দেশের সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে কীভাবে অবাধ, সত্য তথ্য সংগ্রহ করা যায়, সে বিষয়ে ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা চেয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
জাতীয় ঐক্য গড়তে এবং চলমান বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করতে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার ফরেইন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংলাপে এ সহযোগিতা চান তিনি।
তথ্য সংগ্রহকারীর নিরাপত্তা ও তথ্য দানকারীও যাতে বিব্রত না হন- তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “অনেক সময় সরকারি তথ্যের ওপর ভরসা করে লাভ নেই। কর্তা যা চায়, সেভাবে বলে। আসলটা মন খুলে বলতে চায় না। আমরা আসল খবরটা জানতে চাই। সেই প্রক্রিয়াটা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।
“এত বড় দেশে যেকোনো ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু প্রকৃত তথ্য জানতে চাই। তাৎক্ষণিক খবর পেলে যাতে সমাধান করা যায়। যেদিক থেকেই দোষী দোষীই। তাকে বিচারের আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে চলা কূটনৈতিক টানাপড়েন উত্তেজনার দিকে গড়ানোর প্রেক্ষাপটে এর আগে গতকাল বুধবার ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফরেইন সার্ভিস একাডেমিতে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
ওই সংলাপে অভ্যুত্থান মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে বলে রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করেন তিনি; আহ্বান জানান এই সময়ে সবাইকে একজোট থাকার।
আগেই জানানো হয়েছিল, এই সংলাপে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন ড. ইউনূস। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের আগের দিন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
এর আগেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসেন ড. ইউনূস; তবে তখন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সংস্কার ও নির্বাচন। এবারের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় আসার চার মাস পরের এই বৈঠকে ষড়যন্ত্র ঠেকানোর ওপরই তিনি জোর দেন।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান, হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, জুনায়েদ আল হাবিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী, বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মাহফুজুল হক, ইসলামী বক্তা ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদুল্লাহ, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব আবদুল মালেকসহ কয়েকজন আলেম অংশ নেন।
সংলাপে কোনও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে, প্রথমে সেই পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “প্রথম কথাটা হলো না হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা করা।”
সরকার গঠনের আগে বিমানবন্দরে দেওয়া বক্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, “তখন আমি বলেছিলাম- আমরা একটা পরিবার। আমাদের নানা মত, নানা ধর্ম থাকবে, নানা রীতিনীতি থাকবে, কিন্তু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। এটাতে জোর দিয়েছিলাম। আমাদের শত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা পরস্পরের শত্রু নই। আমাদের জাতীয়তা, পরিচয়ের প্রশ্নে এক জায়গায় চলে আসি। আমরা বাংলাদেশি, এক পরিবারের সদস্য।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “শপথ গ্রহণের পরে শুনতে আরম্ভ করলাম, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর পরপরই আমি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেলাম। সেখানেও বললাম, আমরা একই পরিবারের সদস্য।
“সব দাবি-দাওয়া বাদ দিলেও একটা দাবি পরিষ্কার, আমাদের সকলের সমান অধিকার, বলার অধিকার, ধর্মের অধিকার, কাজকর্মের অধিকার। সেটা এসেছে সংবিধান থেকে। নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেটা নিশ্চিত করা।”
তিনি বলেন, “আজকের আলোচনা খোলাখুলি। আমরা সবাই আলোচনা করব। আমাদের লক্ষ্যে কোনও গোলমাল নেই। তথ্যপ্রবাহ কীভাবে পাব, দোষীকে কীভাবে ধরব। যাতে সবাই সঠিক তথ্যটা পেয়ে যায়। এমন বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই, যার নাম দিয়েছি নতুন বাংলাদেশ। এটা আমাদের করতে হবে।”
ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস আরও বলেন, “মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জেগেছে, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়ার জন্য আপনাদের সঙ্গে বসা।”
তিনি বলেন, “শুনলাম, এখনও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। তাই আমি সবাইকে নিয়ে বসলাম। এটা থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়।”
বিদেশি কিছু প্রচারমাধ্যমে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এখন আবার নতুন কথা- হামলা হচ্ছে, অত্যাচার শুরু হচ্ছে।…আমি খোঁজ নিচ্ছি, কী হচ্ছে? সব দিকে দেখলাম, এটা (হামলা-অত্যাচার) হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, “ভেতরে গিয়ে দেখতে হবে। সত্যটা কোথায়?”
বুধবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি(এনপিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (এনডিএম), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অধ্যাপক ইউনূস।
বুধবারের সংলাপের সূচনা বক্তব্যে ড. ইউনূসকে উদ্ধৃতি করে বাসস প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, “আমাদের এই বিরাট অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি, তারা একে মুছে দিতে চায়। আড়াল করতে চায়। এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়। এর বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে। এখানে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের বিষয় না, জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়।”
ষড়যন্ত্রের শুরু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকেই শুরু হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে এখন তা নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে তার পর্যবেক্ষণ। সেই কারণেই এই সংলাপ আহ্বান বলে তিনি জানান।
কোনও দেশের নাম উল্লেখ না করে ড. ইউনূস বলেন, “তবে এখন যে চেষ্টা চলছে, তার বিশেষ একটা রূপ আছে। সেজন্য আপনাদের বিশেষভাবে আহ্বান জানিয়েছি।
“এটা হচ্ছে, যে বাংলাদেশ আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে আরেক বাংলাদেশের কাহিনী তারা রচনা করছে। সারাক্ষণ এটার নানা রূপরেখা তারা দিয়ে যাচ্ছে। এটা যে এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, তা নয়। বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যে জড়িয়ে গেছে।”
এই সংলাপ আয়োজনের খবর দেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ভারতের সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচারের অভিযোগ খোলাখুলি করেছিলেন।
অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ঢাকা-দিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছিল। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি স্বীকারও করেন, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক মাত্রায় নেই।
এরমধ্যে গত ২৫ নভেম্বর হিন্দু সাধু চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করার পর উত্তেজনা আরও বাড়ে। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাল্টাপাল্টি বিবৃতির পর তা রাজপথে বিক্ষোভেও গড়ায়।
সোমবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় এমনই এক বিক্ষোভ থেকে বাংলাদেশ মিশনে হামলা হয়। হামলাকারীরা দূতাবাসে ভাংচুর চালানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকাও পোড়ায়।
তার প্রতিবাদ জানাতে মঙ্গলবার ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলবের পরপরই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ড. ইউনূসের সংলাপ ডাকার খবর আসে।
বুধবারের সংলাপের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বৈঠকে ভারতে বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ ইত্যাদির তীব্র নিন্দা জানানো হয় বলে জানান তিনি।