সকাল সন্ধ্যা: গণ-অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে আপনার আগে থেকে পরিচয় ছিল বলে শুনেছি। আপনাদের যোগাযোগের মাত্রা কেমন ছিল?
হাসনাত কাইয়ুম: আমাদের সাথে না অনেকের সাথেই এই যোগাযোগ ছিল। আমাদের সম্পর্কে বাংলাদেশে যারা আন্দোলন করে তাদের একটি ধারণা আছে। দেশে যত ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন হয় তাতে আমরা সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখি। এটা আমরা কোনও দলীয় স্বার্থ কিংবা ব্যানারের জায়গা থেকে করি না। আন্দোলনের কারণেই আন্দোলনে থাকার চেষ্টা করি। যেমন ধরেন চা বাগানের আন্দোলন ধরে আমরা করেছি। কিন্তু সেখানে আমাদের পার্টির কোনও সদস্য আপনারা পাবেন না। একইভাবে গোবিন্দগঞ্জের আন্দোলনে আমরা সহায়তা করেছি নিজেদের ব্যানার বাদে।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ সহায়তা করেছি। কিন্তু কখনোই আমরা আমাদের ফেইস সামনে আনতে চাইনি। এগুলোর মধ্যে দিয়ে এখানে যারা আন্দোলন করে তাদের মধ্যে নিরাপত্তা ও বন্ধুত্বের বোধ তৈরি হয়েছে। তারা আমাদের একপ্রকার বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করে। যারা আসলে জানে আমরা কোনও আন্দোলনের কৃতিত্ব নিতে বা অংশীদার হতে আসব না। এছাড়াও যারা এখানে চিন্তা করে তাদের চিন্তাকে উৎসাহিত করার কাজ করি। আমরা সবাইকে চিন্তার ক্ষেত্রে বা কাজের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করি। এগুলো মিলেই সম্পর্কটা আছে।
এবারও একইরকম। যারা আন্দোলনটা শুরু করে তারা এখানেই আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল। আন্দোলনের দাবি-দাওয়া কী হতে পারে বা এগুলোর আইনি ভিত্তি কী হতে পারে সেসব নিয়ে আলোচনা করতে এসেছিল। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্বেও তাদের সাথে যোগাযোগ ছিল। এই সম্পর্ক থাকাটা খুবই স্বাভাবিক।
সকাল সন্ধ্যা: গত বছরের এক সাক্ষাৎকারে গণতন্ত্র মঞ্চ বিশেষত ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নিয়ে আপনি বলেছিলেন রাষ্ট্রের সাতটি বিষয়ের সংস্কার করতে চান। তার মধ্যে একটি হচ্ছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া। লোকাল গভর্মেন্টকে শক্তিশালী করা। ঠিক কীভাবে পরিবর্তন চান একটু ব্যাখ্যা করবেন?
হাসনাত কাইয়ুম: বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি একটি স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় পরিচালিত হয়। এখানকার সমগ্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকে। সে পদটার নাম কখনও প্রধানমন্ত্রী আবার কখনও রাষ্ট্রপতি। এই ক্ষমতাগুলো রাষ্ট্র চর্চা করে প্রধান প্রধান কিছু জায়গা থেকে। তার মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, প্রশাসন। এসব ক্ষমতা ধরে রাখার একটি প্রক্রিয়া হলো নির্বাচন। স্থানীয় সরকার বলে তো বাংলাদেশে কিছু নাই। এখানে সাংবিধানিকভাবে তা হলো স্থানীয় শাসন। কেন্দ্রীয় শাসনটাকে আসলে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আমরা ঠিক মতো জানি না বলে একে ‘স্থানীয় সরকার’ বলি। কিন্তু সরকার বলতে যেরকম কাঠামো বোঝায় বা তার যেরকম ক্ষমতা থাকার কথা তার তো কিছুই নাই। আমরা একে প্রকৃত স্থানীয় সরকার করার কথা বলি। কেন্দ্রের সাথে স্থানীয় বডিগুলোর ক্ষমতার একটি ভারসাম্য তৈরি করা বা বিন্যস্ত করার জন্য। বাকি ৬টি খাতকে আমরা বলি ক্ষমতা চর্চার মূল জায়গা। এ জায়গাগুলো ঠিক না করলে কখনোই কিছু হবে না।
এখন যেমন বলা হচ্ছে, আপনারা আপনাদের অফিস ঠিক করেন। এটা মনে হবে এক ধরনের সংস্কার। এগুলো হলো উপরিকাঠামোর সংস্কার। আগে অফিসে গেলে ঢুকতে দিত না, পিয়ন ঘুষ নিত কিংবা ফাইল সরাতে টাকা দিতে হতো। এগুলো মেটানো গেলে মনে হবে আমরা মনে হয় স্মুথ করলাম। এগুলো আসলে উপরিকাঠামোর ভাসা ভাসা সংস্কার। যেই ক্ষমতার বলে এসব ঘটনা ঘটে এবং রাষ্ট্র সেই ক্ষমতা যেভাবে চর্চা করে সেখানে সংস্কার করতে হবে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারগুলো হলে এসব ঘুষ খাওয়া এমনিতেই চলে যাবে। তখন এমন ১০০ সংস্কার হবে তা হয়ত দেখাও যাবে না। কারণ, মানুষের তখন মনে হবে এটা আমাদের অধিকার।
আমরা এজন্যই বলেছিলাম, মানুষের সাথে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে একটি গণতান্ত্রিক সম্পর্কের ভিত্তিতে তৈরি করতে।ক্ষমতার ভারসাম্য, ক্ষমতার জবাবদিহি এবং জনগণের ক্ষমতায়ন এই তিনটি জিনিস করার জন্যই আমরা সেই সাতটি জায়গায় সংস্কারের কাজ করার জন্য বলেছি।
এসব সংস্কার সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে তৈরি হবে। কিন্তু তার আগে যা লাগবে তা হলো মানুষের মধ্যে এসব আকাঙ্ক্ষা তৈরি হওয়া। আমাদের দেশে মানুষ তো অনেক কিছুই জানে না। তাদের মধ্যে এই জানা বোঝাটা ঠিক করতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে কেন সে ক্ষমতাহীন? একই সঙ্গে যাকে সে ক্ষমতায় বসায় সে কেন এত ক্ষমতাশীল? এসব জিনিস সব সংবিধানেই রাখা আছে। সংবিধানেই তো স্থানীয় সরকার, স্থানীয় শাসন হয়ে আছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের কোনও জায়গা নাই। সংবিধান অনুযায়ী আমার যে মৌলিক অধিকার থাকার কথা তা তো নাই। আমার মৌলিক অধিকার শর্ত সাপেক্ষের বিষয় হয়ে গেল। আমার সভা করতে হলে পুলিশের অনুমতির উপর নির্ভর করতে হয়। এই যে আমাদের এত নাই, এসব কিন্তু আমাদের এই সংবিধানের মধ্যেই আমাদেরকে তারা আটকায়। সাধারণভাবে মনে হয় সরকার আটকায়, পুলিশ আটকায়। কিন্তু সত্যি হলো আমাদেরকে আমাদের সংবিধানই আটকায়। যখন আপনি এসব সরকারকে প্রশ্ন করবেন তারা বলবে দেশ সংবিধানের নিয়ম অনুসারে চলবে। যেমন সরকার বলেছিল সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। তখনই কিন্তু বোঝা যায়, সংবিধান তাকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে যে এই সংবিধান অনুসারে সে নির্বাচন করলে তাকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না।
আমাদের সংবিধানের দুটি অংশ। একটি অংশে আমাদের রাষ্ট্র কেমন হবে সেই বিষয়ে আকাঙ্ক্ষার কথা আছে। আমাদের রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতি আছে। চারটি মূলনীতির একটি হলো গণতন্ত্র। এখন আমাদের মূলনীতি গণতন্ত্র কিন্তু সকল ক্ষমতা একজনের কাছে। তাকে আসলে জবাবদিহি করা যায় না। এখন শুধু নামে গণতন্ত্র রাখলে চলবে? গণতন্ত্র যদি মূলনীতি হয় তাহলে এই ক্ষমতা বাস্তবায়নের জন্য এই যে ইমেজটা আছে তা পরিবর্তন করতে হবে। সাংবিধানিক সংস্কার যদি আমরা সবাই মিলে চাই তাহলেই সংস্কারটা হবে।
আমরা বলি কী কী করলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ক্ষমতা জনগণের কাছে যাবে। সেইগুলো একসাথে পরিবর্তন করাই এখন আমাদের কাজ। এখানে পরিবর্তন করতে প্রথমে জনগণকে চাইতে হবে, তারপর জানতে হবে কীভাবে এই পরিবর্তন করা যায় এবং আরেকটা জিনিস দেখতে হবে তা হলো পরিবর্তন করার পর কীভাবে তা টেকসই করা যায়। এটার জন্য একটা উদাহরণ দেই। সিপিবি একসময় একটা স্লোগান তুলেছিল— ‘‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।’’ এ স্লোগানের জনপ্রিয়তার কারণে শেষ পর্যন্ত সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো সংবিধানে জায়গা পায়। সেটা কিন্তু আদালতে নিয়ে গিয়ে পরে সরকার পরিবর্তন করে ফেলে। তাহলে এতদিনের লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ যে পরিবর্তন এনেছিল তা কিন্তু টিকল না। ফলে মানুষকে জানতে হবে পরিবর্তন কিভাবে করা যায় এবং তা কিভাবে টেকসই করা যায়।
সকাল সন্ধ্যা: এবার আন্দোলনের পর সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের একটি ‘ফ্রেইম ওয়ার্ক’ বা রূপরেখা তৈরির কথা বলেছেন। টাস্কফোর্স তৈরি করে সেই আলোচনার প্রসঙ্গও টেনেছেন। তারপর আলোচনা থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাব নিয়ে একটি ‘সংবিধান সংস্কার সভা’র নির্বাচনের কথা বলেছেন। সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচনটি আসলে কী? এর প্রক্রিয়া যদি ব্যাখ্যা করেন।
হাসনাত কাইয়ুম: আমি একটা কথা বলি যে বাংলাদেশের মানুষ ৫৩ বছর ধরে এক ধরনের নির্বাচন দেখেছে— সংসদীয় নির্বাচন, যাতে যে বেশি আসন পাবে সেই ক্ষমতা পাবে। এটা এক ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি। সংবিধানের আলোকে এখন যারা ক্ষমতায় আসে তারা এই সংবিধান ধরেই কাজ করবে। এদের একটি বড় দায়িত্ব সংবিধান রক্ষা করা। ফলে সে চাইলেই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। সে সবচেয়ে বেশি যেটা করতে পারবে তা হলো সংশোধন করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আছেন, বিচারবিভাগ তার হাতে আছে, আইনবিভাগের প্রধান তিনি। সেখানে ৭০ অনুচ্ছেদে আছে যদি দলের বাইরে কেউ বক্তব্য দেন তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। এরকম পরিবর্তন ভাবলাম আমরা করব। তাহলে কালকে যদি কেউ বলে সংসদে সে সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে এসেছিল। এসে সে এইটা পরিবর্তন করে ফেলেছে। কেউ যদি প্রশ্ন করে আদালতকে। তখন আদালত বলতে বাধ্য হবে যে এটা ভুল হয়েছে। কারণ আদালত শপথ নিয়েছে যে সে এই সংবিধানকে সংরক্ষণ করবে। তাহলে এরকম যখন পরিবর্তনের সময় হয় তখন আসলে সে কী করবে?
একাত্তর সালে আমরা কী করেছি? একটি সংবিধান সভা বানিয়েছি, যাকে আমরা ‘গণপরিষদ’ বলেছি। ব্রিটিশের হাত থেকে যখন পাকিস্তান হয়েছে তখন আমরা একটা ‘গণপরিষদ’ বানিয়েছি। ৭০ সালে যেটা বানানোর দরকার ছিল সেটা আমরা বানিয়েছি ৭১ সালে। ৭০ সালে যখন আইয়ুব খান সরে ইয়াহিয়া এল। তখন আলোচনা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান তো ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসন চাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধানে এরকম তো কোনও সুযোগ নেই। তখন ইয়াহিয়া খান একটি নির্বাচন দিল। সেই নির্বাচনে দুটি দায়িত্ব দিল। একটি হলো, সংসদের যারা সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হবেন তারা প্রথমে বসবেন গণপরিষদের সদস্য হিসেবে। বসে তারা একটি সংবিধান করবে। তারপর এই সংসদ সেই সংবিধানের আলোকে কাজ করবে। তার প্রথম কাজ ছিল সংবিধান করা। সেটার মূলনীতি সে বলে দেবে। সেই মূলনীতির বাইরে যদি এটা যায় তাহলে তা তিনি বাতিল করে দেবে। আমরা এই অভিজ্ঞতাটা মনে রাখার কথা বলছি।
বাংলাদেশে একবার যদি কেউ ক্ষমতায় বসে, তাহলে তাকে ১০-১৫ বছর ক্ষমতা থেকে কেউ সরাতে পারবে না বল বা শক্তি প্রয়োগ না করে। এটাকে বন্ধ করতে হলে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা সংশোধন করতে হবে। আমরা নির্বাচিত সরকারের অধীনে থেকেও দেখেছি। চুরি বাটপারি কিছুই থামানো যায় না। তাহলে এগুলো যে পথ দিয়ে করে সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
এরকম জায়গাগুলো বন্ধের জন্য কী কী পরিবর্তন করা উচিত চিন্তা করেন। সেই পরিবর্তনের সাথে সংবিধানের পরিবর্তন কতখানি যুক্ত চিন্তা করেন। অনেক পরিবর্তন আছে যার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করা লাগবে না। আবার অনেক পরিবর্তন আছে যার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। তা না হলে সেই পরিবর্তন টেকসই হবে না। তাই আমরা বলেছি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গড়ে তাদের মতামত নিন।
আর আমরা বলেছি, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সব মিলিয়ে যাদের অংশীদারত্ব আছে তাদের মত নিন। এটাকে আমরা বলছি গণ-আলোচনা। এই সরকার একটি গণ-আলোচনা করতে পারে। প্রত্যেক সংস্থার কাছ থেকে জানতে চাইতে পারে বাংলাদেশের সংবিধানে আসলে কী পরিবর্তন চান। সেই জায়গা থেকে আমরা বলেছি বিশেষজ্ঞ মত এবং জনগণের মত নিয়ে সেখান থেকে নূন্যতম কমন জায়গাগুলো আপনি বের করেন। এই কমন জায়গাগুলো আপনি যখন বের করতে পারবেন তখন আপনি দেখবেন এতটুকুর ব্যাপারে সবার ঐক্যমত আছে। আপনি তখন বলবেন এই নূন্যতম কমন জায়গাটা আমরা পরিবর্তন চাই। সেটা করার জন্য আপনি একটি ‘সংবিধান সভা’ কিংবা ‘গণপরিষদ’ যাই বলেন না কেন, তাদের একটি নির্বাচন দিবেন। এখানে তারাই বসবে যারা শুধু এই পরিবর্তন করার জন্য একসাথে বসবে। তাদের আর কোনও কাজ নেই। তারা কোনও উন্নয়ন প্রজেক্ট নেবে না, কোনও কিছু করবে না। শুধু এই পরিবর্তন করার জন্য বসবেন। তারপর সে বিষয়ে গণভোটে দিয়ে দিলে সেটা পাস হয়ে যাবে।
সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা। সেই সংবিধানে যেভাবে নির্বাচনের কথা আছে সেভাবে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিয়ে এই সদস্যরা চলে যাবেন।
এটা আমাদের প্রস্তাব। কিন্তু আমাদের প্রস্তাবেই সবার একমত হতে হবে তা প্রয়োজনীয় না। কিন্তু আমরা মনে করি প্রস্তাব আসতে থাকা দরকার। এটা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। এ আলাপ-আলোচনা করা ছাড়া বাংলাদেশ এখান থেকে বের হতে পারবে না।
সকাল সন্ধ্যা: গণতন্ত্র মঞ্চ-এর মোর্চায় থাকা বিভিন্ন সংগঠন সংস্কার নিয়ে আলাপ করে আসছিল। গণ-অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে আপনাদের সংস্কার ধারণার পার্থক্য কতটুকু?
হাসনাত কাইয়ুম: পার্থক্যও আছে মিলও আছে। একটি অভ্যুত্থান মানে বহু মত-পথ এখানে এক হয়েছে। ছাত্রদের মধ্যেই তো বহু মত-পথ আছে। ছাত্রদের মধ্যে যারা সমন্বয়ক সেখানেও তো বহু মতের মানুষ আছে। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের এমন একটা জায়গায় নিয়েছে যেখানে মত-পথের উর্ধ্বে গিয়ে সবাইকে একটি ঐক্যের জায়গায় নিয়েছে। ঐক্যের জায়গায় যদি আমরা বলি, ওদের একটা ঐক্য হয়েছে রেজিম পরিবর্তন করার। সেটা হয়েছে। আরেকটা আকাঙ্ক্ষা তারা যেটা সুন্দর করে বলেছে যে, এই রকমের কেউ যেন আর স্বৈরতন্ত্রী না হতে পারে। স্বৈরাচরী হয়ে ওঠার যে ভিত্তি স্বৈরতন্ত্র, সেটার আসলে পরিবর্তন হতে হবে। এখন স্বৈরতন্ত্রের প্রাণ ভোমরাটা আসলে কোথায় সেটা নিয়ে অনেক মত আছে। এটা তৈরি হয় অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা, বয়সের তীব্রতার কারণে। এরজন্যই তো পার্থক্যটা হয়। এই পার্থক্যটাই একটি সুন্দর সমাজের লক্ষণ। আমার বয়স ৬০ বছরের উপরে। আমি যেভাবে ভাবি সেভাবেই যদি একটা ৩০-এর নিচের যুবক ভাবে তাহলে বাংলাদেশ নিয়ে আশা করার কোনও জায়গা নাই। ওরা যদি আমার সাথে পার্থক্য না করে, ওরা যদি আমাকে ছাড়িয়ে যেতে না চায় তাহলে তো বাংলাদেশ এগোবে না। আমি এগুলোকে এনজয় করি। আমার সাথে যে তরুণদের বা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে যোগাযোগটা হয় সেটা এজন্যেই হয় কারণ আমি ভিন্ন চিন্তাকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি।
তাদের ভিতরে নানান রকমের চিন্তা আছে। তাদের বাহিরেও অনেক চিন্তা আছে। কেউ কেউ মনে করে একটি নতুন সংবিধান লাগবে। কেউ কেউ মনে করে এই সংবিধানে এই সরকারেরই হাত দেওয়ার কোনও জায়গা নেই। আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার পর আমরা করব। সংস্কার তো জনপ্রতিনিধি ছাড়া কেউ করতে পারবে না। একদম পরস্পর বিপরীত চিন্তা আছে। কেউ মনে করছে এটা বিপ্লব, আমরা এর অথরিটি। এখন আমরা সংবিধান বানাব। কেউ কেউ এমনও আছে যে সংবিধানের ড্রাফট করেছে (হেসে)। আমি তাকেও উৎসাহিত করেছি।
আমার আজকের বয়সে এসে যেটা মনে হয়, সংবিধান আর সরকার গঠনের মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। আমি একটা সিম্পল মেজোরিটি হলেই আমি একটা সরকার বানাতে পারি। কিন্তু সংবিধান তো তা না। সংসদের দুই ভাগের তিনভাগ না হলে এটা সংশোধনীও করতে পারে না। ফেলে দেওয়া তো দূরের কথা। আমাদের বুঝতে হবে সংবিধান কি? তা নাহলে আলোচনা আগাবে না। সংবিধান হলো এমন এক জিনিস যে এটার ভিতরে এই ভূ-খণ্ডের প্রত্যেক মানুষের ঐক্যের সূত্র থাকবে। আমি যদি এখন সিম্পল মেজোরিটি দিয়ে আজকে জিতে যাই, আমি এখন আমার মত করে একটি সংবিধান ছাপিয়ে দেই। তাহলে কালকে এই সিম্পল মেজোরিটি উল্টে যেতে পারে। ফলে এদিকেও নজর রাখতে হবে।
৫৩ বছর পর প্রথমবারের মধ্যে সংবিধান নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে। ফলে, যে মনে করে একদম কিছুই পরিবর্তন করা যাবে না, তাকেও আলোচনায় নিতে হবে। এমনকি যারা কালকেই সব পরিবর্তন করে দিতে চায় তাদেরও আলোচনায় আসতে হবে। সবাইকে নিয়েই আলোচনার পরিবেশটা করতে হবে।
যতটুকু পরিবর্তন করতেই আমরা রাজি হই না কেন, প্রথমে আমাদেরকে পদ্ধতিগতভাবে এমন করতে হবে যে এটা যেন টেকসই হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে। আরেকটা হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে। সমাজের যে রাজনৈতিক শক্তি, সামাজিক শক্তি সবার মধ্যে এটা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। গ্রহণযোগ্য না এমন কিছু চাপিয়ে দিলে তা পরেরদিন থাকবে না। উল্টে যাবে পুরোটাই। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন এসে খুব প্রগতিশীল একটি সংবিধান দিয়েছিল। তা কিন্তু টিকে নাই। পিছনে গেছে। এই ব্যাকফায়ার করার আমি বিপক্ষে। আমরা ততটুকু এগোতে চাই যতটুকুতে সবার ঐক্য হয়। আমি ৫ কদম সামনে গেলে তার জন্য যেন দশ কদম পিছাতে না হয়।
তেপান্ন বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা যেন সামনে যেতে পারি, সংকট সমাধান করতে পারি। এভাবেই সংবিধান নিয়ে ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যেতে হবে। সামনে যেন সে আরও মানবিক এবং গণতান্ত্রিক হতে পারে সেদিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
আমি যা চাই তা তো একটি সাম্যের সংবিধান। যা চাব তা তো সব পাব না। কিন্তু যতটুকু পাব তা তো আমি ছাড়তেও চাই না।
সকাল সন্ধ্যা: সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির এতদিনের বাইনারি সিস্টেম ভাঙবে বলে কি আপনার মনে হয়?
হাসনাত কাইয়ুম: এটা একটি সুযোগ। এটাকে আমি গোল্ডেন অপরচুনিটি হিসেবে দেখতে চাই। ছাত্রদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, কারণ ওরা আসলে বাইনারি ভেঙ্গে একসাথে হওয়ার পথ দেখিয়েছে। ছাত্ররা যতটুকু শিখিয়েছে আমাদেরকে আরও বড় করে তা দেখতে হবে। এর বাহিরেও মানুষ আছে। আমি তো চাই আরও বেশি মানুষকে কিভাবে এক জায়গায় নিয়ে আসা যায়। বাংলাদেশ যদি কলোনিয়াল হিস্ট্রি থেকে বের হতে চায়, তার দুর্ভাগ্যকে কবর দিতে চায়, তাহলে বাইনারি বলেন আর যাই বলেন— বাংলাদেশের মানুষকে বিভাজন থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
আমরা লম্বা সময় ধরে এই বাইনারিতেই ছিলাম। আমাদের এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ধরনের সুযোগ সব সময় আসে না। সবাই যেন আমরা একটু সহনশীল হতে পারি। আমাদের চিন্তা হচ্ছে, বাংলাদেশে যারা আছে, সবাইকে সাথে নিয়ে আমরা বাংলাদেশকে সুন্দর করব এই পদ্ধতিতে যেতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা: কেউ কেউ এটিকে বিদেশি শক্তির মদদে হওয়া ‘কালারড রিভোলিউশন’ আখ্যা দিয়ে দেশে চরম ডানপন্থার উত্থানের আশঙ্কা করছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভাস্কর্য ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারক পোড়ানোর ঘটনায় সেই আশঙ্কাটি আরও জোরদার হচ্ছে। আপনারা কী মনে করেন?
হাসনাত কাইয়ুম: এগুলো খুব পুরাতন খেলা। এটা বাইনারিরই আরেকটা পার্ট। আমাদের এখানে নির্বাচনের আগে ৭ তারিখ পর্যন্ত আমরা যারা আন্দোলনে ছিলাম, সেখানে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা এটা প্রতিষ্ঠিত করেছে, এখানে বিদেশি শক্তির সাহায্য ছাড়া শেখ হাসিনার পতন হবে না। এটার একটি ছাপ আছে। কিন্তু এই আন্দোলনের একটি অর্জন হচ্ছে এই মিথটাকে ভাঙতে পারা গেছে। আসলে এটা বাহিরের শক্তি দিয়ে না। বাহিরের শক্তি জানার আগে এখানে ঘটনা ঘটেছে। বাহিরের শক্তি যদি জানতে পারত এখানে ঘটনাগুলো এভাবে ঘটবে তাহলে বরং এটা ঘটানো কঠিন ছিল। ফলে, উল্টোটা যে সত্য তা প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের ছাত্ররা।
যে যা ইচ্ছা বলতে পারে। কারণ পৃথিবী এখন ইন্টারলিংকড। কারও না কারও ইন্টারেস্ট থাকবে। কেউ না কেউ এটাকে সমর্থন করবে। কেউ এটার বিরোধিতা করবে। এটা একটি গ্লোভাল ভিলেজ। এটাকে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নাই। কিন্তু এটা ফ্যাক্টর না। ফ্যাক্টর ছিল আমাদের এখানকার মানুষ। এটা কিন্তু প্রতিষ্ঠিত। এটার জন্য কোনও থিউরি লাগবে না। এটা চোখেই দেখা গেছে। আমরা এটা দেখছি। পরের জেনারেশনের জন্য থিউরি লাগতে পারে কিন্তু আমরা যারা চোখে দেখছি আমাদের জন্য কোনও থিউরি লাগবে না।
মানুষ কিছু সিম্বলকে অ্যাটাক করে। সিম্বলকে অ্যাটাক করার মধ্য দিয়ে সে সেই ফিলোসফিকে অ্যাটাক করতে চায়। এটা সব জায়গায় ঘটেছে। সব সময়ই ঘটেছে। আমাদের দেশে যেটা ঘটে সেটা হলো কম প্রয়োজনীয় বিষয়ে তর্ক বেশি হয়। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা কম হয়, আলোচনায় আনলেও তা রাখা যায় না।
এখানে মিডিয়া, পত্রিকা, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয় যা কিছু চিন্তার পরিসর তৈরি করে—তারা সবার মধ্যে এসব জিনিস ইনজেক্ট করে। ওইভাবে তারা বিষয়গুলোকে উত্থাপন করতে পারে।
জাতীয় সংগীত বা মূর্তি ভাঙা এসবকে আমি হাসিনার পলায়নের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাই না।
এখন পর্যন্ত যারা আহত হয়েছে তারা যেই চিকিৎসা পেতে পারত, সেই চিকিৎসা এখনও পাচ্ছে না। কিন্তু এই বিষয়ে মানুষকে কথা বলতে দেখবেন না। এখানে অনেকে মারা গিয়েছে যারা বাসার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সেই পরিবারগুলোকে আপাতত ছয় মাসের ব্যবস্থা সরকার করবে, তা নিয়ে কিন্তু কেউ আলোচনা করছে না। সরকার কেন এখনও তা করছে না তা নিয়ে তার সমালোচনা কেউ করছে না।
আমি তো বলি, এই সরকার কতদিন বিতর্কের উর্ধ্বে থাকতে পারবে? বিতর্কে পড়ার আগে তো ভালো কাজগুলো করে নিতে হবে।
সংবিধান যারা পরিবর্তনের কথা বলছে না, তাদেরকে আমি বলি সংবিধান শুরু হয়েছে ‘বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহিম’ দিয়ে। আপনি যখনই এই আলোচনা খুলে দিবেন— তখন আপনি একটা বড় অংশ পাবেন, যারা বলবে সংবিধানে কেন এটা থাকতে হবে? আপনি এই আলোচনা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে যাবেন যে, শাসনের অংশে আপনি পৌঁছাতেই পারবেন না। যে ক্ষমতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর কাউকে তোয়াক্কা করা লাগে না, সেই ক্ষমতার জায়গা পর্যন্ত আপনি লোকেটই করতে পারবেন না। তার মধ্যে এই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। মানুষ সরকারের উপর আপত্তি জানাতে থাকবে। আপনার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, শহীদরা যেই সুযোগ দিয়েছে, সেটা আমরা ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলব।
এখন আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে কোন কোন তর্ক আমরা করব, কোনটা করব না। এটা সরকার, রাজনৈতিক দল, চিন্তকদের ভাবতে হবে তারা কোন জিনিসকে অগ্রাধিকার দিবে। তরুণরা এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদেরকেও ভাবতে হবে কোনটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এখন।
সকাল সন্ধ্যা: এইআন্দোলনে সরাসরি গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ছিল না। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তার সঙ্গে এই অভ্যুত্থান ও সরকারের দূরত্ব কতটুকু থাকবে বলে মনে করেন?
হাসনাত কাইয়ুম: প্রথম যেটা তা হলো, অগ্রাধিকারই তো ঠিক হয় নাই। এভাবে বলা উচিত না কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমরা কত সন্তান হারিয়েছি? অন্যদিকে আমরা শনির আখড়ায় কত মানুষ হারিয়েছি? সেই দিকে লক্ষ্য করলেই কিন্তু আমরা বুঝতে পারব কারা যুক্ত হয়েছে আন্দোলনে। তার ক্ষোভের কারণ কি? তার ক্ষোভ তো সংবিধান না। তারা সংবিধান জানেও না। তার ক্ষোভ হচ্ছে তার বাচ্চাকে তো সে খাবার দিতে পারে না। তার যে বাচ্চা, সেখানে যে বৈষম্যের শিকার হয়, তাতে সে অপমানিত হয়। এই অপমানের সে শোধ নিতে পারে না। দারিদ্র্যের কারণে সে তো অপমানিত হয়। চোখের সামনে অন্য একটি মানুষ কাদা ছিটিয়ে চলে যায়। তার সন্তানের জামা কাপড় নষ্ট করে অন্যের সন্তান গাড়ি করে চলে যায়। সে সারাদিন পরিশ্রম করেও এর কোনও সুরাহা করতে পারে না। সেই মানুষগুলোকে তো গুরুত্ব আপনাকে দিতেই হবে। এর জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি সংস্কার প্রয়োজন।
আমরা একটা পোষ্টার করেছিলাম। সেখানে দশ বছরের টাকা পাচারের একটি তালিকা দিয়েছিলাম। এটা আমরা ২০১৮ সালে করেছিলাম। কিন্তু তখন পাচারকে আমরা রাজনৈতিক এজেন্ডা করতে পারি নাই। সবচেয়ে বড় যে ক্রাইসিস তা কেন রাজনীতির এজেন্ডা হয় না? আমরা ওই সময় বলেছিলাম, যে পরিমাণ টাকা গত দশ বছরে পাচার হয়েছে সেটা দিয়ে প্রায় প্রত্যেক ইউনিয়নে একটি করে কারখানা তৈরি করা সম্ভব। এখন যেভাবে আমাদের ছেলেরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে কাজ করতে যায়, গণকবরে পাওয়া যায় তার লাশ; তখন বাহিরের মানুষের তো আমার দেশে এসে কাজ করার কথা।
দেশের মানুষের কর্মসংস্থান করতে হবে, তা নাহলে অর্থনৈতিক মুক্তি হবে না। মেগা প্রজেক্টে টাকা খরচ না করে মানুষের উন্নয়নে টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। এখন পর্যন্ত এই জিনিসগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মাঝে মধ্যে বললেও তা সমানে নিয়ে রাজনীতি করে নাই। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
এই সরকারের থেকে বেশি দায় নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে, যারা ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে লড়াই ঠিকই করেছে কিন্তু এইদিকে আলোকপাত করে নি। এজন্যই প্রথমে চিন্তার সংস্কার লাগবে। সংবিধানের পাশাপাশি আমাদের রাজনীতির সংস্কারও করতে হবে। রাজনীতিকে তার আসল অংশীজনের দিকে তাকাতেই হবে। দেশের শ্রমজীবী মানুষকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। বামরা দেশে দুর্বল হওয়ার পর থেকে আমাদের দেশে এই রাজনীতিটা আড়ালে চলে যাচ্ছে। এটা আসলে খুব দুর্ভাগ্যজনক হবে যারা জীবন দিল তাদের যদি কথা না বলা হয়। তাদের ক্ষোভকে যদি মূল্যায়ন না করা হয়।
সকাল সন্ধ্যা: অন্তবর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য ঠিক কতটা সময় দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
হাসনাত কাইয়ুম: যারা নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের একটি ‘মাইন্ড সেট’ আছে—আগে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোত, তারা এসে নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে চলে যেত। এবারের সরকারটিকে কিন্তু সেই রকম নির্বাচনের সরকার বলা হচ্ছে না। অভ্যুত্থানের কারণে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে। যেখানে ছাত্র-জনতার দাবি হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা করা— যেন আর কোনওদিন একটি স্বৈরতন্ত্র এখানে না হতে পারে। তারা বলছে, সংবিধানের একটি সংস্কার করতে হবে যাতে কেউ নিজের মতো ক্ষমতা চর্চা না করতে পারেন।
কিন্তু এই সরকার আসলে কী করবে তা দেখতে হবে আমাদের। তার অগ্রাধিকার কী? তখন একে ঠিক মতো বিচার করা যাবে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে যদি সরকারের কাজ মিলে তাহলে মানুষ তাকে একটু সময় দিবে। মানুষ যদি দেখে সে এগুলোও করছে না, সে নির্বাচনও করছে না, সে শুধু দৈনন্দিন কাজ করে যাচ্ছে। তাহলে মানুষ তো তখন প্রশ্ন করবেই।
আমরা এমন সুযোগ আর পাব না। আমরা ১৯৭১, ১৯৯০ সালে পারি নাই। এখন ২০২৪-এও যদি না পারি তাহলে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হবে। সেজন্য আমি চাই এই সরকার কোনওভাবেই যেন বিতর্কিত না হয়। তারা যেন দক্ষতার সাথে তাদের কাজটা ক্লিয়ার করে মানুষের সামনে। করতে গিয়ে যদি তার সময় বেশি লাগে মানুষ তাকে সেই সুযোগ দিবে। কাজ না করে যদি তারা বসে থাকে তাহলে তারা প্রশ্নের মুখে পড়বে। এটা মাথায় রাখতে হবে প্রশ্নের মুখে কোনও ভালো কাজই ভালো থাকে না।
সকাল সন্ধ্যা: আন্দোলনের শেষদিকে একটি বড় অংশের কওমী জনগোষ্ঠী ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমর্থকদেরও মাঠে নামতে দেখা গিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সংস্কারের আকাঙক্ষার পার্থক্য কতটুকু? চিন্তার জগতে যে ফাঁকটুকু রয়েছে তা কীভাবে দূর করা যেতে পারে?
হাসনাত কাইয়ুম: আমাদের আসলে দেখতে হবে বির্তকটা কোথায় শুরু হয়। আদর্শিক জায়গাতেই তো শুরু হয় বিতর্ক। ধরেন, একদল বলবে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম থাকতে হবে, আবার আরেক অংশ এসে বলবে সেক্যুলারিজমের যে ব্যাখ্যা শেখ মুজিব দিয়েছে তা আসলে সেক্যুলারিজমের ব্যাখ্যা হয় নাই— এটা আসলে জোড়াতালি দেওয়া। এসব বিতর্ক মতাদর্শিক বিতর্ক।
আপনি সেক্যুলার হোন বা সেক্যুলার না হোন; সবার কিন্তু শিক্ষার পর কর্মসংস্থানের দাবিটা আছেই। তার মা-বাবার চিকিৎসার সুযোগের দাবি আছে। তার প্রত্যেক পাঁচ বছর পর ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। তাকে পুলিশ বাসা থেকে ধরে এনে দুটি পুড়িয়া দেওয়া মামলা দিবে, সে সেই মামলায় সে কোনও বিচার পাবে না— এর থেকে মুক্তির ইচ্ছা তার আছে। সে ‘শিবির করে’ বলে একটি কওমি মাদ্রাসার ছেলেকে তুলে নিয়ে যাবেন এই দুঃশাসন থেকে মুক্তি সে চায়। আবার কাউকে আপনি নাস্তিক বলে কুপিয়ে মেরে ফেলবেন এ থেকেও মানুষ মুক্তি চায়। এগুলো কিন্তু সবই ক্ষমতার কাঠামো থেকে হয়। এগুলো সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ বা ‘সেক্যুলারিজম’-এর জায়গা থেকে হয় না। এগুলো যে রাষ্ট্র অগণতান্ত্রিক চর্চা করে সে জায়গা থেকে হয়। এই বিষয়ের সমাধানে আপনি কিন্তু জাতির মধ্যে ঐক্য গঠন করতে পারবেন। এই অভ্যুত্থান যেমন কয়েক দিনের জন্য প্রচলিত বাইনারি ভেঙ্গে দিয়েছিল তেমিন আমরা এই সমস্যাগুলো যখন সমাধান করব তখন দেখবেন আবার মানুষের ঐক্য হবে।
আমি যখন সরকারকে এসব ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে পারব তখন দেখবেন এসব মতাদর্শিক দ্বন্দ্বসহ আমরা সমাজে একসাথে থাকতে পারব। আমি তাই বলি, বিভাজনের জায়গা থেকে আপনি ঐক্যটা করতে পারবেন না, ঐক্যের জায়গা থেকে ঐক্যটাকে বিস্তৃত করার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের একজনের থেকে আরেকজনের পার্থক্য খুঁজে বের করার থেকেও আমাদের যা খুঁজে বের করতে হবে তা হলো—আমাদের ঐক্যটা কোথায়।
সকাল সন্ধ্যা: বাংলাদেশের সনাতনধর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় কোনও বিশেষ আইন রাখা সংস্কার প্রক্রিয়ায় থাকা উচিত বলে মনে করেন কি না?
হাসনাত কাইয়ুম: আমরা যদি একটি গণতান্ত্রিক দেশ বানাতে পারি, যেখানে কেউ ক্ষমতার ভুল ব্যবহার করতে পারবে না, যেই কাঠামো এই ক্ষমতা তৈরি করে তাকে যদি বাদ দিতে পারি, তাহলেই অনেক কিছু মিটে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতা ভোগ করে একটি সরকার এবং সরকারের যেই ক্ষমতা তা ভোগ করে একটি দল এবং তার নেতারা। রাষ্ট্র, সরকার, সরকারী দলের মধ্যে আমাদের পার্থক্য করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকারকে শর্তমুক্ত করতে হবে।
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো—মাইনোরিটির রাইট নিশ্চিত করতে মেজেরিটি দিয়ে শাসিত হওয়া। এই গণতন্ত্র যদি আমরা তৈরি করতে পারি তাহলে আলাদা কোনও আইনের তো প্রয়োজন নাই। আর এটা যদি আমরা না করতে পারি তাহলে আরও অনেক আইন বানাবো কিন্তু সেই আইন কেউ মানবে না। আমাদের সময় এসেছে বাংলাদেশকে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করার।
সকাল সন্ধ্যা: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
হাসনাত কাইয়ুম: আপনাকেও ধন্যবাদ।