অলাভজনক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ মুক্তি পেয়েছেন। দীর্ঘ আইনী লড়াই শেষে যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে সোমবার তিনি মুক্তি পান।
ফৌজদারি অপরাধের দোষ স্বীকার করে নেওয়ার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে তিনি মুক্তি পেয়েছেন।
চুক্তি অনুসারে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে থাকতে হবে না। এমনকি যুক্তরাজ্যের কারাগারে থাকার মেয়াদকেও তার সাজা ভোগের মেয়াদ হিসেবে গণ্য করা হবে।
যুক্তরাজ্যের কারাগারে গত পাঁচ বছর বন্দী ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। সেখান থেকেই তিনি তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই করেন।
এর ফলে দীর্ঘ ১৪ বছরের আইনী লড়াইয়ের অবসানের মধ্য দিয়ে অবশেষে তিনি নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গেছেন।
উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠা সাল ২০০৬। জন্মলগ্ন থেকেই অ্যাক্টিভিস্ট এই সংস্থাটি বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার লাখ লাখ গোপন নথি ফাঁস করেছে।
২০১০ ও ২০১১ সালে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ গোপন সামরিক-কূটনৈতিক নথি ফাঁস করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।
এরপর ৫২ বছর বয়সী অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তাদের জাতীয় প্রতিরক্ষামূলক তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে।
উইকিলিকস কী
উইকিলিকস নিজের পরিচিতি সম্পর্কের এর ওয়েবসাইটে বলেছে, এটি একটি বহুজাতিক গণমাধ্যম সংস্থা যা যুদ্ধ, গুপ্তচরবৃত্তি এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত গোপনীয় বা সীমাবদ্ধ নথি বা উপকরণগুলোর ডাটাবেজ বিশ্লেষণ এবং প্রকাশে বিশেষজ্ঞ।
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০০৬ সালে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর সহ-প্রকাশক, গবেষণা অংশীদার এবং তহবিল সরবরাহকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও রয়েছে। উইকিলিকস একটি অলাভজনক সংস্থা, যার খরচ জনসাধারণের অনুদানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
২০১৫ সালে জার্মান সংবাদপত্র ডার স্পিজেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সংস্থাটি সম্পর্কে অ্যাসাঞ্জ বলেছিলেন, “উইকিলিকস হল বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত নথিগুলোর একটি বিশাল লাইব্রেরি। আমরা এই নথিগুলোকে আশ্রয় দেই, আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করি, সেগুলো প্রচার করি এবং আমরা আরও বেশি কিছু পাই।”
উইকিলিকসের সবচেয়ে বিতর্কিত নথি ফাঁসের ঘটনা হলো ২০০০-এর দশকের প্রথম থেকে মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো যুদ্ধের গোপন সামরিক নথি ও ভিডিও ফাঁস। এসব নথি ও ভিডিওতে যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে থাকা বন্দীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেসামরিকদের মৃত্যুর মতো বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ বলেছে, এই ফাঁসগুলো বেপরোয়া, তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং এজেন্টদের জীবনকে বিপন্ন করেছে। অ্যাসাঞ্জের অনেক সমর্থক বলেছেন, উইকিলিকস বাকস্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখে এবং তার বিরুদ্ধে বিচার করার চেষ্টা সাংবাদিকতার উপর আক্রমণ।
উইকিলিকস কী ফাঁস করায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল
২০১০ সালের এপ্রিলে উইকিলিকস একটি ভিডিও প্রকাশ করে, যেটিতে ২০০৭ সালে ইরাকের বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হেলিকপ্টার হামলার দৃশ্য রয়েছে। ওই হামলায় রয়টার্সের দুই সংবাদকর্মীসহ এক ডজন মানুষ নিহত হয়।
এরপর জুন মাসে ব্র্র্যাডলি ম্যানিং নামে যুক্তরাষ্ট্রের এক সামরিক বিশেষজ্ঞকে গোপন ওই ভিডিও প্রকাশের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়। তিনিই ভিডিওটি অ্যাসাঞ্জকে দেন।
এর তিন মাস পরে, উইকিলিকস ৯১ হাজারটিরও বেশি নথি ফাঁস করে, যার বেশিরভাগই ছিল আফগানিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সামরিক প্রতিবেদন।
২০১০ সালের অক্টোবরে ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ইরাক যুদ্ধের বিবরণ সম্বলিত প্রায় ৪ লাখ গোপন সামরিক ফাইল ফাঁস করে উইকিলিকস।
এই নথি ফাঁস যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ইতিহাসে এমন ধরনের বৃহত্তম নথিফাঁসকাণ্ড ছিল।
একই বছরে পরে উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার কূটনৈতিক তারবার্তাও ফাঁস করে। এসব বার্তায় বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে গোপন মতবিনিময় ও নিরাপত্তা হুমকির মূল্যায়ন অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সৌদি আরবের সাবেক বাদশাহ আবদুল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া তারবার্তাগুলোও রয়েছে এর মধ্যে। তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আক্রমণ করার জন্য বারবার যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের উপর চীনের সাইবার হামলা চালানো সংক্রান্ত কিছু গোপন বার্তাও ছিল।
এসব ফাঁসের পর অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, যৌন শ্লীলতাহানি ও বেআইনি জবরদস্তির অভিযোগ আনা হয় এবং সুইডেনের আদালত তাকে আটকের আদেশ দেয়। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিনি ইউরোপীয় ওয়ারেন্টে ব্রিটেনে গ্রেপ্তার হন।
অ্যাসাঞ্জ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং শুরু থেকেই বলে আসছেন যে, উইকিলিকসের মাধ্যমে নথি ফাঁসের পর তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার অজুহাত তৈরির জন্যই এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে।
২০১১ সালে উইকিলিকস তার কাছে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২ লাখ ৫০ হাজার তারবার্তা থেকে আরও হাজার হাজার কূটনৈতিক তারবার্তা ফাঁস করে।
উইকিলিকসের সহযোগী বহু অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
উইকিলিকসকে সমর্থনকারী সাইবার অ্যাক্টিভিস্টদের একটি বড় গ্রুপও রয়েছে। তারা সাইটটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া বিভিন্ন সংস্থার ওপর অনলাইন আক্রমণ চালায়। অ্যাসাঞ্জের গ্রেপ্তারের পর তারা ফাঁস হওয়া নথিগুলোকে অনলাইনে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে।
‘অ্যানোনাইমাস’ নামে ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিস্টদের একটি গ্রুপ উইকিলিকসে অনুদান প্রক্রিয়াকরণ বন্ধ করায় ক্রেডিট কার্ড জায়ান্ট মাস্টারকার্ড এবং ভিসার মতো বড় সংস্থার ওয়েবসাইটগুলোতে সাইবার হামলা চালিয়ে সাময়িকভাবে ডাউন করে দেয়।
উইকিলিকস এখন বলছে, তারা এখন ক্রিপটোকারেন্সিতেও অনুদান গ্রহণ করে।
তথ্যসূত্র : রয়টার্স