Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

ইসরায়েল-ইরান হামলা-প্রতিরক্ষায় কার সক্ষমতা কতটা 

Military
[publishpress_authors_box]

ইসরায়েল শুক্রবার ভোরে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর একের পর এক হামলা চালায়। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে অবস্থিত তাদের দূতাবাসকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলার পরদিনই ওই হামলার ঘটনা ঘটে। 

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, রাতের ওই হামলায় তাদের ২০০টিরও বেশি যুদ্ধবিমান ইরানের শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। তাদের দাবি, হামলায় ইরানের তিনজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সোশাল মিডিয়া এক্সে নিহতদের নাম প্রকাশ করে। তারা জানায়, নিহতদের মধ্যে আছেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মোহাম্মদ বাগেরি, ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) প্রধান হোসাইন সালামি ও খাতাম আল-আম্বিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার মেজর জেনারেল গোলাম আলি রাশিদ।

২০২৪ সালে ইসরায়েল ও ইরান একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। গত ২ অক্টোবর ইরান ইসরায়েলের বড় বড় শহরে অন্তত ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইরানের আইআরজিসি জানায়, গাজা ও লেবাননে ইসরায়েলের হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের নিহত হওয়ার ঘটনায় এবং আইআরজিসি, হামাস ও হিজবুল্লাহ নেতাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা এই হামলা চালিয়েছে।

ওই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ২৫ অক্টোবর ইরানের ভেতরে প্রায় ২০টি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। ইসরায়েল জানায়, ইরান ও তার মিত্রদের অঞ্চলে মাসের পর মাস ধরে চলা হামলার প্রতিউত্তর হিসেবে তারা ওই পদক্ষেপ নেয়।

তবে শুক্রবারের এই হামলাকে বিশ্লেষকরা একটি বড় ধরনের উত্তেজনার বৃদ্ধি হিসেবে দেখছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, “ইসরায়েলের জন্য কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে।”

দীর্ঘদিন ধরে এই দুই শত্রু দেশ পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সংঘর্ষে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন তারা সরাসরি মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সামরিক সক্ষমতা, একে অপরকে আঘাত করার ক্ষমতা এবং নিজ নিজ ভূখণ্ড রক্ষা করার কৌশল নিয়ে বিশ্লেষণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

সৈন্য সংখ্যা

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) প্রকাশিত দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুসারে:

ইরানের সক্রিয় সামরিক সদস্য সংখ্যা ৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে রয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার, আইআরজিসিতে ১ লাখ ৯০ হাজার, নৌবাহিনীতে ১৮ হাজার, বিমানবাহিনীতে ৩৭ হাজার ও বিমান প্রতিরক্ষা শাখায় ১৫ হাজার সদস্য। 

এছাড়া ইরানের রিজার্ভ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৩ লাখ ৫০ হাজার। ইরানে ১৮ বছর বয়সের অধিক পুরুষদের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়।

অন্যদিকে ইসরায়েলের সক্রিয় সেনাসদস্য সংখ্যা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০। এর মধ্যে সেনাবাহিনীতে রয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার, নৌবাহিনীতে ৯ হাজার ৫০০ ও বিমানবাহিনীতে ৩৪ হাজার সদস্য। 

ইসরায়েলের রিজার্ভ বাহিনী আরও বড় — সেখানে সদস্য সংখ্যা ৪ লাখ ৬৫ হাজার। ইসরায়েলেও ১৮ বছরের অধিক বয়সী অধিকাংশ পুরুষ ও নারীর জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের নিয়ম রয়েছে।

সামরিক ব্যয়

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে:

২০২৩ সালে ইরান সামরিক খাতে ১০ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এটি ২০২২ সালের তুলনায় ০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

একই বছরে ইসরায়েল সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ২৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। এই ব্যয়ের বড় একটি অংশ এসেছে ৭ অক্টোবরের পর গাজায় চলমান যুদ্ধের কারণে।

স্থলবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুসারে, ইরানের স্থলবাহিনীর রয়েছে ১০ হাজার ৫১৩টির বেশি ট্যাংক, ৬ হাজার ৭৯৮টির বেশি কামান (আর্টিলারি গান) এবং ৬৪০টির বেশি সাঁজোয়া যান। ইরানের সেনাবাহিনীর অধীনে রয়েছে ৫০টি হেলিকপ্টার ও আইআরজিসির কাছে রয়েছে ৫টি হেলিকপ্টার।

অন্যদিকে ইসরায়েলের রয়েছে প্রায় ৪০০ ট্যাংক, ৫৩০টি কামান এবং ১ হাজার ১৯০টির বেশি সাঁজোয়া যান।

বিমানবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুসারে, ইরানের বিমানবাহিনীর হাতে রয়েছে ৩১২টি যুদ্ধবিমান। আইআরজিসির অধীনে রয়েছে আরও ২৩টি যুদ্ধবিমান। বিমানবাহিনীর রয়েছে ২টি ফাইটার হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর কাছে ৫০টি এবং আইআরজিসির অধীনে রয়েছে আরও ৫টি।

অন্যদিকে ইসরায়েলের কাছে রয়েছে ৩৪৫টি যুদ্ধ-উপযোগী বিমান এবং ৪৩টি ফাইটার হেলিকপ্টার।

নৌবাহিনী

দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুসারে, ইরানের রয়েছে ১৭টি কৌশলগত সাবমেরিন, ৬৮টি টহল ও উপকূলীয় যুদ্ধজাহাজ, ৭টি করভেট, ১২টি ল্যান্ডিং শিপ, ১১টি ল্যান্ডিং ক্র্যাফট এবং ১৮টি লজিস্টিক ও সহায়ক সরঞ্জাম।

অন্যদিকে ইসরায়েলের রয়েছে ৫টি সাবমেরিন এবং ৪৯টি টহল ও উপকূলীয় যুদ্ধজাহাজ।

আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুসারে, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত ‘আয়রন ডোম’ নামক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। এই ব্যবস্থা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর বেশিরভাগই প্রতিহত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। 

আয়রন ডোমের একটি রাডার আছে যা শত্রুর নিক্ষিপ্ত বস্তু শনাক্ত করে, তার গতি ও দিক নির্ধারণ করে। এরপর নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসাব করে দেখে বস্তুটি কোনও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আঘাত করতে পারে কি না। যদি হুমকি না থাকে, তবে বস্তুটিকে ফাঁকা স্থানে পড়তে দেওয়া হয়। হুমকি থাকলে ২০টি ইন্টারসেপ্টর মিসাইলবাহী লঞ্চার থেকে প্রতিরক্ষামূলক মিসাইল ছোড়া হয়।

ইসরায়েলে মোট ১০টি আয়রন ডোম ইউনিট ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি ব্যবস্থা রয়েছে যা মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করে। 

ডেভিড’স স্লিং ব্যবস্থা ৪০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে পারে। অ্যারো সিস্টেম ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বে আঘাতকারী ক্ষেপণাস্ত্র থামাতে সক্ষম।

আর ইরান ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে “আজারাখশ” নামের একটি স্বল্প-পাল্লার, নিচু উচ্চতায় কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করে। পার্সিয়ান ভাষায় “আজারাখশ” অর্থ বজ্রপাত। এটি একটি ইনফ্রারেড শনাক্তকারী ব্যবস্থা। এর সঙ্গে রাডার ও ইলেকট্রো-অপটিক প্রযুক্তি যুক্ত রয়েছে। এই ব্যবস্থা যানবাহনে স্থাপন করা যায়।

ইরানের বিমান প্রতিরক্ষায় রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। এর মধ্যে রয়েছে ৪২টির বেশি রাশিয়ান-তৈরি দূরপাল্লার এস-২০০, এস-৩০০ এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি বাভার-৩৭৩; ৫৯টির বেশি মাঝারি পাল্লার যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এমআইএম-২৩ হক, এইচকিউ-২জে ও খোরদাদ-১৫ এবং ২৭৯টি স্বল্প পাল্লার চীনে তৈরি সিএইচ-এসএ-৪ ও ৯কে৩৩১ টর-এম১।

ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইসি) বলছে, ইরানের অস্ত্রাগারে রয়েছে অন্তত ১২ ধরনের মাঝারি ও স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে টোন্দর-৬৯, যার পাল্লা ১৫০ কিলোমিটার; খোররামশাহর ও সেজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের রয়েছে অন্তত চার ধরনের ছোট, মাঝারি এবং মাঝারি-পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র। এর মধ্যে লোরা ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ২৮০ কিলোমিটার, আর জেরিকো-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৪,৮০০ থেকে ৬,৫০০ কিলেমিটিার পর্যন্ত।

পারমাণবিক সক্ষমতা

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা আনুমানিক ৯০টি। এসব অস্ত্র তাদের মজুদের অংশ।

ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি অত্যন্ত উন্নত পর্যায়ে রয়েছে। ইরান বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র পরিচালনা করে। 

সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ২০০০ এর দশকের গোড়ার দিকে একটি ধর্মীয় ফতোয়ার মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা করেন।

তবে ২০২৪ সালের মে মাসে ইরান হুঁশিয়ারি দিয়ে জানায়, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে তারা তাদের পারমাণবিক নীতি পরিবর্তন করতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত