Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

জে এম সেন হলের পূজামণ্ডপে আসলে কী হয়েছিল

চট্টগামের ঐতিহ্যবাহী জে এম সেন হল, ১৯২০ সালে যে অডিটোরিয়ামটির উদ্বোধন করা হয়েছিল। ছবি : সংগৃহীত
চট্টগামের ঐতিহ্যবাহী জে এম সেন হল, ১৯২০ সালে যে অডিটোরিয়ামটির উদ্বোধন করা হয়েছিল। ছবি : সংগৃহীত
[publishpress_authors_box]

গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সব জায়গায় এখন আলোচনায় রয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জে এম সেন হলের পূজা উৎসব।

বৃহস্পতিবার রাতে এই পূজামণ্ডপের অনুষ্ঠান মঞ্চে উঠে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করেন চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির কয়েকজন শিল্পী। মুহূর্তেই সেই গানের ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে অন্তর্জালে, শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা-বিশ্লেষণ।

এ ঘটনার পর বিক্ষোভ করেন চট্টগ্রামের স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাতেই ছুটে যান জেলা প্রশাসক, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের আশ্বাসে শান্ত হন স্থানীয়রা, তবে রাতভর ফেইসবুক জুড়ে চলে বিচার-বিশ্লেষণ।

আসলে কী হয়েছিল সেখানে? কেন বা কী উদ্দেশ্যে দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে ইসলামি গান গাইতে মঞ্চে উঠেছিলেন ওই শিল্পীরা? কী তাদের পরিচয়?

সকাল সন্ধ্যার এই প্রতিবেদনে আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।

ঘটনাক্রম

শারদীয় দুর্গা উৎসবে বৃহস্পতিবার ছিল মহাসপ্তমী। চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ এলাকার প্রাচীন যাত্রা মোহন সেন (জে এম সেন) হলে বরাবরের মতো আয়োজন করা হয়েছে দুর্গাপূজার। সাজানো হয়েছে মণ্ডপ, তৈরি হয়েছে অনুষ্ঠান মঞ্চও।

সন্ধ্যা ৭টায় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক এবং আদালতের রায়ে সদ্য মেয়র পদ ফিরে পাওয়া ডা. শাহাদাত হোসেনের। তখনও তিনি আসেননি।

পূজা উদযাপন পরিষদের এক সংগঠক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সন্ধ্যা ৭টায় বংশী শিল্পী গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন গান পরিবেশন শেষ করে। এসময় চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির ছয় যুবক এসে দেশাত্নবোধক গান গাওয়ার কথা বলে মঞ্চে উঠার অনুরোধ জানায়। মঞ্চের কাছেই ছিলেন পূজা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক সজল দত্ত। পরে তার সহযোগিতায় পাঞ্জাবি পরিহিত ছয় জন মঞ্চে উঠে দুটি গান পরিবেশন করে কোনও বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই।”

সেখানে উপস্থিত ছিলেন টেলিভিশন চ্যানেলের এক সিনিয়র সংবাদকর্মী। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন মণ্ডপ পরিদর্শনে আসবেন বলেই মূলত আমরা তার নিউজ কভার করতে গিয়েছিলাম। ৭টা পার হয়ে গেলেও তিনি আসেননি। পরে আমরা জে এম সেন হলের গেইটে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।

“এমন সময় দেখি ভেতর থেকে ইসলামি গান ভেসে আসছে! নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না! পরে স্টেজের কাছে গিয়ে দেখি গজল চলছে কিন্তু যারা গাইছেন তারা পরিচিত কেউ নন। পরে আমি নিজেই ভিডিও করে রাখি।”

দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে গাওয়া হচ্ছে ইসলামি গান। ছবি : সংগৃহীত
দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে গাওয়া হচ্ছে ইসলামি গান। ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রামভিত্তিক অনলাইনের আরেক সাংবাদিকও সেই ঘটনার ভিডিও নিজেদের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুকে প্রকাশ করেছেন।

তিনি জানান, প্রথমে ওই শিল্পীরা শাহ আব্দুল করিমের ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গানটি পরিবেশন করেন। এরপর ‘শুধু মুসলমানের জন্য আসেনিকো ইসলাম’ গানটি গেয়ে শোনান।

এসময় মঞ্চের সামনে দর্শক সারিতে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন বলে যে আলোচনা উঠেছে তা নাকচ করে দেন তিনি।

এই সাংবাদিক বলেন, “মধ্যম সারির কয়েকজন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাতের আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দর্শক সারিতে প্রচুর সনাতন ধর্মাবলম্বী উপস্থিত থাকলেও তারা ওই গান শোনার প্রতি আগ্রহ দেখাননি। বেশিরভাগই নিজেদের মতো কথা বলছিলেন, ছবি তুলছিলেন বা অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আবার অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন, তবে সে মুহূর্তেই কাউকে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি।”

সেখানে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গানের শেষ লাইনে ছিল ইসলামি বিপ্লবের কথা। এটা শোনার পরই উপস্থিত এক বিএনপি নেতাকে পূজা পরিষদ নেতাদের কানে কানে কিছু বলতে দেখা যায়। এরপরই গান শেষে ওই ছয় শিল্পী মঞ্চ থেকে নেমে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।”

আলোচনায় চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি

এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হতেই আলোচনায় আসে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমি।

জামায়াতপন্থী ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবেই চট্টগ্রাম শহরে তারা পরিচিতি। ইসলামি ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের গান গাইতে দেখা যায়।

জে এম সেন হলের মঞ্চে যারা গান পরিবেশন করেন তাদের মধ্যে দুজন পাঞ্জেরি শিল্পগোষ্ঠী এবং একজন পারাবার শিল্পগোষ্ঠীর সদস্য।

যদিও ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার মধ্যে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির সঙ্গে কোনও ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম লিখেছেন, “এই ঘটনার সঙ্গে অনেকেই ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছেন। আমি দায় নিয়ে বলছি, এর সঙ্গে ছাত্রশিবিরের কোনও সম্পৃক্ততা নেই। শিবির কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কাজ কখনোই সমর্থন করে না। তাই এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।”

যে গানটি গাওয়া নিয়ে বিতর্ক উঠেছে তার গীতিকার সুরকার চৌধুরী আবদুল হালিম।

তিনি ১৯৯৭-৯৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রোকন পদেও ছিলেন।

ছাত্রশিবিরের সাংস্কৃতিক সংগঠন পাঞ্জেরি শিল্পগোষ্ঠী এই গানটি নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে।

সজল দত্ত কি গজল গাইতে দাওয়াত দিয়েছিলেন

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি পূজামণ্ডপের মঞ্চে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির সদস্যরা কীভাবে উঠলেন এবং গান গেয়ে শোনালেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। অভিযোগ উঠেছে, পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক তাদের গজল গাইবার জন্য দাওয়াত দিয়েছেন।

খোদ পূজা উদযাপন পরিষদ নেতারা বলছেন, এই সংগঠনের শিল্পীদের গান গাওয়ার কোনও শিডিউল বৃহস্পতিবার ছিল না। ফলে তাদের দাওয়াত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

তবে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির সভাপতি সেলিম জামানের দাবি, পূজা উদযাপন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সজল দত্তের আমন্ত্রণেই তাদের একটি দল পূজামণ্ডপে গান করতে গিয়েছিল। সেখানে যে দুটি গান পরিবেশন করা হয়েছে, দুটিই সম্প্রীতির সংগীত। কেউ কেউ ভিডিও এডিট করে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

তবে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া ওই অনুষ্ঠানের ভিডিও যাচাই করে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার তাদের ফেইসবুক পেইজে জানিয়েছে, গানের ভিডিওটি আসল, এডিটেড নয়।

এ বিষয়ে সজল দত্তের বক্তব্য জানা যায়নি। কারণ ঘটনার পর থেকেই তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

তবে পূজা উদযাপন পরিষদের একাধিক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, কাউকে তারা দাওয়াত দেননি।

এক নেতা বলেন, “তাদের কাউকেই দাওয়াত দিয়ে আনা হয়নি। একদল লোক জে এম সেন হলে এসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার আবদার করে। পরে সজল দত্তের সহযোগিতায় তারা মঞ্চে ওঠেন। প্রথম গানটি ঠিক ছিল। পরে শুরু করে ইসলামি বিপ্লবের গান।

“এটা আসলে পরিকল্পনা করেই তারা করেছে। আগে চট্টগ্রাম কলেজের মাহফিলে মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করত। এবার তার থেকে আধ কিলোমিটার দূরের জে এম সেন হলে এসে নতুন কৌশল প্রয়োগ করে পাবলিক সেন্টিমেন্ট যাচাই করে দেখল।”

ঘটনাস্থলে উপস্থিত জুয়েল আইচ অর্ক নামে এক যুবক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা নিজেরাও চাই না হিন্দুদের পূজামণ্ডপে এসে কেউ গজল পরিবেশন করুন, আবার মাহফিলে গিয়ে কেউ গীতা পাঠ করুক। আমরা চাই সম্প্রীতির বাংলাদেশ যে যার ধর্ম পালন করবে নির্ভয়ে।

“যেটা হয়েছে তা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে। এই কাজটা যাতে দ্বিতীয় বার করার কেউ সাহস না পায় সেজন্য প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।”

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইসকন পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, পূজার মঞ্চে উঠে এই ধরনের ইসলামি দাওয়াত দিয়ে গজল গাওয়া সামগ্রিক সৌন্দর্য্য এবং মর্যাদাকে অবমাননার শামিল। এজন্য এই ঘটনায় জড়িতদের শুক্রবার সন্ধ্যার মধ্যে গ্রেপ্তারের আলটিমেটাম দেন তিনি।

সবশেষ পাওয়া খবর হলো, এ ঘটনায় দুজনকে আটক করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ।

শুক্রবার দুপুরে দামপাড়া পুলিশ লাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, আটক দুজন হলেন- তানজিমুল উম্মাহ মাদ্রাসার শিক্ষক শহীদুল করিম ও দারুল ইরফান একাডেমির শিক্ষক নুরুল ইসলাম।

বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর আলাদা স্থান থেকে তাদের আটক করা হয়। এখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপকমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) রইছ উদ্দিন বলেন, “এই ঘটনার পেছনে কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

এই ঘটনায় একটি মামলা করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত