Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫

বেঁচে আছেন সেই আওয়ামী লীগ নেতা, দিলেন হেনস্থার বর্ণনা

বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে হামলার শিকার হন আবদুল কুদ্দুস মাখন।
বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে হামলার শিকার হন আবদুল কুদ্দুস মাখন।
[publishpress_authors_box]

১৫ আগস্ট সকালে ঢাকার ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হেনস্থার শিকার শেরপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন।

বৃহস্পতিবার সকালে তাকে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে প্রকাশ্যে শারীরিক লাঞ্ছনা ও মারধরের ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর তা নিয়ে সমালোচনা চলছে।

তিনি মারা গেছেন বলে খবরও ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে শুক্রবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি বেঁচে আছেন। চিকিৎসক তাকে ব্যথানাশক ওষুধ দিয়েছেন।

মাখন নব্বইয়ের দশকে ময়মনসিংহ পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ঢাকায় মোহাম্মদপুরে শিয়া মসজিদ এলাকায় থাকেন কুদ্দুস।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতেন পর ছন্নছাড়া অবস্থায় আছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনটি এতদিন জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন হলেও নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই দিনের ছুটি বাতিল করেছে।

ভারতে থাকা শেখ হাসিনা তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালনে দলীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে থাকা এক দল বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে অবস্থায় নেয়। তারা যাকেই আওয়ামী লীগ সন্দেহ করেছে, তাকেই মারধর ও হেনস্থা করে। তখনই সেখানে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন কুদ্দুস।

সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম এরই মধ্যে ৩২ নম্বরের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, এই ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেউ জড়িত ছিলেন না।

কী ঘটেছিল

১৫ আগস্ট সকাল ৭টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের উদ্দেশে রওনা দেন আব্দুল কুদ্দুস মাখন। অটোরিকশাটি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের উল্টো দিকে নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের সামনে পৌঁছলে কয়েকজন সেটি আটকায়।

আবদুল কুদ্দুস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তাদের কেউই শিক্ষার্থীদের মতো নয়। একজনের তো চুল-দাড়ি পাকা ছিল। তারা আমার পরিচয় জানতে চাইলে ভয়ে আমি বলি, স্কয়ার হাসপাতালে যাচ্ছি। এটা বলার পরও তারা আমার মোবাইল ফোন চেক করে। বুঝতে পারে, আমি আওয়ামী লীগের লোক।

“এসময় একজন আমাকে গালাগাল করে কলার ধরে টেনে নামায়। আমার ব্যাকপেইনের সমস্যা থাকায় আমি কোমরে বেল্ট পরেছিলাম। তারা আমাকে রাসেল স্কয়ারের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে আমার বেল্ট দিয়েই আমাকে একটি পিলারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। এরপর কয়েকজন লাঠি দিয়ে আমার পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত করতে থাকে।

“সেখানে ৪০-৫০ জন মানুষ ছিল। তাদের কেউ কেউ বলতে থাকে, ‘গোঁফ কেটে দাও’, ‘মাথা ন্যাড়া করে দাও’। কেউ কেউ আমাকে মেরে ফেলতে বলে। তখন আমার অবস্থা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এরমধ্যে ২/১ জন শিক্ষার্থী আসে। তাদের একজন আমার মোবাইল ফোন চেক করে। আমি ফেসবুকে ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী লেখা লিখি। এসব দেখে সে বলে, ‘আরে, উনি তো ভালো মানুষ। উনাকে ছেড়ে দেন।’ এই কথা বলে ওই শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন আমার হাতে দেয়। তবে ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন আমার হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়।”

আবদুল কুদ্দুস বলেন, “প্রায় আধা ঘণ্টা নির্যাতন চালানোর পর ওই শিক্ষার্থীর কথায় আমার কোমরের বাঁধন খুলে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়। এসময় হঠাৎ কয়েকজন আমার পাজামা-পাঞ্জাবি একটানে খুলে ফেলে। এসময় শিক্ষার্থীরা সংখ্যায় কম থাকায় হামলাকারীদের বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। এরপর কয়েকজন আমাকে মারধর শুরু করলে আরেক শিক্ষার্থী আমাকে একটি রিকশায় তুলে দেয়। আমার মানিব্যাগে আড়াই হাজার টাকা ছিল। সেটি বের করে আমার হাতে দেয়। রিকশা চলতে শুরু করলে আবারও কয়েকজন আমাকে মারতে থাকলে আরেক শিক্ষার্থী রিকশায় উঠে আমার পাশে বসে। সে না উঠলে আমাকে আরও মার খেতে হতো। ওই ঘটনারই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।”

“এরপর ওই শিক্ষার্থী আমাকে কিছুটা পথ এগিয়ে দেয়। এরই মধ্যে আমি রিকশাওয়ালার কাছ থেকে গামছা নিয়ে গায়ে জড়াই। কিন্তু শিক্ষার্থীটি রিকশা থেকে নেমে যাওয়ার পর সোবহানবাগ মসজিদের আগে আবারও কয়েকজন আমাকে আটকায়। তারা আমার হাতে থাকা টাকা ও গামছা কেড়ে নেয়। এসময় রিকশাচালক ভয়ে আমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে দেয়। পরে এক সিএনজিচালক আমাকে তুলে নিয়ে তার গামছাটি আমাকে দেয়। পরে সে আমাকে মোহাম্মদপুরের বাসায় পৌঁছায়।”

“সব মিলিয়ে আমাকে ৪০ মিনিটের মতো অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। যখন সিএনজিতে উঠি তখন বাজে ৮টা ৫,” বলেন কুদ্দুস।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় অন্তত ২০ জনকে মারধর ও আটক করে ছাত্র-জনতার একটি দল।
১৫ আগস্ট ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে আওয়ামী লীগ সন্দেহে অনেককে মারধর করা হয়। ছবি : হারুন অর রশীদ

শারীরিক অবস্থা 

আব্দুল কুদ্দুস এখন মোহাম্মদপুরে নিজের বাসাতেই আছেন।

তিনি বলেন, “এখন সুস্থ আছি মোটামুটি। তবে লাঠির আঘাতের কারণে শরীরের কয়েক জায়গায় কালচে দাগ পড়ে গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে পেইন কিলার খাচ্ছি।”

কুদ্দুস বলেন, “আমার ওপর হামলার ঘটনা ফেইসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। তাই অনেক ফোন আসছে। অনেকেই আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাদের ধন্যবাদ জানাই।

“তবে অনেকে আমার ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। আমি এটার নিন্দা জানাই। আমি দল নয়, ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে ৩২ নম্বর যেতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে সম্ভব হলে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাব, না হলে ফিরে আসব। জানতাম সেখানে ঝামেলা হবে, এজন্য সঙ্গে কোনও ফুল নিয়ে যাইনি। এরপরও তারা আমাকে আটকে নির্যাতন করল।”

“আমাকে নির্যাতনকারীদের কাউকে কিন্তু শিক্ষার্থী মনে হয়নি। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে,” বলেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

তার দল ক্ষমতায় থাকার সময়ও অভিযোগ করছিল, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের নামা শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে একটি মহল সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

সেই আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোর অবস্থান ব্যাপক সহিংসতা তৈরি করে, তাতে কয়েকশ মানুষ প্রাণ হারায়। ৩৬ দিনের এই আন্দোলন গণবিক্ষোভে রূপ নিলে তাতে ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।

নির্যাতনের ঘটনায় থানায় কোনও অভিযোগ করেননি আব্দুল কুদ্দুস। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “দেশের এই পরিস্থিতিতে কার কাছে গিয়ে অভিযোগ করব? আপাতত নিরাপত্তার জন্য কয়েকদিন বাসা থেকে বের হব না।”

‘একাত্তরে প্রশিক্ষণ নিয়েছি’

ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুস মাখনের দাবি, ১৯৭১ সালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছিলেন তিনি। অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। তবে তবে সার্টিফিকেট নেননি। 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম। বয়স ছিল ১২-১৩। শেরপুরের নকলা উপজেলার খাগডহর গ্রামে আমাদের বাড়ির পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি চিকিৎসা ক্যাম্প ছিল। আমার বাবা প্রয়াত আলহাজ্ব আবদুল হাই সেখানে চিকিৎসা দিতেন। সেসময় প্রচণ্ড চিকিৎসক সঙ্কট ছিল। 

“বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে ইনজেকশন পুশ করা, ব্যান্ডেজ করার মতো ছোটখাটো জিনিস শিখে ফেলেছিলাম। তখন জরুরি মূহূর্তে আমিও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের এসব সেবা দিতাম। এই করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। পরে তাদের সঙ্গে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও নিয়েছি।”

২০১৮ সালে শেরপুরের নকলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কুদ্দুস। তখন তার কাছে মাদক ও জাল টাকা পাওয়ার কথা পুলিশ জানিয়েছিল।

তবে কুদ্দুস দাবি করেন, দলীয় রাজনীতিতে বিরোধের কারণে তখন তাকে ফাঁসানো হয়েছিল।

নিজ এলাকায় কুদ্দুসের সঙ্গে শেরপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরীর অনুসারীদের বিরোধ রয়েছে। তার জের ধরে তাকে প্রতিহিংসার শিকার হতে হয় বলে দাবি কুদ্দুসের।   

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত