Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

২১ আগস্ট মামলা : যা ছিল বিচারিক আদালতের রায়ে

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়।
[publishpress_authors_box]

রাজনৈতিক বিরোধ থেকে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা, বাংলাদেশে এমন ঘটনার সবচেয়ে বড় নজির হয়ে আছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা।

২০ বছর আগের এই ঘটনায় ছয় বছর আগে দেওয়া বিচারিক আদালতের রায়ে এই কথাটিই উঠে এসেছিল। সেই রায়ে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন ও আসামিদের আপিলের শুনানি শেষে রবিবার সিদ্ধান্ত দিতে যাচ্ছে হাই কোর্ট।

বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের বেঞ্চ এই রায় দেবে।

আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার এই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড। এর মধ্যে বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুও রয়েছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ ১৯ জনের হয়েছিল যাবজ্জীবন সাজা। ১১ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, যাদের মধ্যে পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তারা রয়েছেন।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর তৎকালীন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন রায়টি দিয়েছিলেন।

জঙ্গিদের সহযোগিতা নিয়ে কীভাবে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, তা উঠে আসে বিচারকের লেখা রায়ে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়’ ওই হামলা ছিল একটি দলকে ‘নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা’।

“রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়।”

সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ দলটির ২৪ নেতা-কর্মী। শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়েছিল সেই হামলায়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই হামলার পর ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তদন্তে উঠে এসেছিল।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ওই হামলা চালানো হয়। হামলায় অংশ নেয় নিষিদ্ধ সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি) জঙ্গিরা। তারা সহযোগিতা নেয় বিদেশি জঙ্গিদের। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয়েছিল পাকিস্তান থেকে।

এই ষড়যন্ত্রের পেছনে তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’ ছিল বলে অভিযোগে বলা হয়েছিল।

আদালতে উপস্থাপিত জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দিতে বলা হয়, বিএনপি সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সহায়তায় তিনি আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। ওই পরিকল্পনা হয়েছিল ‘হাওয়া ভবনে’, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল তারেক রহমানের হাতে।

২০০৮ সালে ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর এই মামলার বিচার শুরু হয়েছিল। এরপর আওয়ামী লীগ আমলে সম্পূরক অভিযোগপত্রে যুক্ত হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম।

আওয়ামী লীগ আমলে রায়ের পর এখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে আপিলের রায় দিতে যাচ্ছে হাই কোর্ট।

চার মাস আগে অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে দেশ ছেড়ে এখন ভারতে রয়েছেন শেখ হাসিনা। তারেক রহমান ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তার ফেলার আলোচনা থাকলেও এখনও দেশে আসেননি তিনি।

বিএনপি বরাবরই দাবি করে আসছিল, গ্রেনেড হামলায় খালেদা জিয়ার সরকার কিংবা তাদের দলের কেউ জড়িত ছিল না।

২০১৮ সালের রায়ে প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তখন বলেছিলেন, “বিএনপি মনে করে, এই রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নগ্ন প্রকাশ।”

আপিলের রায়ের ঠিক আগেই যুক্তরাজ্য গেছেন ফখরুল। সেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেকের সঙ্গে তার দেখা করার কথা রয়েছে।

রাজনৈতিক কোনও বাধা না থাকলেও দেশে ফেরার আগে তারেক বিভিন্ন মামলার বাধা কাটাতে চান বলে আলোচনা রয়েছে।

তদন্তে ‘জজ মিয়া নাটক’

২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড।
সমাবেশে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেড।

কোনও ঘটনার তদন্তে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা কীভাবে হয়, গ্রেনেড হামলার মামলাটি তার জাজ্বল্যমাণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

গ্রেডেন হামলার মামলার রায়ের এক বছর বাদে দুদকের মামলায় ভুল আসামি জাহালমকে মুক্তি দেওয়া আগে হাই কোর্টের বিচারক বলেছিলেন, “জজ মিয়া নাটক আরেকটি বানালেন নাকি?”

‘জজ মিয়া’ ছিলেন একজন ভবঘুরে। ২০০৪ সালে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর তাকেই হামলাকারী হিসাবে দেখানো হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে।

হামলার ঘটনাটিকে ষড়যন্ত্র বলে প্রথমেই দাবি করেছিলেন বিএনপি নেতারা। তারা উল্টো আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেছিল।

এরপর গ্রেপ্তার করা হয় শৈবাল সাহা পার্থ নামে এক তরুণকে। মোখলেসুর রহমান নামে আওয়ামী লীগের এক নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে হালে পানি না পাওয়ার পর ২০০৫ সালে নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে ধরে আনা হয় যুবক জজ মিয়াকে।

জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তিও আদায় করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ‘বড় ভাই’দের নির্দেশে তিনি অন্যদের সঙ্গে গ্রেনেড হামলায় অংশ নিয়েছিল। সেই বড় ভাইরা হলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুল।

সেই জবানবন্দির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি জজ মিয়াকে মুল আসামি ধরেই এগোতে থাকে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের কারণে সেই পথে বেশি দূর যেতে পারেনি।

হামলার পরদিনই মতিঝিল থানার তৎকালীন এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করছিল, পরে ডিবির হাত ঘুরে সিআইডি পায় তদন্তভার।

এরপর ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে তদন্ত মোড় নেয়। ২০০৮ সালের ১১ জুন হত্যা ও বিস্ফোরকের দুই মামলায় অভিযোগপত্র দেন সিআইডির তৎকালীন সুপার ফজলুর রহমান। তাতে অব্যাহতি দেওয়া হয় জজ মিয়াসহ বিএনপি আমলে গ্রেপ্তার ২০ জনকে।

সেই অভিযোগপত্রে জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করে বিচারও শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটির অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে। এরপর সিআইডির বিশেষ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আসামির তালিকায় আরও ৩০ জনকে যোগ করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন।

সেখানে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ চারদলীয় জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নাম আসে। ২০১২ সালের ১৮ মার্চ সম্পূরক অভিযোগপত্রের আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়েই এই মামলার বিচার ও রায় হয়েছিল।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিনটি স্মরণে প্রতিবছর আওয়ামী লীগ কর্মসূচি পালন করত।

সেদিন যা ঘটেছিল

তখন ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোট, সংসদে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রা বের করার কর্মসূচি দেয়।

শোভাযাত্রার আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে। সেখানে একটি ট্রাক এনে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, শোভাযাত্রার আগে সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বক্তৃতা শেষ করে তিনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সময় ঘটে পর পর দুটি বিস্ফোরণ। এরপর সামান্য বিরতি দিয়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ শুরু হয়। তারই মধ্যে শোনা যায় গুলির আওয়াজ।

মঞ্চে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা বিস্ফোরণে মধ্যে মানববর্ম তৈরি করায় সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়।

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

নিহত অন্যরা হলেন- শেখ হাসিনার দেহরক্ষী মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় অজানাই থেকে যায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত