ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাল্টা জবাব কীভাবে দেবে, তা ঠিক করে উঠতে পারছে না ইসরায়েল। দেশটির যুদ্ধ মন্ত্রিসভা বৈঠকে বসেও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।
ইসরায়েলের মিত্ররাও তাকে ইরানে হামলা না করে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এতে উভয় সংকটে পড়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই ধ্বংস করেছে তাদেরই মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডান। বাকিটা ধ্বংস করেছে ইসরায়েলের নিজস্ব আয়রন ডোম মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
অবশ্য ইসরায়েলের এমন দাবির পক্ষে কোনও বিবৃতি কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও জর্ডান দেয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল এমন দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য মিত্রদের ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামাতে চাইছে। ইরানকে প্রতিহত করা যে কোনও ব্যাপার না, তা প্রমাণেই ইসরায়েল ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের কৃতিত্ব তার মিত্রদের দিচ্ছে।
তবে পশ্চিমা কূটনীতিকরা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নেতানিয়াহুকে জানিয়েছেন, তারা আর ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক কোনও পদক্ষেপকে সমর্থন করবেন না।
কিছু বিশ্লেষক অবশ্য মনে করেন, ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে নামানোর কৌশল হিসেবেই সেদিন ইরান হামলা চালিয়েছে।
১ এপ্রিলেই কী ঘটনার সূত্রপাত
ইসরায়েল কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে, তা নির্ধারণে বিশ্লেষকরা ১ এপ্রিল ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলার ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছেন।
একজন বিশ্লেষক আল জাজিরাকে জানান, এপ্রিলের ওই হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভুলেশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) দুই জেনারেল ও পাঁচ অফিসার নিহত হয়েছিল। এই হামলা প্রসঙ্গে ইসরায়েলের মিত্ররা তেমন কিছু জানত না। হামলার কিছুক্ষণ আগে তাদের জানানো হয়েছিল।
জার্মান ইনিস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল আন্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের ফেলো হামিদ রেজা আজিজি। তিনি ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তার মতে, প্রথমত কোনও পরিণতির কথা চিন্তা না করেই ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করেছে। আর দ্বিতীয়ত, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানকে আঞ্চলিক যুদ্ধে টেনে আনা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নজর গাজা থেকে সরানো।
উভয় পরিস্থিতিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
সন্দেহাতীতভাবেই ইসরায়েল একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি। গাজায় গত ছয় মাস ধরে চলমান যুদ্ধে দেশটিকে তার সামরিক শক্তির অনেকটাই দেখাতে হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে ইরানের ৫ লাখ ৮০ হাজার সেনার বিরুদ্ধে দেশটির টেকার সুযোগ খুব কম। কারণ ইসরায়েল চাইলেও একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে পারবে না। ইরানের ওই বিশাল বাহিনীর মধ্যে দুই লাখই প্রশিক্ষিত রিজার্ভ বাহিনী। তারা দেশটির সেনাবাহিনী ও আইআরজিসির মধ্যে থেকেই কাজ করে।
চ্যাথাম হাউজের সহকারী ফেলো নমি বার ইয়াকুব বলেন, “নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা পরিষ্কার। তিনি গাজা যুদ্ধ থেকে নজর ঘুরিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যপ্রাচ্যে টেনে আনতে চাইছেন।
“ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। তারপরেও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার উপর নির্ভরশীল ইসরায়েলের উচিত ছিল ইরানি কনস্যুলেটে হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে ওয়াশিংটনকে জানানো। কারণ ওই কনস্যুলেটে তখন আইআরজিসির সদস্যরা ছিল।
“এটা না করে ইসরায়েল তার সীমা অতিক্রম করেছে। ইসরায়েলের এই উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন করা উচিৎ। একটি বিদেশি কনস্যুলেটে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আর নেতানিয়াহু স্পষ্টই জানতেন যে তিনি সীমা অতিক্রম করছেন এবং ইরান তার সর্বশক্তি দিয়ে এর প্রতিক্রিয়া জানাবে।”
কয়েক বছর ধরেই ইরান তার ছায়াসঙ্গীদের দিয়ে ইসরায়েলকে চাপে রেখেছে। এই সঙ্গীদের মধ্যে শুধু লেবাননের হিজবুল্লাই রয়েছে এমন নয়। আছে আরও অনেক পক্ষ। এসব পক্ষগুলোর মধ্যে হিজবুল্লাহই একমাত্র গত ৭ অক্টোবরের আগে থেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন সময় গুলি বিনিময় করে আসছে।
লক্ষ্যে স্থির
বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহু শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের ময়দানে নামাতে ইরানের কনস্যুলেটে হামলা করেননি। এর পেছনে তার আরও গভীর অভিসন্ধি রয়েছে।
একাধিক জনমত জরিপ বলছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা তলানিতে পৌঁছেছে। তিনি ইসরায়েলিদের সামনের নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, তিনি ও তার লিকুদ পার্টিই ইসরায়েলিদের পরম বন্ধু। কিন্তু গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর এই ধারণা ভেঙে যায়।
কার্নেগি এনডওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড দ্য রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষক হলেন এইচ এ হেলিয়ার।
তার মতে, “ইরানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল কীভাবে পশ্চিমা সহানুভূতির সুবিধা নেবে, এর উপর নির্ভর করছে অভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতানিয়াহুর গুরুত্ব।”
ইসরায়েলের চরম ডানপন্থীরা দেশটির স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করায় গত অক্টোবর পর্যন্ত নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। এরপর ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে সাধারণ ইসরায়েলিরাও রাস্তায় নামে। তাদের অভিযোগ, নেতানিয়াহু হামাসের হামলা ঠেকাতে এবং জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে পারেননি।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও নেতানিয়াহুর প্রতি ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। ইসরায়েলের যুদ্ধ মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গানৎসকে ওয়াশিংটন ডিসিতে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।
নেতানিয়াহু তার হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারে কাজ করছেন। এজন্য তিনি প্রত্যেকটি সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তিনি দেশবাসীকে যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন, যাতে জনগণ গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান না জানায়।
গুরুত্বপূর্ণ মোড়
ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষকে এমনভাবে চিত্রিত করতে চাইছে যে, এসবই আসলে যুক্তরাষ্ট্রেরই মঞ্চস্থ করা নাটক।
ফেলো হামিদ রেজা আজিজি বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত যা শুনেছি তা হলো – যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ নেই। তবে দেশটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পশ্চিমারা একজোট হয়ে কূটনৈতিকভাবে ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাবে। আর এই প্রতিক্রিয়ার মূল বার্তাই হবে সংযম।”
আর এমনটা হলে নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে, মনে করছেন অনেকে।
বার ইয়াকুবের মতে, “আমরা পুরো ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি। কূটনৈতিকভাবেই একমাত্র এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেকোনও ধরনের সামরিক প্রতিক্রিয়া আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে।”
কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েল অতীতের মতোই আচরণ করছে। এর আগের বিভিন্ন ঘটনার মতো এবারও দেশটি ইরানের হামলার পরই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানায়। ইসরায়েলই পুরো ঘটনার সূত্রপাত করেছে। তা স্বত্ত্বেও দেশটি চাইছে তার পেছনেই দাড়াক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
নেতানিয়াহুর জন্য বিপদ এখন উভয় দিকেই। ইরানের হামলার বিপরীতে ইসরায়েল এখন কোনও সামরিক প্রতিক্রিয়া না জানালে নেতানিয়াহুর সমর্থন আরও কমবে। আবার হামলা করলেও তার প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন কমবে।
এবিষয়ে হেলিয়ার বলেন, “নেতানিয়াহু যদি বুঝতে পারেন যে, ওয়াশিংটন ডিসি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে, সেক্ষেত্রে তিনি বিকল্প হিসেবে ইরানের ছায়াসঙ্গীদের ওপর হামলা চালাতে পারেন।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা।