দেড় দশক আগে দেশে রাজনৈতিক সংকটে জরুরি অবস্থা জারির পর ‘সংস্কার’ শব্দটি ছিল ব্যাপক আলোচিত। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সব পর্যায়ে চলছিল সংস্কার-সংস্কার রব।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতেও উঠেছিল একই আওয়াজ। দল দুটির নেতাদের একটি করে অংশ সংস্কারপন্থি নামে পরিচিতিও পেয়েছিল।
আবার রাজনৈতিক সংকট, এবারও একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে দেশে, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। আবারও আওয়াজ উঠেছে পরিবর্তনের।
তবে এবার সংস্কারের স্থানটি নিয়েছে ‘বন্দোবস্ত’ শব্দটি। যাদের নেতৃত্বে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন নতুন বন্দোবস্তের কথা। আরও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখেও আসছে বন্দোবস্তের কথাটি।
নতুন বন্দোবস্তের কথা যারা বলছেন, কেন বলছেন- সেই প্রশ্নে তারা বলেন, পুরনো সব বন্দোবস্ত যেহেতু ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার আসে একটি ব্যবস্থার ফলে। তাই সেই ব্যবস্থাটিই বদল করতে হবে। এটাই নতুন বন্দোবস্ত।
এমন বক্তব্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের মুখেও শোনা যায়।
গত ১৬ আগস্ট তিনি এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমাদের এক দফার অংশ ছিল। সেজন্য বিস্তর কাজ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রয়োজন।”
সংস্কার কী, বন্দোবস্ত কী
বাংলা ভাষায় সংস্কার শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। এটি তৎসম শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ শোধন, শুদ্ধি, উন্নতি বিধান, উৎকর্ষ সাধন, উন্নতি সাধন, মেরামত ইত্যাদি।
আর বন্দোবস্ত শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে। এ আভিধানিক অর্থ আয়োজন, জমির বিলিব্যবস্থা, জমির দখল সম্পর্কিত শর্ত, খাজনা ইত্যাদি।
বন্দোবস্ত ব্যবহার নতুন নয়
শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত শব্দটির ব্যবহার বাড়লেও বন্দোবস্ত শব্দটির ব্যবহার এই ভূখণ্ডে নতুন নয়। ব্রিটিশ আমল থেকেই পরিচিত এই শব্দ।
১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিস প্রশাসনের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বাংলার ভূমি মালিকদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে ইতিহাসে পরিচিত। সেই চুক্তির আওতায় জমিদারদের হাতে ভূমির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে গবেষক ও লেখক পাভেল পার্থ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কোনও নতুন টার্ম না। বহুল প্রচলিত ধারণা কিংবা চিন্তা বলা যেতে পারে।
“১৮৫৫ সাঁওতালরা যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করল, তখন ফুলমনি, জানমনি, শিবু-কানুরা প্রথমেই যেটা বলেছিল, তা হলো এই যে জঙ্গল বনভূমি সেটার উপরে জনগণের একটি বন্দোবস্ত দরকার। সেটার ধারাবাহিকতায় তেভাগা আন্দোলন ফসলের উপর কৃষকের বন্দোবস্তের কথা বলেছে। ঠিক একই রকম টংক আন্দোলন বা নানকার আন্দোলনেও কিন্তু জনগণের একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলা হয়েছে।”
তবে হালের রাজনীতিতে বন্দোবস্ত শব্দের ব্যাপক ব্যবহার খুব বেশি আগে দেখা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ের নামে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কথাটি পাওয়া যায়। এর নাম ছিল ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও অর্থনৈতিক ফলাফল (১৯৭১-২০১৮)’।
গত বছর তিনি একটি পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও বলেছিলেন, ‘আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে যেতে হবে’।
এবারের আন্দোলনের মধ্যে বন্দোবস্ত শব্দটি রাজনৈতিক অঙ্গন ছাপিয়ে অর্থনৈতিক অঙ্গনকেও স্পর্শ করে। অর্থনীতির গবেষক অধ্যাপক সেলিম রায়হানের একটি কলামের শিরোনাম হয়ে ওঠে- ‘গণ-অভ্যুত্থান : নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেন জরুরি’।
নতুন বন্দোবস্তের তাড়না কেন
আন্দোলনের মধ্য থেকে যখন নতুন বন্দোবস্তের কথা উঠছে, তার মধ্য দিয়ে দখলদারির বিরুদ্ধে একটি সামাজিক মালিকানা তৈরির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হচ্ছে বলে মনে করেন পাভেল পার্থ।
তিনি বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে আমরা কিন্তু নতুন বন্দোবস্তের কথা বলছি। বন্দোবস্ত মূলত একটি রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা। যেই জনতৎপরতার ভিতর দিয়ে মানুষের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশই এই বন্দোবস্ত। সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যেই মূলত এই চাওয়া মানুষের।”
বিষয়টি আরও খোলসা করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা তো ৯০ এর গণআন্দোলন দেখলাম। মানুষের প্রত্যাশা ছিল ভালো কিছু হবে। তা কিন্তু হয়নি। তারপর যে সরকার এল, সেও ভালো কিছু করল না। কেয়ারটেকার সরকার ছিল, সেটাও বাতিল হয়ে গেল। মানুষ আসলে এসবে বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই নতুন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত জনপ্রিয় হয়েছে।”
এখন মানুষ কী চাইছে- সেই প্রশ্নে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “এ মুহূর্তে মানুষ এমন একটি বন্দোবস্ত চাচ্ছে, যাতে শেখ হাসিনার মতো আর কাউকে পালাতে না হয়। আর কোনও স্বৈরাচারী কাঠামো যেন তৈরি না হয়। আওয়ামী লীগের আগে বিএনপির যে দুর্নীতি বা হাওয়া ভবন, সেটা যেন আর তৈরি না হয়। এসব কারণই মানুষকে নতুন বন্দোবস্ত তৈরিতে তাড়িত করছে।”
নতুন বন্দোবস্তের ভাবনায় কী
ক্ষমতায় ভারসাম্য তৈরি করাই নতুন বন্দোবস্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন তারা, যারা এনিয়ে সক্রিয়ভাবে ভাবছেন।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র হবে না। সংবিধানে পরিবর্তন নিয়ে আসা। যেমন-দুই বারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দিকে চলে যাওয়া। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে কি না, প্রদেশ হবে কি না? এগুলো নিয়ে আলোচনা করে নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে।”
শুধু সংবিধানে পরিবর্তন আনলেই হবে, তেমনটা মনে করেন না তিনি।
“পরিবর্তন আনতে হবে সকল ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক দলেও কাঠামোগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সার্বিকভাবেও শুধু কাঠামোগত পরিবর্তন হলেই হবে না। মানসিকতায় পরিবর্তনও আনতে হবে। যেমন নির্বাচনে কেউ হেরে গেলে সেই পরাজয় মানার মানসিকতা থাকতে হবে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত গণসংহতি আন্দোলন গত কয়েক বছর ধরে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যে নতুন বন্দোবস্তের কথা বলছে।
এই দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের কাঠামোটাই ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়েছিল। যেই এখানে বসুক, সেই স্বৈরাচারী হবে। আমরা সেই ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন বোঝাতেই বন্দোবস্তের কথা বলে এসেছি। আজকে তা মানুষও বলছে।”
নতুন বন্দোবস্ত কেমন হবে- সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, সেরকম একটি বন্দোবস্ত করতে হবে।
“বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করার বন্দোবস্ত করতে হবে আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাই কিন্তু ছিল একটি গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু প্রত্যেকটি সরকার মানুষের আকাঙ্ক্ষার মূল্য কম দিয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন করে একটি জন-গণতান্ত্রিক রূপান্তরের উদ্দেশ্যে আমাদের নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে।”
নতুন বন্দোবস্ত তৈরির উদ্যোগ
আন্দোলনের বিজয়ের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেমন হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি নাগরিক কমিটি গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক নাসির আবদুল্লাহ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সংগঠনের তরুণ প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি নাগরিক কমিটি করার চেষ্টা করছি, যারা সমাজের সকল অংশীদারদের সাথে কথা বলে একটি নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করবে। যাতে সমাজে ফ্যাসিবাদী যে প্রবণতা, তা নতুন করে দাঁড়াতে না পারে।”
“বাংলাদেশের সবাইকে সাথে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক এই শিক্ষার্থী, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এছাড়া শিক্ষক, চিন্তক ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে আরেকটি প্ল্যাটফর্মও তৈরি হয়েছে। সেই কমিটির প্রস্তাবিত নাম ‘গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’।
সেই কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক লেখক-গবেষক মাহা মির্জা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা মানুষের পক্ষে দাবি তৈরি করতে চাচ্ছি। যেই সংস্কার বা রূপান্তরের বন্দোবস্তে একটি নতুন সমাজ তৈরি হবে। আমরা আর পুরাতন বিষাক্ত সমাজে যেতে চাই না।”
দাবি তৈরি করতে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা হুট করে বলা কঠিন। কিন্তু আমরা কী কী পরিবর্তন চাই, কেমন পরিবর্তন চাই, এটা একটা গবেষণামূলক কাজ। এই কাজ আমরা শুরু করছি।”
সময়ের প্রয়োজন আলাদা প্লাটফর্মগুলো একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তা বলছেন মাহা মির্জা ও নাসির আবদুল্লাহ দুজনই।