ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর সংসদও বিলুপ্ত। এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় তা হবে, সেটি একটি কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সবার কাছে।
১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে এইচ এম এরশাদ পদত্যাগ করলে সংবিধানের মধ্যে থেকে একটি প্রক্রিয়ায় বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল।
পাঁচ বছর পর ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে সংবিধানে যোগ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
তবে আওয়ামী লীগই ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছিল। ফলে নির্বাচিত সরকারের বাইরে আর কোনও প্রক্রিয়ায় সরকার গঠনের সুযোগ বর্তমান সংবিধানে নেই।
কিন্তু সরকার ও সংসদ শূন্য হয়ে থাকায় একটি অরাজক পরিস্থিতি চলছে দেশে, যার একটি দ্রুত সমাধান জরুরি বলে মনে করছেন নাগরিকরা।
এর গুরুত্ব তুলে ধরে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সংবাদপত্রে কলামে লিখেছেন, “দেশে যদিও এখন একজন রাষ্ট্রপতি আছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সোমবার দুপুর থেকে দেশে সরকার অনুপস্থিত। সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরায় চালুর জন্য পুলিশকে সহায়তা করতে হবে।
“কিন্তু সবার আগে দরকার একটা সরকার প্রতিষ্ঠা। যাদের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এ রকম ব্যক্তিদের নিয়ে দ্রুত সরকার গঠন করতে হবে।”
“অরাজকতা যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়,” সতর্ক করেন অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা।
সংবিধানে আছে কী
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি ওঠে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনও জাতির উদ্দেশে ভাষণে জানান, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন গঠিত হবে।
“অথচ এ ব্যাপারে সংবিধানে কিছুই বলা নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের আন্দোলনে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে যুক্ত হয়েছিল।
সেই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের আগে নির্বাচিত সরকার পদত্যাগ করে দায়িত্ব দিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে। তার প্রধান হতো সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। সেই সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা বুঝিয়ে দিত।
১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন সেভাবেই হয়েছিল। কিন্তু গোল বাঁধে ২০০৬ সালে এসে।
বিএনপি সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৬৭ বছর করলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বাসনায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ আন্দোলন গড়ে তুললে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেন, অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারও গঠন করেন তিনি।
কিন্তু তাতে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হয়ে রাজপথে সংঘাত পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আসে ওয়ান-ইলেভেন।
২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে জরুরি অবস্থা জারির পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। মেয়াদ তিন মাস হলেও দুই বছর ক্ষমতায় ছিল সেই সরকার।
তারপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করা হয়।
ফলে এখন সংবিধানে নির্বাচিত সরকার থেকে নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী কোনও সরকার তৈরির সুযোগ সংবিধানে নেই।
বরং সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে, অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা গ্রহণ কেউ করলে, করার চেষ্টা করলে তা হবে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।
সংকটের ধরনটি কী
সংবিধানে রয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি সংসদের অন্য কাউকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন, যাকে সংসদে আস্থা ভোটে উৎরে যেতে হবে।
সোমবার শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর সেই সুযোগ ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সংসদও বিলুপ্ত ঘোষণার পর সেই সুযোগ আর থাকল না।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির রয়েছে। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী না আসা পর্যন্ত পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যেতে সাংবিধানিক কোনও বাধা নেই। কিন্তু এবার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় সেই সুযোগও নেই।
ফলে দেশ পরিচালনার জন্য যে সাংগঠনিক কাঠামো দরকার, তা এখন বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
১৯৯০ সালের বিষয়টি ছিল ভিন্ন। তখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৯০ সালের ৪ নভেম্বর এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় মধ্য থেকে সেই কৌশল বের করতে দুই দিন সময় লেগেছিল। ৬ ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন।
সেই প্রক্রিয়ায় প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন, তার স্থলে উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে এরশাদ নিয়োগ দেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে। তারপর এরশাদ পদত্যাগ করলে ভারপ্রাপ্ত বা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পদে আসীন হন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন।
তখন বিচারাঙ্গনের দায়িত্ব ছেড়ে সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি ছিলেন না সাহাবুদ্দীন। তাকে বিচারাঙ্গনে ফেরার সাংবিধানিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে।
এরপর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে ৬ অগাস্ট সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হয় সংসদে। তাতে প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় সাহাবুদ্দীন আহমদের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান বৈধ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি তার প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাওয়া বৈধতা পায়।
বাংলাদেশে এর আগেও এমন ঘটেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ পরবর্তীকালে গঠিত সংসদে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
এখন কী হচ্ছে
আন্দোলনকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে নোবেলজয়ী বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে।
তারা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি রূপরেখা দেবে বলে জানালেও এখনও তা দেয়নি; ফলে কেমন হবে এই সরকার তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তবে মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেন এই আন্দোলনের সমন্বয়করা, সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন।
ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ এখন দৃশ্যপটে নেই। তবে বিএনপি দ্রুত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছে।
বঙ্গভবনে আলোচনার পর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ড. ইউনূস বুধবারই ফ্রান্স থেকে দেশের পথে রওনা হবেন। তার ফেরার মধ্যেই সরকারের অন্য সদস্যদের নামের তালিকা চূড়ান্ত হয়ে যাবে। তারপরই শপথ গ্রহণ হবে।
তবে তালিকা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমরা এখনই প্রকাশ করব না। এটা প্রাথমিক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই তালিকাসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা পেয়ে যাবেন।”
কিন্তু এর আইনি বৈধতার যে প্রশ্ন আসছে, তার সমাধান ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র মাধ্যমে হবে বলে আইনজ্ঞরা মনে করছেন।
বঙ্গভবনে সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনায় থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা একটা এক্সটা অর্ডিনারি সিচুয়েশনে এই সরকার গঠন করতে যাচ্ছি।
“এক্সটা অর্ডিনারি সিচুয়েশনে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এই সরকারের বৈধতা দেওয়ার সাংবিধানিক রীতি আছে, নিয়ম আছে, সেটা ফলো করা হবে।”
ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন এই সরকার কতদিন থাকবে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “মেয়াদ এখনই ঠিক করা হয়নি।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনিক আর হক বলছেন, “ডকট্রিন অব নেসিসিটির প্রয়োজনে সবকিছুই সম্ভব।”
শিক্ষক নেটওয়ার্ক এর আগে একটি রূপরেখা দিয়েছিল, সেখানে শিক্ষক, বিচারপতি, আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের অংশীজনদের নিয়ে একটি জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিমূলক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব ছিল।
বর্তমান অবস্থায় করণীয় নিয়ে অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলছেন, এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিৎ একটি প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচিত সরকার কীভাবে নির্বাচন করা যায়, সেই নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচন ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত করে নির্বাচন করা।
সাধারণ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যে থেকে এই কাজ করা যায় বলে মনে করেন তিনি।