Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

ইন্টারপোলের রেড নোটিসের অর্থ কী

red notice
[publishpress_authors_box]

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিস’ জারি করতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছে।

বিদেশে পলাতক ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিনটি ধাপে আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।

আদালত, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) অথবা তদন্ত সংস্থার অনুরোধে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারির আবেদন করে থাকে।

এই ১২ জনের অধিকাংশই সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। তাদের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের মামলায় আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। বাকী ১১ জনের মধ্যে বেনজীর ছাড়া অন্যদের গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারির আবেদন করা হয় গত ১০ এপ্রিল।

এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসছে, ইন্টারপোল কি পদক্ষেপ নিতে পারে রেড নোটিশের ব্যাপারে। সংস্থাটি কি গ্রেপ্তার করতে পারে? আর রেড নোটিসের মানেই বা কী?

ইন্টারপোল কী

ইন্টারপোল (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন) হলো একটি আন্তঃদেশীয় পুলিশ সংস্থা। এটি ১৯৬টি সদস্য দেশের মধ্যে পুলিশি সহযোগিতা সহজতর করে।

আধুনিক সময়ে অপরাধ সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে ইন্টারপোলের মূল লক্ষ্য হলো—বিভিন্ন দেশের পুলিশ বাহিনীকে একত্রে কাজ করার সুযোগ করে দিয়ে বৈশ্বিক নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করা।

ইন্টারপোলের প্রধান কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করে জেনারেল সেক্রেটারিয়েট। এর প্রধান দপ্তর ফ্রান্সের লিয়ঁ শহরে। এছাড়া সিঙ্গাপুরে একটি গ্লোবাল ইনোভেশন কমপ্লেক্স এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্যাটেলাইট অফিস আছে।

জেনারেল সেক্রেটারিয়েটের নেতৃত্ব দেন সেক্রেটারি জেনারেল। এই দপ্তরে পুলিশ কর্মকর্তা ও বেসামরিক কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল কাজ করে। তারা প্রতিদিনের কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং বিভিন্ন অপরাধ মোকাবেলায় নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেন।

প্রতিটি সদস্য দেশে একটি করে ইন্টারপোল ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) থাকে। এই অফিস সাধারণত দেশের পুলিশের সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এটি জেনারেল সেক্রেটারিয়েট ও অন্যান্য সদস্য দেশের এনসিবির সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ ‍পুলিশেও এমন ইউনিট রয়েছে।

বৈশ্বিক যোগাযোগ

ইন্টারপোল একটি নিরাপদ বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান সহজ করে তোলে। এই নেটওয়ার্কের নাম ‘I-24/7’। এর মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো যেকোনো সময়, কেন্দ্র বা দূরবর্তী স্থান থেকে ইন্টারপোলের ডাটাবেইজ ও অন্যান্য সম্পদে সরাসরি প্রবেশাধিকার পায়।

এই ব্যবস্থা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং অপরাধী ও অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় করতে সক্ষম করে। ফলে আন্তর্জাতিক তদন্ত আরও কার্যকর হয়।

ইন্টারপোলের কাজ মূলত চারটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রকে ঘিরে পরিচালিত হয়। এই চারটি ক্ষেত্র হলো: সন্ত্রাসবাদ, সাইবার অপরাধ, সংগঠিত অপরাধ ও আর্থিক অপরাধ, যার সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমও যুক্ত রয়েছে।

এই ক্ষেত্রে নিয়োজিত বিশেষজ্ঞরা সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে সরেজমিন অভিযান, তদন্তে সহায়তা প্রদান এবং কৌশলভিত্তিক যোগাযোগ ও সহযোগিতা গড়ে তোলা।

অপরাধ প্রতিনিয়ত নতুন রূপ নিচ্ছে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখে ইন্টারপোল গবেষণা ও উন্নয়নের ওপরও গুরুত্ব দেয়, যাতে উদীয়মান অপরাধ প্রবণতার আগেই তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া যায়।

এছাড়া ইন্টারপোল বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এসব বিশেষজ্ঞরা কর্মপরিষদ ও সম্মেলনে একত্রিত হন এবং অপরাধ দমন কৌশল, অভিজ্ঞতা ও সফল পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা ও ভাগাভাগি করেন।

রেড নোটিসের কী অর্থ

ইন্টারপোল রেড নোটিস নিয়ে সবচেয়ে সাধারণ ভুল ধারণা হলো, এগুলোকে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মনে করা। আসলে এগুলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নয়। 

ইন্টারপোল হলো ১৯৪টি সদস্য দেশের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বব্যাপী পুলিশি সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য এটি তৈরি হয়েছে।

ইন্টারপোলের নিজস্বভাবে কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করার ক্ষমতা নেই।

তবে ইন্টারপোল একটি আন্তর্জাতিক নোটিস ব্যবস্থার সমন্বয় করে। এর মাধ্যমে সদস্য দেশগুলোর পুলিশ একে অন্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। এই ব্যবস্থার অংশ হিসেবেই ইন্টারপোল রেড নোটিস জারি করে।

রেড নোটিস আসলে একটি অনুরোধ। এটি একটি সদস্য দেশ এজন্য করে থাকে যে সে চায় অন্য দেশগুলো তাকে একজন অপরাধীর অবস্থান খুঁজে পেতে এবং তাকে গ্রেপ্তার করতে সহায়তা করুক। যাতে ওই অপরাধীকে ফিরিয়ে নিয়ে বিচার করা যায়।

রেড নোটিস এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রয়োগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে এমন ১৩ হাজার ৪৮টি রেড নোটিস জারি করা হয়েছিল।

ইন্টারপোল রেড নোটিস প্রকাশ করে ছড়িয়ে দিলেও এই ব্যবস্থাটি সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছাসেবাভিত্তিক। কোনও দেশ রেড নোটিসের ভিত্তিতে কাউকে গ্রেপ্তার করতে আইনত বাধ্য নয়। ইন্টারপোল নিজেই বলে, প্রতিটি সদস্য দেশ রেড নোটিসকে তাদের দেশের আইনে কীভাবে মূল্যায়ন করবে, তা তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়।

রেড নোটিস প্রকাশের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত থাকে। ইন্টারপোলের সংবিধান অনুযায়ী, সংস্থাটি কোনও রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় বা বর্ণগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটি ‘সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের’ আদর্শ অনুসরণ করেই কাজ করে।

এ কারণে ইন্টারপোলের উচিত নয় এমন কোনো রেড নোটিশ প্রকাশ করা যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কিংবা যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের শর্ত লঙ্ঘন করে।

শরণার্থীর ক্ষেত্রে রেড নোটিস

রেড নোটিস ব্যবস্থার অপব্যবহার করে শরণার্থীদের টার্গেট করার প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। বিগত সময়ে বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা এর প্রমাণ। এর মধ্যে আছে রাশিয়ান কর্মী পেত্র সিলায়েভের স্পেনে গ্রেপ্তার ও আটক, ভারতীয় শরণার্থী পরমজিত সিং সাইনির পর্তুগালে আটক এবং আলজেরিয়ার মানবাধিকার আইনজীবী রাশিদ মেসলির ইতালিতে গ্রেপ্তার।

এই উদ্বেগ কমাতে ইন্টারপোল কয়েকটি সংস্কার এনেছে। ২০১৫ সালে একটি নতুন শরণার্থী নীতি চালু করা হয়। এই নীতির মূল কথা হলো, কোনও শরণার্থী যার দেশ থেকে সে পালিয়ে এসেছে, সে দেশ যদি রেড নোটিসের অনুরোধ করে, তাহলে ইন্টারপোল সে নোটিস ইস্যু করবে না।

মূল সমস্যা হলো, এই শরণার্থী নীতি বাস্তবায়নে জটিলতা রয়েছে। ইন্টারপোল রেড নোটিস প্রকাশের আগে অনুরোধগুলো যাচাই করে। কিন্তু ইন্টারপোলের সদস্য দেশগুলোর কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শরণার্থী পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার সুযোগ নেই। গোপনীয়তার কারণে এটি হওয়া উচিৎও নয়।

এছাড়া অনেক সময় কোনও দেশে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় থাকে না। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে রেড নোটিস নিয়ে কাজ করা আইন কর্মকর্তারা শরণার্থী পরিচয় সম্পর্কে তথ্য জানতে পারেন না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত