Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

রাফা কেন গুরুত্বপূর্ণ, কী করছে ইসরায়েল

গাজা উপত্যকার দক্ষিণের শহর রাফা।
গাজা উপত্যকার দক্ষিণের শহর রাফা।
[publishpress_authors_box]

গাজার দক্ষিণের ছোট শহর রাফা। ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর গোটা গাজার বাস্তুচ্যুতরা ভিড় করেছে শহরটিতে। ৬৪ বর্গ কিলোমিটারের শহরটিতে এখন প্রায় ১৪ লক্ষাধিক মানুষের বাস।

সম্প্রতি রাফায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এরপরই তেল আবিব জানায়, রাফায় তাদের ব্যাপক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

আল জাজিরা বলছে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু এখন রাফা। সেখানে হামলা চালানো হলে, ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।

গাজা উপত্যকার আয়তন প্রায় ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার। যুদ্ধের আগে সেখানে বাস ছিল ২১ লাখের বেশি ফিলিস্তিনির। এই জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত আশ্রয় নিয়েছে রাফায়।

রাফায় সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার দৃশ্য।

ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাফা

গাজা উপত্যকা ও মিসরের সীমান্তবর্তী শহর রাফাহ। ফিলিস্তিনের দিক থেকে এটি গাজার সর্বদক্ষিণের শহর। আর মিসরের দিক থেকে এটি উত্তর সিনাইয়ের প্রশাসনিক শহর।

ফিলিস্তিন অংশের রাফায় গত চার মাস ধরে গাজায় ইসরায়েলের হাতে মার খাওয়া ফিলিস্তিনিরা জড়ো হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার বাসিন্দাদের ‘নিরাপদে আরও দক্ষিণে’ সরে যেতে বলছে।

ইসরায়েলি বোমা হামলায় এরই মধ্যে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে ৩০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

কেন অভিযান চালাতে চায় ইসরায়েল

রাফায় হামাসের চারটি ব্রিগেড রয়েছে, এমন অভিযোগ এনে সেখানে বিমান ও স্থলপথে জোরদার হামলা চালাতে চাইছে ইসরায়েল। শুধু তাই নয়, ইসরায়েল রাফা শহরকে ফাঁকা করতে চাইছে কৌশলগত কারণে। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দাদের কী হবে, সেবিষয়ে কোনও বক্তব্য এখনও দেয়নি তেল আবিব। এমন অবস্থায় ভয়াবহ পরিণতির শঙ্কায় দিন কাটছে রাফাবাসীর।

মিশর কেন জড়িত

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল চাইছে রাফা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে মিশরের সিনাই উপত্যকায় ঠেলে দিতে। এমনটা হলে মিশরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। নতুন করে ১৪ লক্ষাধিক শরণার্থী প্রবেশ করলে স্বাভাবিকভাবেই দেশটির ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। কেননা দীর্ঘদিন ধরে মিশরে ১ লাখ দশ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আছেন শরণার্থী হিসেবে।

কী করছে মিশর

রাফা সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি অভিযানে যে অনুপ্রবেশ হতে পারে তা ঠেকাতে কায়রো প্রশাসন এরই মধ্যে ৪০টি ট্যাংক ও বহু সাঁজোয়া যান মোতায়েন করেছে।

দেশটি হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, রাফায় ইসরায়েল হামলা চালালে পরিণতি হবে ‘ভয়াবহ’। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক তাদের ভূমিতে প্রবেশ করালে তা ৪০ বছর পুরনো ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির লঙ্ঘন হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে মিশর।

গত ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের শুরুর দিন থেকেই কায়রো তাদের সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করে। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে রাফা সীমান্ত দিয়েই জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গাজায় ত্রাণ প্রবেশ করতে দেয় মিশর।

প্লাস্টিকের তাঁবুতে আশ্রয় নেওয়া ফিলিস্তিনি।

গাজা ছাড়তে চায় না ফিলিস্তিনিরা

ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালে ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়, যাকে নাকবা নামে অভিহিত করা হয়। সে সময় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়। গাজা ও পশ্চিম তীরের সেই ভূমিতে ইসরায়েল পরে বসতি স্থাপন করে।

গাজার এখনকার বাসিন্দাদের অনেকেই ওই নাকবা শরণার্থীদের বংশধর। তারা ভালো করেই জানেন, একবার বাস্তুচ্যুত হলে আর ফিরে আসা যায় না। ইসরায়েল তাদের ফিরতে দেবে না।

মিশরের মতো অন্য আরব দেশগুলোও এমন বাস্তুচ্যুতিতে আপত্তি জানাচ্ছে। কারণ ওই দেশগুলো ১৯৪৮ সাল থেকেই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়ে আসছে।

রাফা কী নিরাপদ

ইসরায়েল যেহেতু এর মধ্যে একবার রাফায় বিমান হামলা করেছে, তাই শহরটিকে আর নিরাপদ বলা যাচ্ছে না।

শহরটিতে যারা হামলা থেকে বেঁচে আছেন, তারা অমানবিক পরিবেশে তাঁবুতে করে কোনও রকমে টিকে রয়েছেন। অল্প বৃষ্টি হলেই তাঁবুতে পানি ওঠে। মোটের ওপর দুর্বিসহ দিন কাটছে তাদের।

রাফায় এখন যারা আছেন, তারা এর আগেও বহুবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ফলে এবার যাই হোক তারা রাফা ছাড়তে চাইছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচারমাধ্যম পিবিএসকে জিহান আল হাওয়াজিরি নামের এক বাসিন্দা জানান, বোমা-গুলি যাই আসুক, তিনি তার তাঁবু ছেড়ে যাবেন না।

নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক পরিচালক অ্যাঞ্জেলিটা ক্যারেড্ডা বলেন, “পালিয়ে যাওয়ার মতো কোনও জায়গা আর নেই।”

স্যাটেলাইটে তোলা ছবিতে রাফা শহর।

রাফায় এখন কী অবস্থা

স্যাটেলাইটে তোলা ছবিতে রাফার ভয়াবহ পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে। সেখানকার ৬৪ বর্গ কিলোমিটারের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে অন্তত ২২ হাজার মানুষ ঠাসাঠাসি করে বাস করছেন।

যুদ্ধের আগে রাফায় দুই লাখ ৭৫ হাজার মানুষ থাকত। কিন্তু বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়েছে।

সাহায্যের আশায় রাফায় জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি বিষয়ক শরণার্থী সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) অবকাঠামোগুলোয় আশ্রয় নিয়েছিল ফিলিস্তিনিরা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরায়েলি হামলায় এরই মধ্যে সংস্থাটির দেড় শতাধিক কর্মী নিহত হয়েছেন।

তেল আবিবের অভিযোগ, শরণার্থী সংস্থাটির ১২ জন কর্মী ৭ অক্টোবরের হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল। এমন অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই ইসরায়েলের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলো সংস্থাটিতে অনুদান বন্ধ করেছে।

ঘনবসতি হওয়ার কারণে রাফায় দ্রুত রোগ ছড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, রাফায় হেপাটাইটিস এ-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। আক্রান্তদের যেহেতু আলাদা করা যাচ্ছে না, তাই প্রাদুর্ভাবও ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

ইসরায়েল কী চায়

হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলায় ১ হাজার ১৩৯ ইসরায়েলি নিহত হয়। এছাড়া ২৪০ জনকে জিম্মি করে সংগঠনটি। হামলার পর হামাসকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে সর্বাত্মক হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

শুরুতে ইসরায়েল বলেছিল, তারা শুধু হামাসকে টার্গেট করছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলা থেকে বেসামরিক নাগরিকেরাও রেহাই পাচ্ছে না।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, হামাস মানবঢাল ব্যবহার করছে নিজেদের রক্ষায়। এমন দাবির মাধ্যমে তারা বেসামরিকদের ওপর হামলা চালানোকেও বৈধতা দিতে যাচ্ছে।

জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে হামাসের এক কমান্ডারকে হত্যা করতে গিয়ে অর্ধশতাধিক বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে ইসরায়েল। কিন্তু ওই শিবিরে হামাসের সেই কমান্ডার ছিলেন কিনা, এর কোনও প্রমাণ দেয়নি ইসরায়েল।

গাজার আল শিফা হাসপাতাল অবরোধ করে হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। হাসপাতালের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিলে চিকিৎসাধীন অন্তত ৩০ নবজাতক মারা যায়। আল শিফায়ও তারা দাবি করেছিল, হাসপাতালটির নিচে হামাসের টানেল রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালটি দখলের পর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রাফায় ইসরায়েলের হামলার লক্ষ্য কী

ইসরায়েল বলছে, রাফার মাটির নিচে হামাসের টানেল রয়েছে। সেখানে লুকিয়ে আছে সংগঠনটির কয়েকজন কমান্ডার ও কয়েকটি ব্রিগেড।

একই অজুহাতে তারা এর আগে গাজার উত্তরে অভিযান চালিয়েছিল।

গাজায় স্থল অভিযান বন্ধের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আছেন। কিন্তু কোনও আহ্বানেই সাড়া দিচ্ছে না ইসরায়েল।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত