যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই দেশটির আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএইডের প্রতি রুষ্ট। প্রথম মেয়াদেও তিনি সংস্থাটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন প্রশাসনের চাপে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ‘ডিপ স্টেটকে’ ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে শুরুতেই কঠোর হয়েছেন ইউএসএইডের ওপর। তিনি সংস্থাটিকে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একীভূত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
ট্রাম্পের এই ঘোষণার ফলে আন্তর্জাতিক সহায়তাকারী এই সংস্থার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা কর্মীসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ব্যয় সংকোচন নীতির প্রতিফলন ঘটাতে চাইছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এখন ইউএসএইডের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নির্দেশে সংস্থাটির কর্মীদের ওয়াশিংটন ডিসির প্রধান কার্যালয়ে যেতে মানা করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সংস্থাটির ১০ হাজারের বেশি কর্মীর মধ্যে ৩০০’র কম কর্মী রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
সংবাদ সংস্থাটিকে ট্রাম্প প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইউএসএইডে মাত্র ২৯৪ জন কর্মী রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আফ্রিকা বিভাগে ১২ ও এশিয়া বিভাগে মাত্র ৮ জন কর্মী থাকবে।
ইউএসএইড সংক্রান্ত এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ট্রাম্প দিয়েছেন বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ককে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার ছোট করার উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সম্প্রতি ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইউএসএইড চালায় ‘চরমপন্থী উন্মাদরা’, তাই তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর ইলন মাস্ক সংস্থাটিকে ‘অপরাধী সংগঠন’ বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও এমন দাবির পক্ষে তিনি কোনও তথ্য প্রমাণ দেননি। উল্টো তিনি বলেছেন, “ইউএসএইডের শেষ হওয়ার সময় এসেছে।”
ইউএসএইড কী, অর্থায়ন কীভাবে
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডোমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্যোগে ১৯৬১ সালে ইউএসএইড প্রতিষ্ঠিত হয়। স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিদেশি সহায়তা সমন্বয়ের জন্য এটি গঠিত হয়েছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত প্রভাব মোকাবেলা করা।
ইউএসএইড বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬০ শতাংশ বিদেশি সহায়তা পরিচালনা করে। ২০২৩ অর্থবছরে সংস্থাটি ৪৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের (সিআরএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্থার ১০ হাজার কর্মীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশে কাজ করেন এবং তারা প্রায় ১৩০টি দেশকে সহায়তা দিয়েছেন। ইউএসএইডের অর্থায়ন কংগ্রেস অনুমোদিত প্রশাসনের অনুরোধের ভিত্তিতে হয়।
সিআরএস জানিয়েছে, ইউএসএইড কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সংঘাতপূর্ণ দেশগুলোকে সহায়তা করে। এটি দারিদ্র্য, রোগ ও মানবিক সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেয়। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিশ্ব বাণিজ্যে অংশগ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করে।
২০২৩ সালে সংস্থাটির প্রধান সহায়তা গ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ছিল ইউক্রেন, ইথিওপিয়া, জর্ডান, কঙ্গো, সোমালিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়া।
যুক্তরাষ্ট্র কত অর্থ সহায়তায় ব্যয় করে, অন্যান্য দেশের ব্যয় কেমন
যুক্তরাষ্ট্র সরকারিভাবে অন্যান্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি সহায়তা দেয়। তবে ২০২০ সালে জাতীয় আয়ের অনুপাতে এটি ধনী দেশগুলোর মধ্যে তালিকার সবচেয়ে নিচে রয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করেছে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)।
২০২৩ সালে নরওয়ে তার মোট আয়ের ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ সহায়তার জন্য দিয়েছিল, যা শীর্ষে ছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, স্লোভেনিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্পেন তাদের মোট আয়ের শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশ সহায়তার জন্য দিয়েছিল, যা অনেক কম ছিল।
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের গত সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা খরচ মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ ছিল। ১৯৫০-এর দশকে মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ পুনর্গঠন করার সময় এটি যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ৩ শতাংশ ছিল। আর স্নায়ু যুদ্ধের সময় এটি ১ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের একটু কম ছিল।
তবু ২০২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী মোট ৭২ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে নারী স্বাস্থ্য, সংঘাতময় এলাকায় পরিষ্কার পানির সরবরাহ, এইচআইভি/এইডস চিকিৎসা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও দুর্নীতি রোধের মতো বিষয়গুলোতে।
ট্রাম্প কেন সংস্থাটির বিরোধিতা করছেন
ট্রাম্প গত ২০ জানুয়ারি এক নির্বাহী আদেশে অধিকাংশ বিদেশি সহায়তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন। সেসময় তিনি বলেন, “বিদেশি সহায়তা শিল্প ও প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তা আমেরিকার মূল্যবোধের বিপরীত। এগুলো বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।”
এক মেমোতে ওয়াশিংটন ডিসি প্রশাসন ইউএসএইড কর্মীদের ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সহায়তা বরাদ্দের পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। পাশাপাশি আদেশ না মানলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়।
এসব পদক্ষেপের কারণে থাইল্যান্ডের শরণার্থী শিবির থেকে শুরু করে ইউক্রেনের যুদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। মানবিক সংগঠন এবং জাতিসংঘের এজেন্সিগুলো জানিয়েছে, তারা খাদ্য, আশ্রয় ও স্বাস্থ্যসেবা বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হতে পারে।
ইউএসএইড সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, সংস্থাটিকে পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে একীভূত করা একটি বড় পরিবর্তন হবে। অতীতে ইউএসএইড এমন দেশগুলোতে মানবিক সহায়তা দিয়েছে, যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। যেমন ইরান ও উত্তর কোরিয়া।
সূত্রটি জানিয়েছে, এই মানবিক সহায়তার কারণে কখনও কখনও সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। তবে কার্যক্রম শুধু রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত হলে এই সহায়তা থেকে সুবিধা নাও মিলতে পারে।
বিদেশি সহায়তার প্রতি সমর্থন দ্বিদলীয় কি না
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে, ঐতিহাসিকভাবে ডেমোক্র্যাট প্রশাসন ও আইনপ্রণেতারা রিপাবলিকানদের চেয়ে বিদেশি সহায়তায় বেশি সমর্থন দিয়েছে। তবে যুদ্ধোত্তর প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট, ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান হোক, বিদেশি সহায়তার শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ট্রাম্প।
প্রথম ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি সহায়তার বাজেট এক তৃতীয়াংশ কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেটি গ্রহণ করা হয়নি। ২০২৪ সালে বিদেশি সহায়তা সম্পর্কিত একটি আইন বিলম্বিত করার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি।
এছাড়া ২০২৫ সালের বাজেটে বিদেশি সহায়তা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব গত জুনে প্রত্যাখ্যান করেন রিপাবলিকান দলের ৮০ শতাংশ সদস্য।
তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান।