডাইভা বলেন, “ইয়াঙ্গুন আক্রমণ ও দখল করা বলা সহজ। কিন্তু বাস্তবে এটি কঠিন। শত্রু সহজে এটি ছেড়ে দেবে না।”

শহরে শারীরিকভাবে প্রবেশ করতে না পারলেও, ডাইভা তার জঙ্গলের ঘাঁটি থেকে ‘তরমুজ’ গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করে ইয়াঙ্গুনে অবস্থিত আন্ডারগ্রাউন্ড সেলের মাধ্যমে লক্ষ্যভিত্তিক আক্রমণ পরিচালনা করেন।

ডাইভা এক কর্নেলের উপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “আমরা শত্রুর নিরাপত্তা সীমানার ভেতরেই এটি করব। সতর্ক থাকুন, শত্রু সব দিক থেকে হেরে যাচ্ছে। এর মানে হলো তারা এখন সম্ভবত গুপ্তচর এবং অনুপ্রবেশকারীদের জন্য সতর্ক থাকবে।”

ডাইভা জানান, তার ইউনিটের কয়েকটি বড় আক্রমণ গোপন তথ্যের মাধ্যমে হয়েছে।

তবে এমন গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্রায়ই কড়া মূল্য দিতে হয়। ‘তরমুজ’ গুপ্তচরদের উভয় পক্ষ থেকেই ভয়ভীতির মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। এমন উপলিব্ধির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে নৌবাহিনীর কনস্টেবল থেকে গুপ্তচরে পরিণত হওয়া মো’কে।

রাখাইনে তাকে মোতায়েন করা হয়েছিল। তাকে সবসময় ভয়ে থাকতে হতো যে, তার তথ্যের কারণে সে নিজেই আক্রমণের শিকার হতে পারে।

২০২৩ সালের মার্চে তার নোঙর করা জাহাজে একটি মিসাইল আক্রমণ হয়। এরপর চলে গুলি।

এ বিষয়ে মো বলেন, “পলানোর কোনও জায়গা ছিল না। আমরা পিঁপড়ের মতো মার খাচ্ছিলাম। বিদ্রোহীদের আক্রমণে আমার সাত সহযোদ্ধা নিহত হয়।

উইন অং বলেন, “আমাদের পক্ষে তরমুজদের সুরক্ষা দেওয়া খুবই কঠিন। আমরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে পারি না যে, তারা তরমুজ। আমাদের বাহিনীকে নির্দিষ্ট কোনও সামরিক কনভয়ে আক্রমণ করতে বাধা দিতে পারি না।”

জান্তা বাহিনীর সদস্যরা।

তবে এই ব্যাপারটি তরমুজদের কাছে ব্যাখ্যা করা হলে তারা ভয় পায় না। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, ‘যখন সেই মুহূর্ত আসবে, তখন দ্বিধা কর না, গুলি কর’।

কিন্তু কিছু সময় আসে যখন গুপ্তচররা আর এই বিপদের পরিস্থিতি সহ্য করতে পারেন না।

মো’কে সেনাবাহিনী থেকে আরেকটি বিপজ্জনক ফ্রন্ট লাইনে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন তিনি ‘তরমুজ’ ইউনিটের কাছে আবেদন করেন তাকে যেন প্রতিরোধ অঞ্চল নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিরোধ বাহিনী একটি আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, যার মধ্যে রয়েছে মঠ ও নিরাপদ বাড়ি।

মো গভীর রাতে সেখান থেকে চলে যান। পরদিন যখন তিনি ডিউটির জন্য আসেননি, সেনারা তার বাড়িতে আসে। তারা তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে তিনি কিছু বলেননি।

কয়েকদিন পালানোর পর মো ডাইভার ঘাঁটিতে পৌঁছান। ডাইভা ভিডিও কলে তাকে ধন্যবাদ জানান এবং তার পরবর্তী ভূমিকা কী হবে জানতে চান। মো জানান, তার ছোট পরিবারকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি যুদ্ধে না গিয়ে তার সামরিক প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত জ্ঞান ভাগ করতে চান।

কয়েক সপ্তাহ পর তিনি থাইল্যান্ডে চলে যান। চোয়ের পরিবারও বাড়ি ছেড়ে পালায়। একদিন তারা দেশে ফিরে নতুন জীবন শুরু করবেন, এই আশা নিয়েই তারা দেশত্যাগ করেন।

সামরিক বাহিনী হারানো এলাকা পুনরুদ্ধারের জন্য আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং ব্যাপক বোমাবর্ষণ করছে। চীন ও রাশিয়ায় তৈরি যুদ্ধবিমান নিয়ে আকাশে তাদের দাপট বাড়ছে।

জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ বলেন, “জান্তা যত বেশি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তাদের নিষ্ঠুরতা তত বাড়ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে।”

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কিয়াও বলেন, “সামরিক বাহিনী তরমুজদের খুঁজে বের করতে তল্লাশি চালাচ্ছে। যখন আমি তল্লাশির খবর শুনলাম, আমি কিছু সময়ের জন্য থেমে যাই।”

কিয়াও জানেন না কতদিন তিনি গোপন থাকতে পারবেন। পালানোর কোনও সুযোগ নেই। কারণ, তিনি তার বয়স্ক পিতামাতাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করেন। তাই আপাতত তিনি সেনাবাহিনীর গুপ্তচর হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন, একদিন বিপ্লব শেষ হওয়ার আশা নিয়ে।

কখনও যদি সেই দিন আসে, কিয়াও ও মোর মতো তরমুজদের ভুলে যাওয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন উইন অং।

তথ্যসূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত