Beta
সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

ভারি বর্ষণের কারণ কী এই ক্লাউডবার্স্ট

ক্লাউডবার্স্ট সাধারণও পাহাড়ি এলাকায় বেশি হয়।
ক্লাউডবার্স্ট সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় বেশি হয়।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

যে বন্যায় ডুবেছে বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ পার্বত্যাঞ্চল, তার জন্য দায়ী করা হচ্ছে পাশের দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যসহ সংলগ্ন এলাকায় অতি বৃষ্টিকে। এই অতি বৃষ্টির কারণ হিসাবে ‘ক্লাউডবার্স্ট’কে চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়াবিদরা।

মৌসুমি বায়ু যখন বেশ সক্রিয়, তখন এই ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘ বিস্ফোরণের কারণে ত্রিপুরা রাজ্যে গত সপ্তাহে প্রবল বর্ষণ হয়। সেই বৃষ্টির পানি ভাসিয়েছে রাজ্যটিকে, আর উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে ডুবেছে বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল।

বঙ্গোপসাগরে এই সময়ে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা ১৬ আগস্ট উঠে আসে স্থলভাগে। এই সময় পশ্চিমা বায়ুও ঠাণ্ডা বাতাস নিয়ে আসছিল।

বিষয়টির ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ দৈনিক প্রথম আলোকে বলেন, সুস্পষ্ট লঘুচাপটি প্রচুর মেঘ নিয়ে আসে স্থলভাগে, একই সময়ে পশ্চিমা বায়ু ঠাণ্ডা বাতাস নিয়ে আসে। সাগর থেকে আসা উষ্ণ মেঘ আর পশ্চিম দিক থেকে ঠাণ্ডা বায়ু মিশে প্রচুর মেঘ হতে থাকে।

“ভূ-উপরিস্থ চাপের কারণে ওই মেঘ ফেনী, নোয়াখালী ও ভারতের ত্রিপুরার ওপর দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী থাকার পর ক্লাউডবার্স্ট ঘটেছে। ফলে অল্প সময়ে দু-তিন দিন ধরে প্রচুর বৃষ্টি হয়।”

ক্লাউডবার্স্ট কী

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ক্লাউডবার্স্ট বলতে বুঝিয়েছে, কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় অল্প সময়ের মধ্যে আকস্মিক অস্বাভাবিক অতি বৃষ্টিপাতকে। এতে বজ্রসহ বৃষ্টি কিংবা শিলা বৃষ্টিও হতে পারে। সাধারণত বজ্রপাতের সঙ্গেই ক্লাউডবার্স্টের যোগসূত্র বেশি।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর ক্লাউডবার্স্টকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে- যখন ২০ থেকে ৩০ বর্গকিলোমিটার ভৌগলিক এলাকার মধ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ঘণ্টায় ১০০ মিলি মিটার ছাড়িয়ে যায়, তখন তাকে ক্লাউডবার্স্টের কারণ ধরে নেওয়া যায়।

ক্লাউডবার্স্ট কোথায় হয়

সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় ক্লাউডবার্স্ট বেশি দেখা যায়। তবে সমভূমিতেও ক্লাউডবার্স্ট হয়।

ঘনীভূত মেঘ যখন পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন যেদিকে বাধা পায় পাহাড়ের সেই ঢালে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়, বিপরীত ঢালে প্রবাহিত বায়ু থাকে শুষ্ক।

পাহাড়ি এলাকায় এই ক্লাউডবার্স্ট হঠাৎ পানি বাড়িয়ে ঢলের সৃষ্টি করে, তাতে নিচের অংশে দেখা দেয় বন্যা।

ত্রিপুরা যেহেতু পাহাড়ি অঞ্চল, ঘনীভূত মেঘ সেখানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে ১৯ আগস্ট থেকে পরের কয়েকদিন। তাতে সেখানেসহ সংলগ্ন বাংলাদেশেও নদীতে হঠাৎ পানি বেড়ে দেখা দিয়েছে বন্যা।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এই ক্লাউডবার্স্টের শুরু ১৯ আগস্ট সকালে। তা বিস্তৃত ছিল ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের কুমিল্লা-ফেনী মিলিয়ে ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ১৯, ২০ ও ২১ আগস্ট এ এলাকায় অতিভারি বৃষ্টি হয়েছে।

ক্লাউডবার্স্ট যেভাবে হয়।

ক্লাউডবার্স্টের সঙ্গে সাধারণ বৃষ্টির তফাৎ কী

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় শ্রাবণ মাসে, সেই শ্রাবণ গড়িয়ে এখন ভাদ্র মাস চলছে। তবে এই সময়েও বৃষ্টিপাত চলে।

বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টির কারণ অতি ঘনীভূত মেঘও হতে পারে, আবার তা ছাড়াও বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ক্লাউডবার্স্টের ক্ষেত্রে ঘনীভূত মেঘের পরিমাণ হবে অনেক এবং তাতে হবে মুষলধারে বৃষ্টি।

গত ১৯ থেকে চার দিনে ফেনীতে ৪৩৫ মিলি মিটার বৃষ্টি হয়েছে। এই সময়ে কুমিল্লায় বৃষ্টি হয়েছে ৫৫৭ মিলি মিটার, নোয়াখালীতে ৬০৫ মিলি মিটার।

গত ২২ আগস্ট ত্রিপুরার সুনামুরায় ২৬৯ মিলি মিটার, আগরতলায় ২৩৩ মিলি মিটার, বিলোনিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২৪২ মিলিমিটার।

ভারতের মুম্বাইয়ে ২০০৫ সালে ক্লাউডবার্স্ট ঘটায় ১ ঘণ্টায় ৯৪৪ মিলি মিটার বৃষ্টি হয়েছিল। তাতে পুরো শহর অচল হয়ে পড়ে।

ক্লাউডবার্স্ট অল্প সময়ের জন্য ছোট এলাকাজুড়ে হয় বলে এর বিষয়ে আগাম ধারণা পাওয়া কঠিন। এর পূর্বাভাস পেতে হলে ক্লাউডবার্স্ট প্রবণ এলাকায় শক্তিশালী রাডার ব্যবস্থা দিয়ে প্রতিক্ষণ নজর রাখা দরকার।

বাংলাদেশে ক্লাউডবার্স্টের পূর্ব নজির

পূর্ব এশিয়া, চীন, অস্ট্রেলিয়া, মধ্য আমেরিকায় ক্লাউডবার্স্টের বহু নজির রয়েছে। বাংলাদেশেও কয়েকটি ঘটনা প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরেছেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ, যিনি দেড় যুগ ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন।

তার গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাই মাসে রংপুর অঞ্চলে এ ধরনের ক্লাউডবার্স্ট হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত প্রায় ৪৪৭ মিলি মিটার বৃষ্টি হয়েছে সেখানে।

এরপর ২০২২ সালের ১৮ জুন সিলেটে ক্লাউডবার্স্টে এক দিনে ৩০৪ মিলি মিটার বৃষ্টি হয়। সেদিন সিলেট সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয়ে ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল।

মৌলভীবাজারে বন্যা।
মৌলভীবাজারে বন্যায় তলিয়েছে সড়ক।

এবার বন্যা কেন এত আগ্রাসী

আবহাওয়া অধিদপ্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলায় ১৯৫৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত ২২ বার ২৪ ঘণ্টায় ৩০০ মিলি মিটারের বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। এই সময়ে ৪০০ মিলি মিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে আটবার। এবার বৃষ্টি কোনও জেলায়ই ৩০০ মিলি মিটারের খুব বেশি অতিক্রম না করলেও বন্যা হয়েছে মারাত্মক।

এর কারণ ব্যাখ্যায় আবহাওয়াবিদদের বক্তব্যের বরাতে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্ষায় গত এক মাসজুড়ে ওই এলাকায় থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। জুলাইয়ের শেষের দিকে একবার ও আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ফেনী-নোয়াখালীতে ২০০ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টি হয়। ফলে সেখানকার বেশ কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে যায়। কিন্তু বৃষ্টি এক দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। পানি নেমে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিল। যে কারণে বন্যাও ভয়াবহ হয়নি।

তিস্তা ও গঙ্গা অববাহিকার সঙ্গে মুহুরী ও গোমতী অববাহিকার একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। তা হচ্ছে, তিস্তা ও গঙ্গার যেখানে ভারি বৃষ্টি হয়, তা বাংলাদেশের সীমানা থেকে ৪০০–৬০০ কিলোমিটার দূরে। আর ওই দুই নদীর প্রস্থ এক থেকে দুই কিলোমিটার। ফলে সেখান থেকে ঢল ধীরে ধীরে এসে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করতে তিন থেকে সাত দিন সময় লাগে।

কিন্তু ত্রিপুরা থেকে ফেনী-কুমিল্লার দূরত্ব ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার। আর এখানকার নদীগুলোর প্রস্থ ২০০ থেকে ৩০০ মিটার। ফলে দ্রুত পানির ঢল এসে এলাকাগুলো প্লাবিত করতে পেরেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত