স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নানা প্রকারের উদ্বেগ-দ্বিধা-সন্দেহ উপেক্ষা করেই তরুণদের মধ্যে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে ‘ওয়েলনেস ভেপিং’। নিকোটিন আছে এমন তরলের বদলে ভিটামিন বা অন্যান্য পরিপূরক এবং বলদায়ক তরল ডিভাইসের মাধ্যমে ভাপ বা বাষ্প নিঃশ্বাসে গ্রহণই ‘ওয়েলনেস ভেপিং’।
এ ধরনের ভেপিং এর মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি ভিটামিস বি ১২, ক্যাফেইন, মেলাটোনিন বা শরীরের জন্য ভালো সাপ্লিমেন্টগুলো গ্রহণ করেন। ঝলমলে প্যাকেজিং এবং আকর্ষণীয় ট্যাগ লাইন এগুলোকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে।
বিশেষ করে সিগারেট কিংবা নিকোটিন টানার অনুকরণে একই পদ্ধতিতে কেউ যখন ‘নিঃশ্বাসে সুস্বাস্থ্য’- এর প্রতিশ্রুতি দেয় তখন তা চিত্তাকর্ষক তো বটেই! একজন ধুমপায়ী যখন জানতে পারেন, যে ভ্যাপিংয়ে নিকোটিন বা সিগারেট টানার অভ্যাসের কারণে তিনি ভৎর্সনা ও স্বাস্থ্যগত সংকটের শিকার হতেন, সেই একই পদ্ধতিতে সুস্বাস্থ্যের বাষ্প সেবন করে তিনি প্রশংসিত হবেন- কার না ভাল লাগবে!
ভেপিং ও ওয়েলনেস ভেপিং এর ইতিহাস
ভেপিং এর শুরুটা ২০০০ সালের দিকে। প্রথম ই-সিগারেট অবশ্য আরও পরে ২০০৩ সালে চীনা ফার্মাসিস্ট হন লিক তৈরি করেন। এটি বাজারে আসে পরের বছর। এর বাইরে অবশ্য ই-সিগারেটের কনসেপ্ট ছিল ১৯২৭ সাল থেকেই। জোশেফ রবিনসন নামের এক ব্যক্তি এটি পেটেন্ট করেছিলেন। কিন্তু সেই ডিভাইসের কোনও নমুনা তৈরি করা হয়েছিল কিনা তাও আজ পরিষ্কার নয়। এদিকে ১৯৬০ সালে হার্বার্ট এ গিলবার্ট নামের আরেকজন ব্যক্তিকে ই-সিগারেট ডিভাইসের জনক বলে মনে করা হয়। কিন্তু তিনি আসলে তার যন্ত্রে আগ্রহী বিনিয়োগকারী সেইসময় পাননি।
অবশেষে হন লিকের হাতেই ই-সিগারেটের সফলতার শিকে ছিঁড়ে। নিজের বাবার ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুতে বিচলিত হয়ে বিকল্প হিসেবে ই-সিগারেট আবিষ্কার করেন তিনি। হন লিক নিজেও একজন স্মোকার। সম্ভবত বাবার শেষ অবস্থা দেখে হন লিক কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, ধুমপায়ীরা খুব সহজে নিজেদের প্রিয় ও ক্ষতিকর এ অভ্যাসটি ছাড়তে পারেন না। কাজেই সিগারেটের মতোই ছিল ই-সিগারেটের চেহারা।
২০০৪ সালে চীনের বাজারের পর হন লিকের ই-সিগারেট ২০০৬-০৭ সালের মধ্যে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জায়গা করে নেয়। ২০১০ সালে এরই ধারাবাহিকতায় চালু হয় ওয়েলনেস ভেপিং। তবে আটঘাঁট বেঁধে বড় কোম্পানিগুলো এ পণ্য বাজারজাতের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও পরে।
ভেপিং এর বাজার
বিশ্বব্যাপী ভেপিং এবং ই সিগারেটের বাজার উল্লেখযোগ্যভাবে এ বছরের শেষ নাগাদ বাড়বে বলে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সচেতনতায় সিগারেট বা ধুমপান ত্যাগের ওপর জোর দিয়ে নানা প্রচারণা এবং বিভিন্ন দেশের সরকারের কড়া অবস্থান ভেপিং বা ই-সিগারেটে মানুষকে আকৃষ্ট করছে। তামাকজাত পণ্যের দাম বৃদ্ধি তাতে রেখেছে রকেটের মতো ভূমিকা। ২০২৩ সালে ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং এর বাজার ছিল ২ হাজার ৭৮০ কোটি ডলারের। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ চক্রবৃদ্ধি হারে এই বাজার বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ হাজার ২৮০ কোটি ডলারে।
তামাকজাত পণ্য উৎপাদনের জন্য জুল ল্যাব, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ফিলিপ মরিস ভেপিং এর বাজার বাড়াতে নতুন নতুন প্রযুক্তি পণ্যের দিকে ঝুঁকেছে। নতুন নতুন পণ্য দিয়ে তারা আরও বাজার তৈরির প্রক্রিয়াতেও রয়েছে।
ভেপিং জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি কারণ কোম্পানিগুলো তরল নিকোটিনে নানা স্বাদ যুক্ত করতে পারছে। আবার ডিভাইসে ধোঁয়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের অপশনও থাকছে। এখন পর্যন্ত ভ্যাপিং এর বাজার মূলত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে থাকলেও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় ই-কমার্সের কারণে খুব দ্রুতই এটি জনপ্রিয় হচ্ছে।
ওয়েলনেস ভেপিং মার্কেটে বর্তমানে বেশ কিছু বড় প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যাদের প্রত্যেকেরই নিকোটিন-মুক্ত, ইনহেলেবল ওয়েলনেস পণ্যের বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্র । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্র্যান্ড হলো ব্রিদ (Breathe), ভিটাসিগ (VitaCig) এবং মঙ্ক (Monq)। এসব প্রতিষ্ঠান যারা অ্যারোমাথেরাপি বা ভিটামিন-সমৃদ্ধ ভ্যাপিং পণ্য উৎপাদন করে।
প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য ব্যবহারে সুস্বাস্থ্য লাভের উপায়ের পাশাপাশি এবং মানসিক চাপ কমানো, মনোযোগ বৃদ্ধি বা শক্তি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হেলথভাইব (HealthVape)। যারা বিশেষ করে ভিটামিন বাজারে মনোযোগ দিয়েছে এবং ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ ডিভাইস সরবরাহ করে স্বাস্থ্য-সচেতন ক্রেতাদের আকর্ষণ করছে।
ক্যান্ডিপেনস (Kandypens) এবং ক্লাউডি (Cloudy) এই দুই ব্র্যান্ডও ওয়েলনেস ভেপিংয়ে প্রসিদ্ধ। এদের ভেপ পণ্য মূলত রিলাক্সেশন এবং ভালো ঘুমের প্রতিশ্রুতি দেয়। ভ্যাপকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাস্টমাইজড পণ্য উৎপাদনেও মনোযোগ দিয়েছে।
ওয়েলনেস ভেপ আসলে কতোটা ভালো
ওয়েলনেস ভেপের সংখ্যা এবং প্রকারভেদ প্রতিনিয়ত বাড়লেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ‘সুস্থতার দাবি’ গ্রহণের প্রচারণার সঙ্গে পুরোপুরি বিরুদ্ধ মতই পোষণ করছেন।
ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টার মেডিক্যাল সেন্টারের অধ্যাপক ও ইনহেলেশন অ্যান্ড ফ্লেভারিং টক্সিকোলজি রিসার্চের পরিচালক ইরফান রহমানের মতে , “ভেপগুলি প্রায় তিন বা চার বছর আগে বাজারে এসেছিল এবং ক্রমাগত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।”
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ৬ হাজার জনের ওপর চালানো এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে ৪ শতাংশ অল্প বয়স্ক কিশোর এবং ২৪ শতাংশ তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা নন-নিকোটিন ভেপ পণ্য ব্যবহার করেছে, তাদের প্রায় এক চতুর্থাংশ জানতেনই না ভেপের তরল পণ্যে আসলে কী উপাদান ছিল।
মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষও স্বাস্থ্য সুরক্ষাকারী ভেপ শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে বলে মনে করছে।
২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে তারা বলেন, “নিঃশ্বাসে নেওয়া ভেপের বাষ্প বিপজ্জনক হতে পারে এবং এমনকি গুরুতর কাশির কারণ হতে পারে, শ্বাসনালী শক্ত হয়ে যেতে পারে এবং কথা বলা এবং শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে।”
১৯৬৭ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভিটামিন বি বাষ্পীভুতভাবে গ্রহণ করলে কোনও লাভই হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সাপ্লিমেন্ট তাপে বাষ্পীভুত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ই-সিগারেটের সাথে সম্পর্কিত বেশিরভাগ মৃত্যুর কারণ হিসেবে ভিটামিন ই অ্যাসিটেটকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই রাসায়নিক পদার্থটি অনেক ই-লিকুইডে থাকে এবং এটি ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ওয়েলনেস ভেপিং আসলে ধুমপানের বিকল্প হিসেবে সুস্বাস্থ্যের প্রচারণা চালালেও এটি ক্ষতিকর। বিভিন্ন দেশে নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়ছে। আর তাই ২০২৪ সালে এটি যতই ট্রেন্ড হিসেবে দাঁড়াক না কেন, অচিরেই বিভিন্ন দেশের সরকারের কঠোর নীতির আওতায় এটি মাদকের মতো ‘নিষিদ্ধ তালিকা’য় যাওয়াটা বিচিত্র নয়! আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেকক্ষেত্রেই ধুমপায়ীরা সিগারেট বা তামাকের নেশা ছাড়ার রাস্তা হিসেবে ওয়েলনেস ভেপিং বেছে নিলেও, বাস্তবে দেখা যায় তাা দুটোতেই আসক্ত হয়ে গিয়েছেন, ঠিক ই-সিগারেটের উদ্ভাবক হান লিকের মতোই!