সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের হাতে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন অম্লমধুর হয়ে দেখা দিচ্ছে ইসরায়েলের কাছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে পট পরিবর্তনের পর রবিবার ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎস শিরোনাম করেছে- “আসাদের পতন ইরানের জন্য একটি বড় আঘাত, তবে ইসরায়েলের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।”
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল তাদের বড় শত্রু হিসাবে দেখে ইরানকে; আর শিয়াপ্রধান রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল বাশার আল আসাদের। বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের হয়ে ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে যাচ্ছে, সিরিয়া ও লেবাননের হিজবুল্লাহ। লেবাননের শিয়া গোষ্ঠীটির সঙ্গেও যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে ইসরায়েল।
ফলে আসাদের পতনে ইরানের শক্তি কমাটাই স্বাভাবিক। তাতে ইসরায়েলের খুশি হওয়ার কারণ রয়েছে। কিন্তু আসাদের পতন ঘটেছে ইসলামী দলের হাতে, তাতে যে আবার ইসরায়েলের খুশি হওয়ার কারণ নেই, তা তুলে ধরেছে দেশটির সংবাদপত্র জেরুজালেম পোস্ট।
সংবাদপত্রটি এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ইসরায়েলে অদম্য শত্রু ছিলেন আসাদ। ইরানের দিক থেকে ইসরায়েলের জন্য যে হুমকি, তা কার্যকর হচ্ছিল আসাদের মাধ্যমে হিজবুল্লাহকে অস্ত্র সরবরাহ দিয়ে। কিন্তু সেই আসাদের পতনে ইসরায়েলের ব্যথিত হওয়ার কারণ নেই।
ইসরায়েল এখন দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করছে। লেবাননে হিজবুল্লার নেতৃত্বকে ছেঁটে ফেলার কাজ করছে ইসরায়েল। সশস্ত্র দলটির হাজার হাজার যোদ্ধা নিহত হয়েছে। হিজবুল্লাহর হামলার সক্ষমতাও কমেছে।
হিজবুল্লাহ এক সময় সিরিয়ায় বাশারের কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে থাকতে সহায়তা করে গেলেও এখন সেই অবস্থায় নেই। কারণ তারা এখন নিজেরাই সংকটে।
ইরানেরও সেই অবস্থা নেই, এমনকি বাশারের বড় মিত্র রাশিয়ারও এখন একই অবস্থা।
জেরুজালেম পোস্ট লিখেছে, গত অক্টোবরে ইসরায়েলি হামলা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাই ফুটিয়ে তোলে।
আবার গাজায় হামাসও ইরানের হয়ে ছায়া যুদ্ধ চালানোর মতো অবস্থায় নেই।
দু্ই বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধের জের টানতে থাকা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তার মিত্র বাশার আল আসাদের প্রতি আগের মতো মনোযোগ দিতে পারেননি।
বিবিসি লিখেছে, আসাদের পতনে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতির ভারসাম্যও নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরান আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
আর ইসরায়েল পড়েছে আরেক জটিলতার মধ্যে। আসাদকে শত্রুজ্ঞান করলেও তেল আবিবের জন্য সরাসরি হুমকি ছিলেন না তিনি। কিন্তু এখন যারা সিরিয়ার ক্ষমতা নিল, সেই হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জুলানি এক সময় যুক্ত ছিলেন আল কায়দার সঙ্গে।
তথ্যটি তুলে ধরে ইসরায়েলের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবি মেলামেদ সিএনএনকে বলেন, “ইরান, তার ছায়াযুদ্ধের সঙ্গী আর সিরিয়ার ইসলামি বিদ্রোহীদের মাঝে আছে ইসরায়েল।
“ফলে এর কোনোটিই ইসরায়েলের পছন্দ হওয়ার কারণ নয়; তবে কিছু সময়ের ইরান দুর্বল হবে, এটা ভালো বলা যায়।”
সিরিয়ার পট পরিবর্তনে ইসরায়েলি মন্ত্রী আমিচি শিকিলের প্রতিক্রিয়ায়ও তা উঠে এসেছে। এটা উৎসবের কোনও উপলক্ষ নয়, বলেছেন তিনি।
স্থানীয় সংবাদপত্র ইসরায়েল হায়মকে তিনি বলেছেন, সিরিয়ার বেশিরভাগ এলাকাই এখন আল কায়দা ও আইএস সংশ্লিষ্টদের করায়ত্ত।
শিকিল সেইসঙ্গে জোর দিয়েছেন গোলান মালভূমিতে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা মাউন্ট হেরমন দখলের। সিরিয়া ও ইসরায়েলের সীমান্ত রেখা নতুনভাবে তৈরির কথাও তুলেছেন তিনি।
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে গোলান মালভূমিকার বেশিরভাগ ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। ১৮৮১ সালে দখলীকৃত এলাকা আরও বাড়ায় হইহুদি রাষ্ট্রটি।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী সিরিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে সীমান্তে পাহারা জোরদার করার কথা জানিয়েছে।
বাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সিরিয়ার সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে সীমান্তের বাফার জোনসহ বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।”
ফলে এটা স্পষ্ট যে শত্রু আসাদের পতনেও হাততালি বাজাতে পারছে না ইসরায়েল, লিখেছে জেরুজালেম পোস্ট।
তাদের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি এখন ইসরায়েলের জন্য ইতিবাচক হলেও তা অবিমিশ্র নয়। জেরুজালেম নিশ্চয়ই দেখতে চাইবে না যে তার উত্তরের প্রতিবেশী দেশটি একটি ইসলামি জিহাদি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকুক। সিরিয়ায় এখন যা ঘটছে, তা ইসরায়েলের ভবিষ্যতের ওপরও প্রভাব ফেলবে।
সিরিয়ার পরিস্থিতির ওপর ইসরায়েলের নজর এখন আরও তীক্ষ্ণ করতে হবে। কারণ প্রথমত তেল আবিব চাইবে না যে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র ভাণ্ডার জিহাদিদের হাতে পড়ুক; দ্বিতীয়ত এই সুযোগে সিরিয়ায় ইরানি সৈন্যরা ঢুকে পড়ুক, সেটাও চাইবে না ইসরায়েল।