ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ অভিযান চালানোর তিন বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনা চলছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও চান যুদ্ধবিরতি। তবে এজন্য তিনি দিয়েছেন কঠোর সব শর্ত।
পুতিন গত বৃহস্পতিবার জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির ধারণাকে সমর্থন করেন। ইউক্রেনও এতে সম্মতি দিয়েছে। তবে দীর্ঘ যুদ্ধক্ষেত্রজুড়ে এই বিরতি নিশ্চিত করা কঠিন হবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন পুতিন।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান না করে রাশিয়া দীর্ঘ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছে বলে মনে করছেন অনেকে।
পুতিন আরও বলেন, ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিকে ইউক্রেন শক্তি সংগ্রহ ও নতুন অস্ত্র সংগ্রহের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তাই তিনি নিজেও কিছু শর্ত চাপানোর কথা ভাবছেন। এর মধ্যে থাকতে পারে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করা বা ইউক্রেনের সেনা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা।
তবে মস্কোর এসব দাবি ইউক্রেন বা তার মিত্রদের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।
ভূখণ্ড
তিন বছর পর রাশিয়া এখন ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা এই ভূখণ্ড ধরে রাখতে চায় এবং আরও দখল করতে পারে। ক্রেমলিন দখলকৃত কোনও ভূখণ্ড ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করেছে।
বৃহস্পতিবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “ক্রিমিয়া, সেভাস্তোপোল, খেরসন, জাপোরিঝিয়া, দনেৎস্ক ও লুহানস্ক—এগুলো রাশিয়ার অংশ। এগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি একটি স্থির সত্য।”
রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ও সেভাস্তোপোল দখল করে। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে এটি এখনও ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। ২০২২ সালে তারা অন্য অঞ্চলগুলোও বেআইনিভাবে দখল করে।
গত জুনে পুতিন বলেন, ইউক্রেন চারটি দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল রাশিয়াকে ছেড়ে দিয়ে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করলে রাশিয়া সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করবে। তিনি চান, দখল করা ভূখণ্ডকে বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অনেকদিন ধরে বলে আসছেন, তারা নিজেদের সার্বভৌম ভূখণ্ড ছাড়বে না। তবে সম্প্রতি তিনি ভূখণ্ড ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন।
রাশিয়ার শর্তগুলোর মধ্যে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ছোট করা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমনটা হলে দেশটিকে ভবিষ্যতে যেকোনো হামলা প্রতিরোধ করতে পারবে না।
ন্যাটো শান্তিরক্ষী
পুতিন ইউক্রেনে তার আক্রমণের পক্ষে যুক্তি দেখাতে ন্যাটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) সম্ভাব্য সম্প্রসারণের কথা উল্লেখ করেছেন। ন্যাটো একটি প্রতিরক্ষা জোট। এর সদস্য দেশগুলো একে অপরকে আক্রমণের ক্ষেত্রে সহায়তা করার অঙ্গীকার করে। ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পুতিনের জন্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ন্যাটোতে যোগদানকে দেশের নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্যারান্টি হিসেবে দেখেন।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেছিলেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ একটি ‘বাস্তবসম্মত ফলাফল’ নয়। পরে তিনি এ সম্ভাবনা পুরোপুরি বাদ না দিলেও বলেছেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে সদস্যপদ সম্ভবত হবে না।
যুদ্ধ শুরুর আগের তুলনায় ন্যাটো এখন আরও বড় হয়েছে। কারণ সুইডেন ও ফিনল্যান্ড এতে যোগ দিয়েছে। তবে ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো প্রতি প্রতিশ্রুতিকে নিয়ে ক্রমশ প্রশ্ন উঠেছে।
২০২৪ সালের রাষ্ট্রীয় ভাষণে পুতিন সতর্ক করে বলেন, ইউক্রেনে ন্যাটো সেনা মোতায়েন করা হলে এর “ভয়াবহ পরিণতি” হতে পারে। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়াকে আক্রমণ করলে এর কড়া জবাব দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “এসব ঘটনা সত্যিই পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার ও সভ্যতা ধ্বংসের সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়। তারা কি তা বুঝতে পারছে না?”
যুদ্ধের সময় রাশিয়া নিজেকে “সম্মিলিত পশ্চিমের” বিরুদ্ধে এক অস্তিত্বের লড়াইয়ে জড়িত বলে চিত্রিত করেছে। কারণ ন্যাটো ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সমর্থন দিচ্ছে।
ক্রেমলিন ইউক্রেনে বিদেশি শান্তিরক্ষী মোতায়েনের সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলো একে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছিল।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোয়া বৃহস্পতিবার জানান, রাশিয়া অন্য দেশগুলোর “সংঘাতে জড়িত হওয়া” মেনে নেবে না। এমনটা হলে মস্কো সব ধরনের উপায়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে।
ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলো যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউক্রেনে হাজার হাজার সেনা পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এই সপ্তাহের শুরুতে রাশিয়া পুনরায় জানিয়েছে যে তারা “কোনো অবস্থাতেই” ন্যাটো দেশগুলোর শান্তিরক্ষী বাহিনীকে ইউক্রেনের ভূমিতে মোতায়েন করতে দেবে না। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গত বুধবার ক্রেমলিন-সমর্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ব্লগারদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন তুলেছেন, “আমরা কেন শান্তিরক্ষী বাহিনীকে সম্মতি দেব… তারা এমন দেশগুলোর বাহিনী পাঠাতে চায়, যারা আমাদের শত্রু বলে ঘোষণা করেছে। তারা কি শান্তিরক্ষী হিসেবে আসবে?”
কূটনৈতিক মিশন
রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করে ইউক্রেন যুদ্ধের বাইরেও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ওবামা প্রশাসনের সময় থেকে জমে থাকা কূটনৈতিক সম্পত্তি সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের অভিযোগ।
২৭ ফেব্রুয়ারি ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা হয়। এতে উভয় পক্ষের কূটনৈতিক মিশনের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেসব মিশনের কার্যক্রম বহিষ্কার ও স্টাফ সীমাবদ্ধতার কারণে ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
রাশিয়া ছয়টি কূটনৈতিক সম্পত্তি ফেরত চেয়েছে। সেগুলো ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অবৈধভাবে দখল করেছে বলে তারা দাবি করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে জব্দ করা নিউ ইয়র্ক ও মেরিল্যান্ডের ভবন। এছাড়া সিয়াটল ও সান ফ্রান্সিস্কোর কনস্যুলেটও রয়েছে। এগুলো সিলিকন ভ্যালি, সাবমেরিন ঘাঁটি ও বোয়িং সুবিধার মতো সংবেদনশীল স্থানের কাছাকাছি থাকায় বন্ধ করে দেন ট্রাম্প তার প্রথম আমলে।
ওয়াশিংটন মস্কোতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে ব্যাংকিং সুবিধা, চুক্তিভিত্তিক সেবা এবং স্থিতিশীল ও টেকসই স্টাফিং নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, “গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষ এই ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় মিশনের কার্যক্রম স্থিতিশীল করার জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ চিহ্নিত করেছে।”
সভা শেষ হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই মস্কো ঘোষণা করে যে তারা ওয়াশিংটন থেকে নতুন রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার দারচিভ নিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার
২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পর বাইডেন প্রশাসনের দেওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো রুশ অর্থনীতি দুর্বল করেছে এবং দেশটির সামরিক খাতে বাধা সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্প শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
সরকারিভাবে ক্রেমলিন দাবি করেছে, সব নিষেধাজ্ঞা অবৈধ এবং সেগুলো তুলে নিতে হবে। তবে গোপনে মস্কো যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার স্বাগত জানাবে। কারণ এতে পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ প্রয়োগে ঐক্য ভেঙে যাবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাশিয়া বিশেষভাবে ট্রান্সন্যাশনাল পেমেন্ট এবং গ্যাস ও তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রতি আগ্রহী। বিশেষ করে তার তেল ট্যাঙ্কার বহরের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা।
রাশিয়ার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, পশ্চিমে থাকা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ জব্দ হয়ে থাকা। গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, সেখানে এসব জমাকৃত সম্পদের সুদ ইউক্রেনকে সহায়তায় ব্যবহারের কথা বলা হয়।
পুতিন এই কৌশলকে “চুরি” হিসেবে অভিহিত করেন। এই সম্পদগুলোকে জামিন হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাব দিয়েছে প্যারিস। যাতে মস্কো কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করলে সেগুলো আটকানো যায়।
রাশিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে ইস্তাম্বুলে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু করার জন্য চাপ দিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই আলোচনার বিষয়ে বিবৃতিতে কিছু উল্লেখ করেনি।
তথ্যসূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট