Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ২৩ মে, ২০২৫

কনডেম সেল : কিতাবে নাই, তবে গোয়ালে আছে

শিল্পী: আনিসুর রহমান লিটন
শিল্পী: আনিসুর রহমান লিটন
[publishpress_authors_box]

১০ ফুট বাই ৬ ফুট আয়তনের ঘর, বাতাস চলাচলের জন্য নামমাত্র ছোট্ট একটি জানালা। কারাগারে এমন একটি ঘরে রাখা হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের। বিচারিক আদালতের রায়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় অনেক আসামির বছরের পর বছর কেটে যায় নির্জন এই কক্ষেই। শারীরিক ও মানসিক পীড়নে মৃত্যুদণ্ডের আগেই যেন মৃত্যুর এক ব্যবস্থা।

বাংলায় বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ আছে- ‘কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। কিন্তু কনডেম সেল এই প্রবাদের উল্টোটি। কারাবিধির কোথাও এই কনডেম সেলের কথা নেই। অথচ কারাগারে এই সেল আছে, যা নিয়ে হালে প্রশ্নও উঠেছে।

মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে কাউকে কারাগারের নির্জন সেল বা কনডেম সেলে রাখা যাবে না বলে সোমবার রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। তাতে বলা হয়েছিল, কোনও ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে অর্থাৎ আপিলসহ সর্বোচ্চ আদালতে অনুমোদনের আগে তাকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না।

দুই বছরের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের ক্রমান্বয়ে কনডেম সেল থেকে সরিয়ে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখার ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছিল কারা কর্তৃপক্ষকে।

তবে রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুতই আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। বুধবার আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই রায় স্থগিত করে দিয়েছে।

তাতে কনডেম সেল নিয়ে নির্দেশনাগুলোর কার্যকারিতা আপাতত স্থগিত হলেও হাইকোর্টের রায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দিদের মানবাধিকারের বিষয়টি সামনে এনেছে।

কনডেম সেল কী

কারাগারে বন্দিরা কীভাবে থাকবে, সেটার কারাবিধি বা জেল কোডে লেখা আছে। কিন্তু বিধির কোথাও কনডেম সেলের বিষয়ে কিছু লেখা নেই। তবে বিধিতে কয়েদি (দোষি সাব্যস্ত) ও হাজতিদের (বিচারাধীন আসামি) আলাদা রাখার কথা বলা আছে। আরও বলা আছে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বন্দিকে একটি পৃথক সেলে রাখতে হবে। এই পৃথক সেলই কনডেম সেল নামে সাধারণভাবে পরিচিত।

কারা মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কারাগারে কনডেম সেল বলে কিছু নেই। যারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তাদের কারাবিধি অনুযায়ী পৃথক সেলে রাখা হয়।”

সেখানে থাকা বন্দিরা বিধি অনুযায়ী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পান জানিয়ে তিনি বলেন, “আগের তুলনায় কারাগারের সেলগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। পরিবেশ হয়েছে উন্নত।”

তবে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে কনডেম সেলের আসামিদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে বলে জানান সাবেক কারা উপমহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধিতে ফাঁসির আসামিদের কনডেম সেলে রাখার মতো কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকলেও তাদের আলাদা ধরনের কক্ষে রাখা হয়ে থাকে। এটিকে এক ধরনের রেওয়াজ বলা যেতে পারে।

“কনডেম সেলে বন্দি রাখার ব্যবস্থা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন আছে। তবে পুরনো কারাবিধি অনুসারে সেখানে পরিবর্তনের সুযোগও কম। মানবাধিকার ও বিচার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে।”

নির্জন সেই সেল আকারে কেমন

সাবেক ও বর্তমান কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন বন্দির থাকার জন্য ন্যূনতম ৬ ফুট বাই ৬ ফুট জায়গা বরাদ্দ রাখার কথা বলা আছে কারাবিধিতে। তবে বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে বিশেষ সেল এই আয়তনের কিছুটা বেশিই হয়ে থাকে।

একজন বন্দির থাকার জন্য একক সেলগুলো সাধারণত ১০ ফুট বাই ৬ ফুট আয়তনের হয়ে থাকে। আর তিন বা ততোধিক বন্দির জন্য সেল হলে আনুপাতিক হারে সেলের আয়তন বাড়ে।

অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নির্জন সেলের মাপ কিছুটা বড় বলেই মনে করেন কারা কর্মকর্তারা।

তবে ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য সাধারণত অন্যান্য সেলের তুলনায় অনেক ছোট আকারের জানালা থাকে নির্জন সেলে। আর এসব সেলে থাকা বন্দিদের দিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেলের বাইরে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়।

এমন সেল কতটি

কারা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, দেশের কারাগারগুলোতে আড়াই হাজারের বেশি কনডেম সেল রয়েছে। তার মধ্যে দেড় শতাধিক রয়েছে নারী বন্দিদের জন্য।

কনডেম সেলে যে শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিই থাকেন, তেমনটা নয়। এসব নির্জন সেলে সংক্রামক রোগে আক্রান্তদেরও রাখা হয় বলে কারা কর্মকর্তারা জানান।

বাংলাদেশে মোট ৬৮টি কারাগার রয়েছে। সেখানে বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৪৩ হাজারের মতো হলেও কয়েদি ও হাজতি মিলিয়ে রয়েছেন প্রায় ৯০ হাজার জন।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর একজন বন্দিকে কারাগারে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখা, দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়।

শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, আগে কনডেম সেলে থাকা বন্দিদের মাসে একদিন সর্বোচ্চ ৫ জন নিকটজন কারাগারের ভেতরে ঢুকে দেখা করতে পারতেন। এতে নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি হওয়ায় ২০০৭ সালে এ নিয়মেরও পরিবর্তন হয়। এখন কারা ফটকে তারা দেখা করেন।

কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত কনডেম সেলের প্রত্যেক বন্দির কাছ থেকে তার নিকটাত্মীয়দের তালিকা নেয়। যাচাই-বাছাই শেষে নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া কনডেম সেলের বন্দির সঙ্গে অন্য কাউকে দেখা করতে অনুমতি দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ।

নির্জনবাসে বিবর্ণ চেহারা

১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল রাতে গুলশানে নিজ বাড়িতে খুন হন শাজনীন তাসনিম রহমান। ওই ঘটনায় করা ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিচারিক আদালত ছয় আসামিকে ফাঁসির রায় দেয়। তাদের মধ্যে ছিলেন শাজনীনের বাড়ির দুই গৃহকর্মী এস্তেমা খাতুন মিনু ও পারভীন।

২০০৭ সালে কারা উপ মহাপরিদর্শক থাকাকালে শামসুল হায়দার সিদ্দিকী কারাগার পরিদর্শনের সময় ফাঁসির আসামি এস্তেমা খাতুন মিনুর বিবর্ণ চেহারা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। তখন তিনি কনডেম সেলের ব্যবস্থাপনায় কিছু পরিবর্তনও আনেন।

শামসুল হায়দার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কনডেম সেলে থাকা আসামির চেহারা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। দীর্ঘ সময় আসামি সেলের বাইরে বের হননি, একা থেকেছেন, খাওয়া-দাওয়া করেননি ঠিকমতো। তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, সেলে আলো-বাতাসের সংস্পর্শ না থাকায় তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন।

“তখন তাকে প্রতিদিন রুটিন করে সেলের বাইরে নিয়ে আসাসহ বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছিলাম। এমন পরিস্থিতির শিকার আসামিদের জন্য তখন যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলাম, তা এখন রীতি-রেওয়াজের মতো ব্যবহার করা হলেও ব্রিটিশ আমলের কারাবিধিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসেনি।”

অবসরপ্রাপ্ত এই কারা কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত শতাধিক নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়নি। এ অবস্থায় নির্জন সেলে তাদের অবস্থান করতে হচ্ছে বছরের পর বছর।

নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১০ বছরের বেশি সময় নির্জন সেলে থাকা আসামির সংখ্যা অনেক।

অন্য বন্দিদের সঙ্গে কনডেম সেলের বন্দিদের সঙ্গে আলাদা আচরণ নিয়ে কারাগারে থাকা অন্যান্য বন্দি এবং কনডেম সেলের বন্দিদের পার্থক্য থাকা দরকার বলে মনে করেন কারা কর্মকর্তারা। তবে কনডেম সেলের বন্দিদের মানবাধিকারের বিষয়টিতে আরও গুরুত্বারোপ করা দরকার বলেও মনে করেন তারা।

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।

কনডেম সেলে থেকে খালাসেরও নজিরও আছে

কখনও কখনও দেখা যায়, বিচারিক আদালতে কোনও ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও পরবর্তীকালে উচ্চ আদালত তাকে খালাস দিয়েছে। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করার পর তার সাজা কমেছে বা মওকুফ হয়েছে, এমন ঘটনাও বিরল নয়। 

অথচ বিচারিক আদালতে রায়ের পরপরই কয়েদির স্থান হয়ে যায় কনডেম সেল। চূড়ান্ত বিচার হতে দীর্ঘ সময় লাগে, ততদিন তাকে সেই নির্জন কারা প্রকোষ্ঠেই থাকতে হয়।

২০ বছর কনডেম সেলে থাকার পর ফাঁসির আসামি খুলনার জেলার নারিকেলি চানপুরের বাসিন্দা জাহিদ শেখ খালাস পান ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট, আপিল বিভাগের রায়ে।

একই বছর ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে ১৪ বছর কনডেম সেলে থাকার পর আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পান কুমিল্লার লাকসামের হুমায়ুন কবির।

এমন শতাধিক বন্দি মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে মুক্ত হয়েছেন আপিলের মাধ্যমে। তবে কনডেম সেলে তাদের কেটেছে যন্ত্রণাময় দীর্ঘসময়।

বিধি কি বদলাবে

হাইকোর্টের রায়ের পর কারাপ্রধান এ এস এম আনিসুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “বন্দিদের প্রকার অনুসারে বিভিন্ন সেলে রাখা হয় অথবা ওয়ার্ডে রাখা হয়। এক্ষেত্রে আগের যা কিছু নির্দেশনা, সেটা আদালতেরই। আমরা শুধু আসামিদের জিম্মাদার। আমরা পুলিশ রিপোর্ট ও কারাবিধি অনুসরণ করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে থাকি।

“দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের তো অন্যদের সাথে ওয়ার্ডে অথবা সাধারণ সেলে রাখা যায় না। এজন্য বিশেষায়িত সেলে রাখতে হয়। নিরাপত্তা, শৃঙ্খলাসহ অনেক বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”

তবে আদালতের নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিলেন িতনি, যদিও আদালতের সেই রায়ের কার্যকারিতা আপাতত স্থগিত।

সরকার কারা আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তা চূড়ান্ত হলে কারাগারের পরিবেশ বদলে যাবে বলে মনে করছেন কারা কর্মকর্তারা।

কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেলের উদাহরণ টেনে এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিশেষায়িত সেল নয়, বিশেষায়িত কারাগারের মাধ্যমে সংকটের সমাধান সম্ভব। কাশিমপুরে প্রায় এক হাজার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বন্দি রাখার ব্যবস্থা আছে। সেখানে আসামি স্থানান্তরের পাশাপাশি নতুন কারাগার তৈরি করে ফাঁসির প্রক্রিয়ায় থাকা আসামিদের রাখা যেতে পারে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত