Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

উন্নত এআই প্রযুক্তি ভুল হাতে পড়লে কী হবে

AI_Risks
[publishpress_authors_box]

চীন ও রাশিয়া যাতে উন্নত এআই তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলগুলো না পায় সেজন্য একটি নতুন ফ্রন্ট খুলছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উন্নত এআই মডেলগুলোকে ঘিরে একটি কঠোর সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রাথমিক পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ও বেসরকারি খাতের গবেষকদের আশঙ্কা, প্রতিপক্ষ উন্নত এআই মডেল ব্যবহার করে দেশটির ওপর আগ্রাসী সাইবার হামলা চালাতে পারে। এমনকি শক্তিশালী জৈব অস্ত্র তৈরিতেও ব্যবহার করতে পারে।

উন্নত এআই প্রযুক্তির ভুল হাতে পড়ার ঝুঁকিগুলো হলো:

ডিপফেক ও ভুয়া তথ্য

প্রচুর অনলাইন ফুটেজের উপর প্রশিক্ষিত এআই অ্যালগরিদম দিয়ে তৈরি বাস্তবের মতো করে বানানো ভুয়া ছবি বা ভিডিওকে বলা হয় ডিপফেক। একজনের শরীরের সঙ্গে আরেকজনের মুখ জুড়ে দিয়ে বানানো হয় ডিপফেক ছবি বা ভিডিও। কেউ যা বলেনি তাও তার মুখ দিয়ে বলানো হয়।

এআই প্রযুক্তি দিয়ে হুবহু নকল ছবি বা ভিডিও বানানো সম্ভব হচ্ছে। মেশিন লার্নিং প্রয়োগের মাধ্যমে দিন দিন প্রযুক্তিটি আরও উন্নত হচ্ছে এবং আরও নিখুঁতভাবে নকল ভিডিও বানানো যাচ্ছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো প্রচুর ডিপফেক ছবি ও ভিডিও যুক্তরাষ্ট্রের বিভাজিত রাজনীতিতে সত্য ও কল্পকাহিনীকে এক করে ফেলছে। কারণ এখনও এমন কোনও প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি, যা দিয়ে সাধারণ মানুষ ডিপফেক ও আসল ছবি বা ভিডিওর পার্থক্য বুঝতে পারবেন।

ডিপফেক প্রযুক্তি বেশ কয়েক বছরের পুরনো হলেও গত এক বছরে বেশ কিছু নতুন এবং আরও উন্নত জেনারেটিভ এআই টুলের সুবাদে এর সক্ষমতা রকেট গতিতে বেড়েছে। এরকমই একটি টুলের নাম মিডজার্নি। এটি ব্যবহার করে অনেক কম খরচে এবং সহজেই বিশ্বাসযোগ্য ডিপফেক ছবি বা ভিডিও তৈরি করা যায়।

গত মার্চে এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা বলেছেন, দেশটির নির্বাচনকে সামনে রেখে ভুয়া তথ্য প্রচারে ওপেনএআই ও মাইক্রোসফটসহ বিভিন্ন কোম্পানির এআই টুলগুলো দিয়ে ভুয়া ছবি ও ভিডিও বানানো হতে পারে। বাস্তব সংবাদ নিবন্ধগুলোর নকল করে মিথ্যা তথ্য প্রচার চালানোর জন্যও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়।

মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট তৈরির বিরুদ্ধে কোম্পানিগুলোর কঠোর নীতিমালা রয়েছে। ফেসবুক, এক্স (টুইটার) ও ইউটিউবের মতো সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোও ডিপফেক ছবি ও ভিডিও নিষিদ্ধ এবং অপসারণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের পক্ষে সবসময় সব ভুয়া কনটেন্ট সরানো সম্ভব নাও হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, গত বছর চীন সরকার-নিয়ন্ত্রিত একটি নিউজ সাইট একটি জেনারেটিভ এআই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনেক আগে প্রচারিত একটি মিথ্যা তথ্যকে নতুন করে ছড়িয়ে দেয়। ওই ভুয়া কনটেন্টে দাবি করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র কাজাখস্তানে একটি গোপন ল্যাবে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য জৈব অস্ত্র তৈরি করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (ডিএইচএস) তাদের ২০২৪ সালের স্বরাষ্ট্র নিরাপত্তা হুমকি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরে।

জৈব অস্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সম্প্রদায় থেকে শুরু করে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও শিক্ষাবিদরাও ভিনদেশি দুর্বৃত্ত কর্তাসত্ত্বার উন্নত এআই সক্ষমতা অর্জনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। গবেষণা সংস্থা গ্রাইফোন সায়েন্টিফিক ও র‌্যান্ড করপোরেশন বলেছে, উন্নত এআই মডেলের মাধ্যমে জৈব অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানগত তথ্যও সংগ্রহ করা সম্ভব।

গ্রাইফোনের গবেষণায় দেখা গেছে, লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল বা বড় ভাষা মডেল (এলএলএম) তথা যে কম্পিউটার প্রোগ্রাম ইন্টারনেটে থাকা বিশাল তথ্যের ভাণ্ডার থেকে সারসংক্ষেপ করে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে, তা ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা বিজ্ঞানকে অসৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে পারে। এর মাধ্যমে তারা জৈব অস্ত্র তৈরি করার জন্য প্রতিটি ধাপে দরকারি তথ্যও নির্ভুল ও বিশদভাবে পেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় তারা দেখতে পান, একটি এলএলএম ব্যবহার করে মহামারি-সক্ষম ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সময় সমস্যা সমাধানের জন্য পোস্ট-ডক্টোরাল তথা সর্বোচ্চ স্তরের জ্ঞান অর্জন সম্ভব।

র‌্যান্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, জৈব-রাসায়নিক হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নেও সাহায্য করতে পারে এলএলএম। উদাহরণস্বরূপ, তারা দেখতে পান যে, এলএলএম ব্যবহার করে বোটুলিনাম টক্সিনের অ্যারোসল ডেলিভারি পদ্ধতি শেখা সম্ভব।

সাইবার অস্ত্র

এআই ব্যবহার করে এমন নতুন টুল তৈরি করা সম্ভব যা দিয়ে বড় আকারে, অনেক দ্রুততা ও দক্ষতার সঙ্গে এবং আরও অলক্ষ্যে সাইবার হামলা চালানো যাবে। এই ধরনের হামলা চালিয়ে তেলের পাইপলাইন ও রেলওয়েসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো অচল করে দেওয়াও সম্ভব।

গবেষকরা বলছেন, উন্নত এআই মডেলের মাধ্যমে জৈব অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানগত তথ্যও সংগ্রহ করা সম্ভব।

যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের (ডিএইচএস) ২০২৪ সালের স্বরাষ্ট্র নিরাপত্তা হুমকি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

ডিএইচএস বলে, চীন ও অন্যান্য প্রতিপক্ষরা ম্যালওয়্যার আক্রমণে সহায়ক জেনারেটিভ এআই প্রোগ্রামসহ এমন এআই প্রযুক্তি তৈরি করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার প্রতিরক্ষাকেও দুর্বল করে দিতে পারবে।

মাইক্রোসফট ফেব্রুয়ারির একটি প্রতিবেদনে বলছে, তারা চীন ও উত্তর কোরিয়ার সরকারের পাশাপাশি রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ও ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হ্যাকিং গ্রুপগুলোকে ট্র্যাক করেছে। গ্রুপগুলো বড় ভাষা মডেল (এলএলএম) ব্যবহার করে তাদের হ্যাকিং অভিযানগুলো নিখুঁত করার চেষ্টা করছিল।

মাইক্রোসফট পরে রাষ্ট্র-সমর্থিত হ্যাকিং গ্রুপগুলোর জন্য তাদের এআই পণ্য ব্যবহার করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে।

উন্নত এআই প্রযুক্তির রপ্তানি ঠেকাতে আইনের প্রস্তাব

যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও বিরোধীদলীয় আইন প্রণেতারা যৌথভাবে বুধবার দেশটির পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করে। বিলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবান প্রযুক্তিকে সুরক্ষিত করার জন্য এআই মডেলগুলোর রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপে আইন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এমন কোনও এআই সিস্টেম তৈরিতে বিদেশিদের সঙ্গে দেশটির নাগরিকদের কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তাবও করা হয়।

ওয়াশিংটনের ডিএলএ পাইপারের এআই নীতি উপদেষ্টা টনি স্যাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা এআই প্রযুক্তির ঝুঁকিগুলো মোকাবেলার চেষ্টার পাশাপাশি উদ্ভাবনকে দমিয়ে রাখতে পারে এমন কঠোর নিয়ন্ত্রণ এড়ানোর চেষ্টা করছেন।

তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে নতুন ওষুধ আবিষ্কার, অবকাঠামো, জাতীয় নিরাপত্তা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অগ্রগতিগুলো বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ ছাড়া বিদেশি প্রতিযোগীরা যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলতে পারে।

ফেসবুক, এক্স ও ইউটিউবের মতো সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোও ডিপফেক ছবি ও ভিডিও নিষিদ্ধ এবং অপসারণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনের অধীনে দেশটির রপ্তানি নীতির তত্ত্বাবধানকারী বাণিজ্য বিভাগের পক্ষে ওপেন সোর্স এআই মডেলের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ওপেন সোর্স এআই বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়।

আর এই সুযোগে চীন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত এআই প্রযুক্তিগুলোর নকল করে নিজেদের এআই প্রযুক্তি তৈরি করছে।

মার্চে চীনের একটি উচ্চ-স্তরের গবেষণা ল্যাব বেইজিং একাডেমি অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের উদ্ধৃতি দিয়ে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, দেশটির বেশিরভাগ এআই মডেল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মেটার লামা মডেলগুলো ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।

চীনের সবচেয়ে হাই-প্রোফাইল এআই ইউনিকর্নগুলোর একটি ০১.এআই প্রতিষ্ঠা করেছেন গুগলের সাবেক নির্বাহী লি কাই-ফু। ২০২৩ সালের নভেম্বরে ধরা পড়ে যে, তাদের এআই মডেল Yi-34B মেটার লামা মডেলের নকল। এতে প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।

সম্প্রতি মাইক্রোসফট সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংস্থা জি৪২-এ ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এ ছাড়া জি৪২ এর অ্যাপ্লিকেশনগুলো চালানোর জন্যও মাইক্রোসফট তাদের ক্লাউড পরিষেবাগুলো ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।

মাইক্রোসফটের সঙ্গে জি৪২ এর ওই বিনিয়োগ চুক্তির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের মধ্যেও একটি নিরাপত্তা চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। তবে আরব আমিরাতসহ উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে চীনের গভীর সম্পর্ক নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বেগ রয়েছে।

এসব পরিপ্রেক্ষিতেই যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা এআই প্রযুক্তির রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে আইনের প্রস্তাব তুলেছেন।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত