দ্রব্যমূল্য সহনশীল রাখার মাধ্যমে সরকার মানুষের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করে যাচ্ছে, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এমনটাই জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “রমজান মাসের শুরুতে খেজুর, আমদানি করা ফল, লেবু, তরমুজ, পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের দাম কিছুটা চড়া ছিল। তবে এসব পণ্যের দাম কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক ও সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট হয়। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষের কষ্ট লাঘবের।”
সোমবার সন্ধ্যায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০২৪ উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী।
তার কথায় উঠে আসে জনকল্যাণে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা।
এবারের রমজান মাসকে সামনে রেখে আগে থেকেই চিনি, ছোলা, ডাল, ভোজ্য তেলসহ কয়েকটি প্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তোলা হয়েছিল বলে জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “একচেটিয়া বাজার তৈরি করে অধিক মুনাফা যাতে কেউ করতে না পারে সেজন্য ভারত থেকে ৫০ হাজার মেট্রিকটন পেঁয়াজ এবং প্রায় সমপরিমাণ আলু আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি রমজান মাসের শুরু থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য রাজধানী ঢাকার অন্তত ২৫টি স্থানে ট্রাকে করে মাছ, মাংস, ডিম এবং দুধ সুলভমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।”
টিসিবির মাধ্যমে সারাদেশের ১ কোটি কার্ডধারী পরিবারের জন্য সুলভমূল্যে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি এবং ছোলা বিতরণের কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। জানান ঈদ উপলক্ষে দেশের ১ কোটি ৬২ হাজার ৮০০ পরিবার পাবে ১০ কেজি করে চাল।
এ বছর সরকারিভাবে এবং দলগতভাবে ইফতার পার্টির আয়োজন নিরুৎসাহিত করেছেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আওয়ামী লীগ এবং এর সব সহযোগী সংগঠন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত গরিব-দুঃস্থদের মধ্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করছে।”
এসময় বিশ্বজুড়ে টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গও টেনে আনেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারির কারণে শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। সেই ধকল কাটতে না কাটতেই ২০২২ সালের গোড়ার দিকে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
“এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অবরোধ-পাল্টা অবরোধ আরোপের ফলে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো চরম সঙ্কটের মুখে পড়েছে। নিত্যপণ্যের উৎপাদন ও বিপণন যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি এসব পণ্যের স্বাভাবিক চলাচলও বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরসঙ্গে গত বছরের শেষে যুক্ত হয়েছে গাজায় ফিলিস্তিনের উপর ইসরাইলী বাহিনীর গণহত্যা।”
পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ ও অগ্নিসংযোগে ক্ষয়ক্ষতির কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, “এসব অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলাদ করে আমরা দেশের অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
গত দেড় দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটেছে উল্লেখে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অভ্যন্তরীণ এবং বাইরের অভিঘাত মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ সকল খাতে আজকে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়।
“এক সময়ের দারিদ্র্য-জ্বরাক্লিষ্ট বাংলাদেশ আজ সক্ষম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ।”
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। হতদরিদ্রের হার ২৫ দশমিক ১ থেকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে এখন স্বয়ং-সম্পূর্ণ।”
সরকারের অব্যাহত নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে আসা বিভিন্ন সাফল্যের তথ্যও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, শিশু মৃত্যুর হার নেমে এসেছে প্রতি হাজারে ২১জনে এবং মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬১ জনে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে।
পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল, বিভাগীয় শহরগুলোর সঙ্গে চার বা তারও বেশি লেনের মহাসড়ক চালুসহ অবকাঠামো খাতে তার সরকারের নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের কথাও বলেন শেখ হাসিনা।
জানান দেশের শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসার কথাও।
ভাষণের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। সেইসঙ্গে স্মরণ করেন জাতীয় চারনেতা – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, নির্যাতিত নারী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা গ্রহণের পর সবার সমর্থন এবং সহযোগিতা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে তাদের মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করছেন বলে জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আজ স্বাধীনতার ৫৩তম বার্ষিকীতে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমরা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। এটা কোনও বাগাড়ম্বর দাবি নয়। বাংলাদেশ আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা প্রমাণ করেছি রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সীমিত সম্পদ দিয়েও একটি দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়।”
২০২১ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সকল শর্ত পূরণ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আশা করা হচ্ছে ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হবে।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্ষাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র আজও থামেনি, অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও ওঁৎ পেতে বসে আছে কীভাবে বাংলাদেশের অগ্রসরমান অভিযাত্রাকে স্তব্ধ করা যায়।
“তবে বাঙালি বীরের জাতি। যুদ্ধ করে আমরা এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় – জাতির পিতা নির্দেশিত এই বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করেই আমরা দেশ পরিচালনা করি। আমাদের কোনও প্রভু নেই, আছে বন্ধু। তাই কারও রক্তচক্ষু বাঙালি জাতি কোনোদিন মেনে নেবে না। প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-সম্মান রক্ষা করবে।”
২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে দেশবাসীর সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি। সবার উদ্দেশে বলেন, “স্বাধীনতার ৫৪তম দিবসে আসুন, সকল কুট-কৌশল-ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাই।”