Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

নির্ভেজাল নির্বাচনের জন্য চাই কী

গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আনসার বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে যান ভোট কেন্দ্রে। ফাইল ছবি : হারুন অর রশীদ
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আনসার বাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে যান ভোট কেন্দ্রে। ফাইল ছবি : হারুন অর রশীদ
Picture of খাইরুল বাশার

খাইরুল বাশার

সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবে কতটা? প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বারবারই এই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে।

সমস্যাটি কি আইনে? হ্যাঁ- এই উত্তর আসছে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে। তার মতে, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন।

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সদ্য বিদায় নেওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলেছেন। নির্বাচনকালীন সরকার হিসাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে শ্রেয় ভাবছেন তিনি, যা সংবিধানে এক সময় থাকলেও এখন নেই।

তাহলে কি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আইন বড় সমস্যা নয়? স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলছেন সেই কথাটি। তার মতে, বিদ্যমান আইন ঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলেই অবাধ নির্বাচন সম্ভব।

তবে নির্বাচনটি করার দায়িত্ব যাদের ওপর বর্তায়, তাদের নিয়োগটি যথাযথ হওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে আসা বদিউল আলম মজুমদার।  

তার মতে, আওয়ামী লীগের করা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইনটি সংস্কার করা দরকার, যেন দলবাজ কেউ স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ না পায়।

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, “নির্বাচন কমিশন দায়িত্বপালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।”

নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে যে আইনটি কার্যকর হয়, তা হচ্ছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত এই আইন বিভিন্ন সময় সংস্কার হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন তার সচিবালয় পরিচালনা করে ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন’র মাধ্যমে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আমলে প্রণীত এই আইনে লেখা আছে, “নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সরকারের কোনও মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা দপ্তরের প্রশাসনিক আওতাধীন থাকিবে না।”

নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইনটি হয়েছে আওয়ামী লীগ আমলে ২০২২ সালে। এই আইনেই প্রথম গঠিত হয় কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন, যারাও সমালোচনা থেকে রেহাই পায়নি।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক মাস পর গত ৫ সেপ্টেম্বর এই কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগ করে।

বাংলাদেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংকটে সরকার বদলের পর ইসিতেও পরিবর্তনের ঘটনা স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

কিন্তু পাশের দেশ ভারত বাংলাদেশের মতোই সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ হলেও সেখানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেখা যায় না। সেখানে দলীয় সরকার রেখেই নির্বাচন হয়।

তাহলে বাংলাদেশে নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে, সেই প্রশ্ন বিভিন্ন সময়ে এসেছে এবং এখনও আসছে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

বাংলাদেশে দলীয় সরকারকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অন্তরায় বিবেচনা করে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।

দুটি নির্বাচন তেমন সরকারের অধীনে হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয়টিতে এসে আবার সেই ব্যবস্থাও পড়ে প্রশ্নের মুখে। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছিল। এরপর ‘নির্বাচন কমিশন স্বাধীন’ বলে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছিল, তার কোনোটি মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে বাদ দেওয়ার আগে অবশ্য সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায় এসেছিল; যেখানে নির্বাচনকালীন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পদ্ধতিকে সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলা হয়েছিল।

কিন্তু আন্দোলনে সরকার পরিবর্তনের পর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ফিরেছে বাংলাদেশে। আর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন এই সরকার রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্কার আনতে চাইছে, যেখানে নির্বাচন কমিশনও বাদ থাকছে না।

সেই সংস্কারটি কী হতে পারে, যা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথটি তৈরি করে দিতে পারে?

আইনে ‘স্বাধীনতা নেই’

রফিকুল ইসলাম।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে অনেক ফাঁক রয়েছে দাবি করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এসব আইন কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব করেছে।

“আইনের মধ্যে স্বাধীনতা নাই। আইনগুলো পরাধীন। আইনগুলোতে ফাঁক-ফোকর।”

সাবেক সচিব রফিকুল ২০১৭ সালে গঠিত কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে তাদের অধীনে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকলেও ফল ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনটি পরিবর্তনের সুপারিশ তুলে রফিকুল বলেন, “এই আইন অনুযায়ী কমিশনাররা কোনও বিষয়ই আলোচনায় যুক্ত করতে পারেন না, যদি সিইসি ও সচিব এগ্রি না করে।”

নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের পঞ্চম অনুচ্ছেদে বলা আছে- “নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সচিব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হইবেন।

“সচিব নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের প্রশাসন, শৃঙ্খলা বিধান এবং সচিবালয়ের উপর অর্পিত কার্যাদি যথাযথভাবে সম্পাদন করিবেন। তিনি এই আইন এবং তদধীন প্রণীত বিধিমালার অধীন বিধানাবলীর যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করিবেন এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সচিবালয়ের কার্যাদি সম্পর্কে সময়ে সময়ে অবহিত করিবেন।”

আইনের এই ধারাটি ক্ষমতা কমিশনে সিইসি ও সচিবের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করেছে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল।

কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময় লক্ষ্মীপুরের দুই ওসিকে বদলি করতে চাইলেও তা পারেননি বলে জানান তিনি।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ নিয়ে রফিকুল বলেন, “আরপিওর ৩৯ অনুচ্ছেদ, আবার প্রত্যেকটাতে অদ্ভূত প্রভিশন আছে। সারাদেশে উপজেলা ভোটকেন্দ্র থেকে যে ফলাফল আসবে, আমাকে সেটা গেজেট করে দিতে হবে। একটা প্রশ্ন তোলার ‍সুযোগ নাই?”

এই আইন সংস্কারের সুপারিশ রেখে তিনি বলেন, “প্রত্যেকটা ধারাকে এমনভাবে আনতে হবে, যাতে কম্পোজিট বডি হিসাবে ফাংশন করতে পারে। ৩৯ ধারা রেখে হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। ৯১ ধারায় হাত পা বেঁধে রেখেছে।”

তবে দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে নির্বাচন কমিশনের কোনও কর্তৃত্ব থাকে না, সার্বিকভাবে এটা মনে করেন রফিকুল।

তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের যে মানসিকতা ও আইনি কাঠামো, তাতে কিচ্ছু করার নাই। মাঠ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যারাই রয়েছে, তারা জানে যে আমাদের কোনও ক্ষমতা নাই।”

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন রফিকুল।

তিনি বলেন, “দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র ফেরাতে হবে। যেটা দলের অভ্যন্তরে চর্চা করতে হবে। নির্বাচন কমিশনে গণতন্ত্র ফেরাতে হবে।”

তবে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র বাংলাদেশে খাটবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান রফিকুল।

তিনি বলেন, “কোনও মুসলিম দেশেই গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারেনি। সত্যিই গণতন্ত্র উপকারী কি না, তা ভেবে দেখা দরকার আছে। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড থেকে (গণতন্ত্র) রপ্তানি করেছি, কিন্তু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার বিষয়টি ভেবে দেখার দরকার আছে।”

আইনে ‘বড় সংকট নেই’

তোফায়েল আহমেদ।

আইনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ওনারা কী করেছে? আঠারোর (২০১৮) ভোট করেছে। পদত্যাগ করে নাই কেন? এগুলো বলে লাভ নাই। ওই আমলের সাবেকদের সবাই জ্বী হুজুর স্যার।”

ইসিতে দায়িত্বকালে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে রফিকুল বলেন, “তাহলে আমরা কী করব? পদত্যাগ? বাংলাদেশের যে অবস্থা, দেশ ছাড়তে হয়। দেশে ছেড়ে যাব কোথায়? আমাদের ছেলে-মেয়েদের কী হবে? না খেয়ে মরবে?”

অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “আইনের সংকট আছে, তবে বড় ধরনের কোনও সংকট নেই। যে আইন এখন আছে, এই আইনের মধ্যে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব। যদি সৎ ও যোগ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি দায়িত্বে আসে।”

নির্বাচনের সময় কোন সরকার ক্ষমতায় থাকছে, সেটাই বড় বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

“নতুন সরকার আসছে। নির্বাচন ভালো হবে। নির্দলীয় সরকার যে কাউকে বসিয়ে দিলে ভোট ভালো হবে। এক্স, ওয়াই, জেড- যে কেউ বসুক।”

তবে আইনের যে সংকট আছে, সেখানে সংস্কার করা যায় বলেও মনে করেন তিনি।

নিয়োগের আইনে ‘সংস্কার চাই’

বদিউল আলম মজুমদার।

নির্বাচন পরিচালনা যারা করবে, তাদের নিয়োগের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংস্কার চাইছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।

কে এম নূরুল হুদা কমিশনকে ইঙ্গিত করে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দিনের আলোয় তারা ভোট চুরি করেছে। দলবাজি করেছে।

“নির্বাচন কমিশনে যাদেরকে নিয়োগ দিয়েছে, তাদের অসততা, দলবাজি, অনৈতিকতা ও স্বার্থপরতা দায়ী দেশের নির্বাচনের এই অবস্থার জন্য।”

বদিউল আলম বলেন, “নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন সংস্কার প্রয়োজন। যাদেরেকে নিয়োগ দিয়ে সার্চ কমিটি করা হয়, তারাই দলবাজ। সার্চ কমিটির গঠনে পরিবর্তন আনা দরকার।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত