ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে ‘ব্রিজিং প্রপোজাল’ বা ‘সেতুবন্ধনের প্রস্তাব’ নামে নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এটি মেনে নিয়েছে ইসরায়েল।
সোমবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিবে বৈঠক শেষে ব্লিনকেন বলেন, “যুদ্ধবিরতি নিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে আমার কার্যকর আলাপ হয়েছে। যুদ্ধবিরতির আলোচনায় ‘ইতিবাচক’ অগ্রগতি হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের মতে, প্রস্তাবটির লক্ষ্য গাজায় সহিংসতার অবসান ঘটাতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করা।
ব্লিনকেন জানান, যেসব বিরোধে ওয়াশিংটন-প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবটি আটকে যায়, সেসব দূর করতে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব দিয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী তা মেনে নিয়েছেন।
হামাসকেও প্রস্তাবটি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সম্ভবত গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চুক্তির লক্ষ্যে এই প্রচেষ্টাই সর্বশেষ সুযোগ। তাই এখন হামাসের জন্যও একই কাজ করা বাধ্যতামূলক। ইসরায়েলের বন্দিদের মুক্তি দিয়ে গাজায় স্বস্তি ফেরানোর বিষয়টি এখন হামাসের ওপর নির্ভর করছে।”
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে গত ১৫ আগস্ট কাতারের রাজধানী দোহায় নতুন আলোচনা শুরু হয়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির বিষয়ে আশাবাদ জানিয়ে আসছে। কিন্তু হামাস চুক্তির অগ্রগতিকে ‘ভ্রম’ বলে মন্তব্য করেছে।
হামাস বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের আগের পরিকল্পনার ভিত্তিতেই গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চায় তারা। গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন সেই পরিকল্পনা তৈরি করেছিল।
হামাসের যুক্তি ছিল, নতুন কোনও প্রস্তাব নিয়ে এখন আলোচনা করতে গেলে শুধু সময় নষ্ট হবে। এতে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাও চলতে থাকবে। এর চেয়ে বরং ইসরায়েলকে আগের প্রস্তাব অনুযায়ীই আলোচনায় বাধ্য করা উচিৎ।
তাই হামাস নতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এটিকে ইসরায়েলকে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের আগের প্রস্তাবে ফিরে যাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে হামাস।
হামাস এটিকে গাজায় ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার জন্য কালক্ষেপণের কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চায় না ইসরায়েল
ইসরায়েল ‘যুদ্ধবিরতি’ আলোচনায় রাজি হলেও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চায় না। নেতানিয়াহু ইসরায়েলি বন্দিদের উদ্ধারের পর গাজায় ফের হামলা বজায় রাখতে চান।
ফিলিস্তিন থেকে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ‘আগাম হামলা’ চালানোর সামরিক নীতি মেনে আসছে। সেই নীতি অনুযায়ী ইসরায়েল প্রায়শই অধিকৃত পশ্চিম তীরেও হামলা করে।
ইসরায়েলি রাজনৈতিক ভাষ্যকার অরি গোল্ডবার্গ বলেন, “অধিকাংশ ইসরায়েলি নাগরিক নেতানিয়াহু যা করতে চান তা অবাস্তব হওয়া সত্ত্বেও এর বিরোধিতা করতে পারেন না। যেমন তিনি হামাসকে ধ্বংস করতে চান। কিন্তু এটি অবাস্তব চাওয়া। এর কোনও অর্থ নেই।”
ইসরায়েলের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও বলেছেন, হামাসকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা অসম্ভব। তাদের মতে, নেতানিয়াহুর এই ঘোষণা ইসরায়েলি জনসাধারণের চোখে ধুলা দেওয়ার সামিল। এমনকি নেতানিয়াহুর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তও হামাসের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’-এর ধারণাকে অবাস্তব বলে বাতিল করে দিয়েছেন।
জুলাইয়ে হামাস একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করতে চেয়েছিল। তারা আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকেও যেতে চেয়েছিল।
কিন্তু নেতানিয়াহু একের পর এক শর্ত যোগ করে চলেছেন। এতে তিনি যে আপোস করতে অনিচ্ছুক সেটাই প্রমাণ করেছেন।
সেনা প্রত্যাহার নিয়ে বিরোধ
মিশর সীমান্তের ফিলাডেলফি করিডোর থেকে শুরু করে পুরো গাজা থেকে সমস্ত ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার চায় হামাস।
কিন্তু নেতানিয়াহু বলছেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষায় ও হামাসের অস্ত্র চোরাচালান ঠেকাতে ইসরায়েলি সেনাদের অবশ্যই করিডোরে এবং গাজার অন্যান্য স্থানে থাকতে হবে।
হামাস বলেছে, মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব দিয়েছিল তাতেও সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন বলেছিল, ইসরায়েল সে প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল এখন আর তা মানছে না।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন ফিলাডেলফি করিডোরে ইসরায়েলি সেনা উপস্থিতির বিষয়ে নেতানিয়াহুকে আরও নমনীয় করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সর্বনিম্ন সংখ্যক সেনা উপস্থিতির কথা বলেছেন।
ইউরোপীয় কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ হিউ লোভাট বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র নেতানিয়াহুর নতুন শর্তগুলো মেনে নিয়েছে। তবে সেগুলো আরও নমনীয় করার চেষ্টা করছে। নতুন প্রস্তাবটি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সেতুবন্ধনের নয়, মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে সেতুবন্ধনের প্রস্তাব।”
উদ্বাস্তুদের ঘরে ফেরার অধিকার
ইসরায়েল গাজার উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িতে ফেরার সময় অস্ত্রের জন্য তল্লাশি করার শর্ত দিয়েছে। ইসরায়েল বলেছে তাদের লক্ষ্য, উত্তর গাজায় হামাস যোদ্ধাদের পুনরায় সংগঠিত হতে না দেওয়া।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিরা শর্তটিকে তাদের ঘরে ফেরা ঠেকাতে ইসরায়েলের একটি অজুহাত হিসেবে বিবেচনা করছে।
হামাসও বলছে, ফিলিস্তিনিদের চলাফেরার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে এবং ইসরায়েলকে অবশ্যই সেনা প্রত্যাহার করতে হবে।
উত্তর গাজার বাসিন্দাদের ঘরে ফেরার দাবির প্রতি ফিলিস্তিনিরা বিশেষভাবে সংবেদনশীল। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল সৃষ্টির পর থেকে তারা বারবার তাদের বসতি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে।
তখন প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি জায়নবাদী মিলিশিয়াদের হাতে তাদের বসতভিটা থেকে উৎখাত হয়। ওই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা প্রথম নাকবা বা মহাবিপর্যয় নাম দেয়। গাজার জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশই উদ্বাস্তু, তারা নাকবার সময় ইসরায়েলিদের দখল করা এলাকা থেকে তাদের বাড়িঘর হারান।
বন্দি বিনিময়
মঙ্গলবার হামাসের হাতে আটক থাকা ইসরায়েলিদের পরিবারগুলোও যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা করেছিল। বৈঠকের পরে তাদের একজন সাংবাদিকদের বলেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত নন।
যুদ্ধবিরতিতে তাত্ত্বিকভাবে তিনটি পর্যায় জড়িত, যেখানে ইসরায়েলের হাতে বন্দি নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে সমস্ত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি চায়। কিন্তু নেতানিয়াহু গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি না হলে তারা ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেবে না।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ হিউ লোভাট আল জাজিরাকে বলেন, “আমি মনে করি আমেরিকানরা এখন নেতানিয়াহুর সুরে সুর মেলাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে আমেরিকানরা কেবল তার শর্তগুলোকেই সমর্থন করছে না বরং যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেস্তে দেওয়ার সুযোগও করে দিচ্ছে।”
মানবিক সহায়তা
গাজার ফিলিস্তিনিরা ক্ষুধার্ত এবং তাদের জরুরি খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন।
জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থাসহ যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো বারবার ইসরায়েলকে বিপর্যস্ত বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি সাহায্য বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতও (আইসিজে) জানুয়ারিতে ইসরায়েলকে বিষয়টির ওপর জোর দিতে বলেছে।
ইসরায়েল বারবার এই আহ্বান উপেক্ষা করেছে। ইসরায়েলের অতি-ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেছেন, ২০ লাখ ফিলিস্তিনিকে অনাহারে মারাটা তার দেশের জন্য ‘ন্যায়সঙ্গত’ হতে পারে, তবে বিশ্ব এর প্রতি অনুমোদন দেবে না।
হামাস অবশ্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কয়েক লাখ মানুষের জীবন রক্ষাকারী সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে শর্তারোপের অভিযোগ করেছে।
হামাস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “ইসরায়েলি দখলদার ও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন খাদ্য সংকটকে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।”
সময় কি ফুরিয়ে যাচ্ছে
মঙ্গলবার ইসরায়েল গাজা থেকে ছয়জন বন্দির মরদেহ উদ্ধার করেছে। কতজন এখনও জীবিত আছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বন্দিদের খান ইউনিসের একটি টানেলের মধ্যে পাওয়া গেছে। একে একটি ‘জটিল অপারেশন’ হিসেবেও বর্ণনা করেছে তারা। কীভাবে ওই জিম্মিদের মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে কোনও তথ্য মেলেনি।
গাজার ফিলিস্তিনিরাও ইতোমধ্যে ইসরায়েলের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের মূল্য দিচ্ছে। সমালোচকদের মতে, ইসরায়েল নিষ্ঠুরভাবে সবাইকে শাস্তি দিচ্ছে।
মঙ্গলবারও ইসরায়েল গাজা শহরের মুস্তাফা হাফেজ স্কুলে হামলা চালিয়ে ১২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। ইসরায়েল সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া একাধিক স্কুলেও হামলা চালিয়েছে। গত ১০ আগস্ট এমন এক হামলায় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
হামলার পর উদ্ধারকর্মীরা দেখতে পান, অনেক মরদেহ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। মাংসের দলায় পরিণত হয়েছে। তারা ব্যাগে করে নিহতদের শরীরের অঙ্গগুলো সংগ্রহ করেছিল।
লোভাট বলেন, “যুদ্ধবিরতি আলোচনার সময় যত দীর্ঘ হবে, ইসরায়েলি জিম্মিদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও তত কমবে। আর স্পষ্টতই, যুদ্ধবিরতি ছাড়া আরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হতে থাকবে।”
গাজায় গত ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলের হামলায় ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা