Beta
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫

আকাশে উড়োজাহাজের ঝাঁকুনি তীব্র হচ্ছে কেন

ফ্লাইট টার্বুলেন্সের তীব্রতা বেড়ে চলেছে।
ফ্লাইট টার্বুলেন্সের তীব্রতা বেড়ে চলেছে।
[publishpress_authors_box]

আকাশপথে উড়োজাহাজে হঠাৎ ঝাঁকুনির অভিজ্ঞতা অনেক যাত্রীরই আছে। তবে কয়েক বছর ধরে এই ঝাঁকুনির হার যেমন বেড়েছে, তেমনই তীব্র হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করছে বিজ্ঞানীরা। তারা বলছে, পৃথিবীতে গড় তাপমাত্রা যতই বাড়ছে, মেঘমুক্ত আকাশেও ঝাঁকুনির ঘটনা ততই বাড়ছে। প্রায়ই বিভিন্ন যাত্রীবাহী ফ্লাইটকে এমন ঝাঁকুনির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

আকাশপথে উড়োজাহাজের ঝাঁকুনিকে বলা হয় ‘ফ্লাইট টার্বুলেন্স’। সাধারণত মেঘের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় বাতাসের গতির তারতম্য বা গতিমুখের ভিন্নতার কারণে উড়োজাহাজ ঝাঁকুনি খায়। অনেকটা বড় খানা-খন্দে ভরা সড়ক দিয়ে বাস চলার সময়কার ঝাঁকুনির মতো।

মেঘমালার আশে-পাশে একই সঙ্গে কম গতি ও বেশি গতির এবং ঊর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী বাতাসের প্রবাহ থাকে। এ কারণে এমন ঝাঁকুনি তৈরি হয়। ঝড়ের সময়ও এমনটা ঘটে।

এজন্য সাধারণত উড়োজাহাজগুলো মেঘের ওপর দিয়ে চলাচল করে, প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার উচ্চতায় ওড়ে।

তবে মেঘমুক্ত আকাশেও এমনটা ঘটতে পারে। পরিষ্কার আকাশেও অনেক সময় দ্রুতগামী বাতাসের প্রবাহ থাকে। একে বলা হয় জেট স্ট্রিম।

সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ হাজার ফুট উচ্চতায় বাতাসের এমন প্রবাহের দেখা মেলে। আশেপাশের বাতাসের চেয়ে এই জেট স্ট্রিমের বাতাসের গতি প্রায় ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেশি হয়।

টার্বুলেন্সে আক্রান্ত হওয়ার পরের দশা

ভিন্ন ভিন্ন গতিতে বহমান বাতাসের এই দুই প্রবাহের মাঝখানে পড়লে ফ্লাইটগুলো হঠাৎ করেই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। এটি ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রা, চাপ বা বেগে বাতাসের মিলনের কারণে ঘটে, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন গতির বাতাসের সংঘর্ষ হয়। অনেকটা সমুদ্রে চলমান কোনও জাহাজ হঠাৎ করে দ্রুতগতির বাতাস ও স্রোতের মুখে পড়লে যেমনটা হয়।

যুক্তরাজ্যের রিডিং ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা ক্লিয়ার-এয়ার টার্বুলেন্স নিয়ে গবেষণা করেছেন। পরিষ্কার-আকাশে বাতাসের এই ঝাঁকুনি পাইলটদের পক্ষে এড়ানো খুব কঠিন। কারণ, সেগুলো বেশিরভাগই রাডারে সহজে ধরা পড়ে না।

তাদের গবেষণা বলছে, ১৯৭৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে উত্তর আটলান্টিক রুটে টার্বুলেন্সের সংখ্যা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। গবেষণাটি গত বছর জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস জার্নালে প্রকাশিত হয়।

এতে দেখা যায়, কার্বন নির্গমন বাড়ার পরিণতি হিসেবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আকাশের উচুস্তরে বাতাসের গতিবেগও প্রায়ই হঠাৎ করে বদলে যাচ্ছে। ফলে পরিষ্কার আকাশেও জেট স্ট্রিম ও টার্বুলেন্সের ঘটনা বাড়ছে।

গবেষণা প্রতিবেদনটির সহ-লেখক রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানী অধ্যাপক পল উইলিয়ামস বলেন, “এক দশকের গবেষণার পর দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে পরিষ্কার-আকাশে টার্বুলেন্স আরও বাড়বে। আমাদের কাছে এখন প্রমাণ রয়েছে যে, টার্বুলেন্স এরই মধ্যে বাড়তে শুরু করেছে।”

যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর আটলান্টিকের ফ্লাইট রুটগুলোতে জেট স্ট্রিম ও টার্বুলেন্স সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ আটলান্টিকেও পরিষ্কার-আকাশে এটি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর বাইরে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের আকাশও টার্বুলেন্সের জন্য কুখ্যাত।

বজ্রপাত থেকেও ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়। ঝড়, বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি হয় মূলত এক ধরনের ভারি মেঘের কারণে। এই মেঘের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প থাকে, যা ক্রমাগত ঠান্ডা হয়ে বরফে পরিণত হয়। এই বরফের টুকরোগুলো একে অপরের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে আরও বড় হয়ে শিলাবৃষ্টিতে রূপ নেয়।

ফ্লাইটগুলো সবসময় এমন ভারি মেঘ এড়িয়ে যেতে পারে না। এর ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ফ্লাইটের ঝাঁকুনি হয়।

এই ভারি মেঘের ভেতরে থাকে অত্যন্ত শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহ। বিজ্ঞানীরা এর শক্তিকে হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়ে দশগুণ শক্তিশালী হিসেবে বর্ণনা করেন।

জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সংস্থা আইপিসিসির মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উষ্ণমণ্ডলীয় ঝড় আরও তীব্র হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানি উষ্ণ হচ্ছে। উষ্ণ পানি থেকে বেশি পরিমাণে জলীয় বাষ্প বাষ্পীভূত হয়। এই জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলে মিশে ঝড়কে আরও শক্তিশালী করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতার পরিমাণও বাড়ছে।

এই অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প ঝড়ের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে তীব্র বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো হাওয়া তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিতে টার্বুলেন্সের হার বাড়ে।

সম্প্রতি লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরগামী একটি ফ্লাইট মাঝ আকাশে ভয়াবহ ঝাঁকুনির কবলে পড়ে। দুই তিন মিনিটের ঝাঁকুনিতে এক ঝটকায় উড়োজাহাজটি নেমে যায় কয়েক হাজার ফুট নিচে। ঝাঁকুনির কারণে ফ্লাইটে থাকা এক যাত্রী প্রাণ হারান। আহত হয় ৩১ জন।

লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে যাচ্ছিল সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি। এতে ২১১ জন যাত্রী ও ১৮ জন ক্রু ছিলেন। যাত্রীদের ৪৭ জন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক।

মাটি থেকে ৩৭ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ছিল ফ্লাইটটি। উড়োজাহাজের ভেতরে তখন যাত্রীদের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল। ঠিক তখনই তীব্র ঝাঁকুনিতে ভেতরে তালগোল পাকিয়ে যায়। এসময় হার্ট অ্যাটাকে ব্রিটিশ নাগরিক জিওফ কিচেন মারা যান।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একজন কর্মকর্তা জানান, ফ্লাইটটি লন্ডনে থেকে উড্ডয়নের পর মিয়ানমারের ইরাবতী অববাহিকার আকাশে পৌঁছালে হঠাৎ করে চরম ঝাঁকুনি দিয়ে নিচে নেমে যেতে থাকে। দুই-তিন মিনিটেই সেটি ৬ হাজার ফুট নিচে নেমে আসে।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের ওই ঘটনার পরই টার্বুলেন্স সম্পর্কে আগাম কীভাবে জানা সম্ভব, সেই চ্যালেঞ্জ বিজ্ঞানীদের সামনে এসেছে। তারা বলছেন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে টার্বুলেন্স সম্পর্কে আগাম সংকেত পাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলার গুরুত্বও তুলে ধরেন।

যাত্রীবাহী ফ্লাইটগুলো আকাশে প্রায়ই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিটি ফ্লাইটই কম-বেশি জেট স্ট্রিমের কবলে পড়ে। তবে এতে তেমন বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে না। কিন্তু অনেক সময় পাইলট আগে থেকে বুঝতে না পারলে এবং বাতাসের গতির তারতম্য খুব বেশি হলে বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে।

এর কবলে পড়লে বিমান ঝাঁকুনি দিয়ে অনেক সময় হঠাৎ করেই নিচে নেমে আসতে পারে বা পাইলট কিছুক্ষণের জন্য উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন। এমন ঘটনায় হতাহতের ঘটনা খুব কমই ঘটে। তবে ঝাঁকুনি খুব বেশি হলে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।

উড়োজাহাজের ক্রুদের এই ধরনের পরিস্থতিতে কী করতে হবে তার প্রশিক্ষণ দেওয়া থাকে। আর এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই যাত্রীদের সবসময় সিট বেল্ট বেঁধে রাখতে বলা হয়।

আকাশে টার্বুলেন্স বাড়ার অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকও রয়েছে। গবেষকরা বলেছেন, বিমানের ক্ষয়-ক্ষতি সহ টার্বুলেন্সের প্রভাবের কারণে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিমান শিল্প বছরে ১৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে ৫০০ মিলিয়ন হারায়। এর একটি পরিবেশগত ক্ষতিও রয়েছে, কারণ পাইলটরা এটি এড়ানোর জন্য অনেক সময় অতিরিক্ত জ্বালানি পোড়ান।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত