হিজবুল্লাহপ্রধান শেখ হাসান নাসরাল্লাহকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বোমা মেরে হত্যা করেছে ইসরায়েল। গাজা যুদ্ধের মধ্যে এই ঘটনা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আঞ্চলিক সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করেছে।
নাসরাল্লাহকে হত্যার পর এখন পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে পারে- এনিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে, যে উত্তরগুলোর মধ্যেই নিহিত আছে আগামীতে ওই অঞ্চলে কি হতে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিত।
বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাত শুরু হলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রও এতে জড়িয়ে পড়তে পারে। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন পরিস্থিতি অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
কী করবে হিজবুল্লাহ
একের পর এক ধাক্কার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে হিজবুল্লাহ। সশস্ত্র সংগঠনটির নেতৃত্ব কাঠামোতে বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে। এরই মাঝে শীর্ষ এক ডজনের বেশি কমান্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। দলটির যোগাযোগব্যবস্থায় থাবা বসিয়েছে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহর সদস্যদের ব্যবহৃত যোগাযোগযন্ত্র পেজার ও ওয়াকি-টকিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহর বহু অবকাঠামোতে বিমান হামলা চালানো হচ্ছে।
হিজবুল্লাহর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ আল-বাশা বলেন, “হাসান নাসরাল্লাহর মৃত্যুর প্রভাব অনেক। গ্রুপটিকে অস্থিতিশীল করে তুলবে এই ঘটনা। দলটি স্বল্প মেয়াদে এর রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল পরিবর্তন করবে।”
কিন্তু প্রচণ্ড ইসরায়েলবিরোধী সংগঠনটি হঠাৎ হাল ছেড়ে দেবে এবং ইসরায়েলের শর্তে রাজি হয়ে শান্তি চাইবে- এমন কোনও প্রত্যাশা ভুল হতে পারে। কারণ হিজবুল্লাহ এরই মধ্যে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনটির এখনও কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত যোদ্ধা রয়েছে।
হিজবুল্লাহর কাছে সামরিক সরঞ্জামও কম নেই। তাদের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা তেল আবিবসহ আরও কয়েকটি শহরে আঘাত হানতে পারে। ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হওয়ার আগেই এসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে দলটির ভেতর থেকে চাপ বাড়তে পারে।
কিন্তু হিজবুল্লাহ এমনটা করলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মারা যেতে পারে বহু বেসামরিক ইসরায়েলি। আর তখন ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালাতে পারে। এর ব্যাপ্তি লেবানন হয়ে ইরান পর্যন্ত গড়াতে পারে।
ইরান কী করবে
ইরানের জন্য নাসরাল্লাহর মৃত্যু অনেক বড় ধাক্কা। দেশটি তার জন্য এরই মধ্যে পাঁচদিনের শোক ঘোষণা করেছে। এছাড়া জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছে তেহরান।
তেহরানের একটি গেস্ট হাউসে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহকে গত জুলাইয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে হত্যা করে ইসরায়েল। ওই ঘটনার প্রতিশোধ এখনও নেয়নি ইরান। তবে এখন যা ঘটেছে, তা তেহরানের কট্টরপন্থীদের এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য করবে।
ইরান বহুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সমরাস্ত্র দিয়ে মিত্রতা তৈরি করেছে। পুরো এই বাহিনীকে বলা হয় ‘প্রতিরোধের অক্ষ’।
ইরানের মিত্র হিসেবে লেবাননে হিজবুল্লাহ ছাড়াও ইয়েমেনে হুতিরা এবং বহু ছোট ছোট গ্রুপ আছে সিরিয়া ও ইরাকে। বাগদাদের নেতৃত্ব এখন চাইলে তার অধীন এসব ছোট দলগুলোকে ওই অঞ্চলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে বলতে পারে।
তবে ইরান যে প্রতিক্রিয়াই বেছে নিক না কেন, এটি সম্ভবত এমন একটি যুদ্ধের সূচনা করবে যা জয়-পরাজয়ের চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক।
ইসরায়েল কী করবে
ইসরায়েল স্পষ্টতই তার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২ দেশের প্রস্তাবিত ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ করবে না।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী মনে করে, হিজবুল্লাহ এখন কিছুটা ‘ব্যাক ফুটে’ আছে। এমন অবস্থায় গোষ্ঠীটির কাছে থাকা ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি মোকাবেলায় হামলা অব্যাহত রাখতে চায় তারা।
হিজবুল্লাহ আত্মসমর্পণ করবে, এমনটা আশা করা যায় না। কিন্তু ইসরায়েল লেবাননে পদাতিক সৈন্য না পাঠিয়ে কীভাবে হিজবুল্লাহর মোকাবেলা করবে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডএফ) অবশ্য এরই মধ্যে লেবানন সীমান্তের কাছে তাদের পদাতিক বাহিনীর অবস্থানের ছবি প্রকাশ করেছে।
কিন্তু হিজবুল্লাহ সহজেই ইসরায়েলকে ছেড়ে দেবে, এমনটা ভাবা মুশকিল। কারণ গত ১৮ বছর ধরে দলটির যোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে। হিজবুল্লাহ নেতা নাসরাল্লাহ তার শেষ ভাষণে বলেছিলেন, “দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলি অনুপ্রবেশ হবে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ।”
বিবিসি বলছে, আইডিএফের পক্ষে লেবাননে প্রবেশ করা সহজ হবে। কিন্তু সেখান থেকে বের হওয়া সহজ হবে না। কারণ গাজা থেকে এখনও বের হতে পারেনি ইসরায়েলি সেনারা।