পর্ন তারকাকে ঘুষ দেওয়ার তথ্য গোপন রাখতে ব্যবসায়িক রেকর্ডে জালিয়াতির মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছে নিউ ইয়র্কের আদালত।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন বা সাবেক কোনও প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন।
এ ছাড়া ট্রাম্প হবেন একজন অপরাধী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বড় কোনও দলের প্রথম প্রার্থী।
আগামী ৫ নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সব ঠিক থাকলে সেই নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হয়ে ডেমোক্রেট প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে লড়বেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও আদালত এখনও সাজা ঘোষণা করেনি। আগামী ১১ জুলাই সাজা ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়েছে।
রায়ের পরও ট্রাম্প নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। ন্যায়বিচার পাননি দাবি করে এই রায়ের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যাওয়ার কথাও বলেছেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
ব্যবসায়িক রেকর্ডে জালিয়াতির দায়ে সর্বোচ্চ চার বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অবশ্য এ ধরনের মামলায় এর আগে যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তাদের বেলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আরও কম মেয়াদে কারাদণ্ড, জরিমানা অথবা নজরদারিতে রাখার (প্রবেশন) নজির রয়েছে।
ব্যবসায়িক রেকর্ডে জালিয়াতির সর্বোচ্চ সাজা চার বছর হলেও সর্বনিম্ন কোনও কারাদণ্ড না দেওয়ার সুযোগও রয়েছে। সেক্ষেত্রে ট্রাম্পকে নজরদারিতে রাখা বা শর্তসাপেক্ষে মুক্তির আদেশ দেওয়া হতে পারে। ট্রাম্পকে বাড়িতে গৃহবন্দি রেখে নজরদারির আদেশও দিতে পারেন আদালত।
এখন প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে অপরাধী সাব্যস্ত করে দেওয়া এই রায়ের কী প্রভাব পড়তে পারে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর উত্তর দেওয়া আসলে অনেক কঠিন। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আগে কখনও এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি।
ট্রেক্সাসের সাউদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর প্রেসিডেন্সিয়াল হিস্ট্রির ডিরেক্টর জেফ্রি এঙ্গেল বলেছেন, “কী ঘটতে চলেছে তার কোনও ধরনের ইঙ্গিত পেতে আমরা প্রায়ই ইতিহাসের দিকে তাকাই। কিন্তু রেকর্ডে এমন কোনও ঘটনা নেই, যা এর কাছাকাছিও আসে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হলেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে পারবেন। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার জন্য খুব বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে, ৩৫ বছর বয়সী, প্রাকৃতিকভাবে জন্মগ্রহণকারী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং কমপক্ষে ১৪ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী যেকোনও ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারবেন। অপরাধমূলক রেকর্ড থাকা কোনও প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিষিদ্ধ করার কোনও নিয়ম বা নজিরও যুক্তরাষ্ট্রে নেই।
জরিপে দেখা গেছে, রিপাবলিকান ভোটারদেরও বেশিরভাগই ট্রাম্পকে দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সমর্থন করেন, এমনকি যদি তিনি অপরাধের জন্য দোষীও সাব্যস্ত হন।
চলতি বছরের শুরুর দিকেই ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন। আগামী ১১ জুলাই সাজা ঘোষণার কয়েকদিন পরই পার্টির কনভেনশনে তাকে মুকুট পরানোর কথাও রয়েছে।
জনমত জরিপগুলোতে ইঙ্গিত মিলছে, ট্রাম্প জো বাইডেনের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লাড়াই করবেন। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করবে এমন অনেক দোদুল্যমান রাজ্যে সামান্য ব্যবধানে পিছয়ে আছেন ট্রাম্প।
তবে জরিপগুলোতে দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্পের নির্বাচনে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হওয়ার ইঙ্গিতও মিলেছে।
গত শীতে রিপাবলিকান প্রাইমারি চলাকালীন পরিচালিত এক্সিট পোলগুলোতে দেখা যায়, ট্রাম্প যদি কোনও অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন তবে ভোটারদের একটা বড় অংশ তাকে ভোট দেবেন না।
এ বছরের শুরুর দিকে ব্লুমবার্গ ও মর্নিং কনসাল্টের এক জরিপে দেখা গেছে, দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর ৫৩ শতাংশ ভোটার ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ভোট দেবে না।
ইপসোস ও এবিসি নিউজের এপ্রিলের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ট্রাম্পকে সমর্থনকারীদের মধ্যে ১৬ শতাংশ এমন পরিস্থিতিতে তাদের সমর্থন পুনর্বিবেচনা করবে।
চলতি মাসে কুইনিপিয়াক ইউনিভার্সিটির আরেক জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে রিপাবলিকান পার্টির ভোটারদের ৬ শতাংশ তাকে ভোট নাও দিতে পারে। এই সংখ্যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এ প্রসঙ্গে ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং নিউ ইয়র্ক সিটির স্বতন্ত্র মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গের সঙ্গে কাজ করা পোলস্টার ডগ শোয়েন বলেন, আমেরিকার ভোটাররা এই মামলার রায়ে খুব বেশি প্রভাবিত নাও হতে পারেন। কারণ এটি আট বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
তিনি বলেন, “যদিও ফৌজদারি অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়া ভালো কিছু নয়, তথাপি ভোটাররা নভেম্বরে যেসব নিয়ে ভাববেন সেগুলো হল- মুদ্রাস্ফীতি, দক্ষিণ সীমান্ত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং ইসরায়েল ও ইউক্রেনে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তা।”
ট্রাম্পের সমর্থনে সামান্য ভাটা পড়লেও তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যেতে পারেন। বিশেষ করে যদি ট্রাম্পের সমর্থকদের মাত্র কয়েক হাজার ভোটার উইসকনসিন বা পেনসিলভানিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বাড়িতে বসে থাকেন তাহলেই ট্রাম্পের হার নিশ্চিত।
রিপাবলিকান উইমেন ফর প্রগ্রেস-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যারিয়েল হিল-ডেভিস বলেন, “আমি মনে করি, এই রায় ট্রাম্পের প্রার্থিতায় প্রভাব ফেলবে এবং তার ক্ষতি করবে।”
রিপাবলিকান উইমেন ফর প্রগ্রেস দলটির নেতৃত্ব ট্রাম্পের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
হিল-ডেভিস বলেন, তরুণ ভোটাররা এবং যারা কলেজ শিক্ষিত এবং শহরতলিতে বসবাস করেন তারা ট্রাম্পের আচরণ এবং শাসন করার পদ্ধতি সম্পর্কে উদ্বিগ্ন।
“এই ভোটাররা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে থাকতে সত্যিই দ্বিধাগ্রস্ত। ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় সেই উদ্বেগগুলো আরও বাড়বে।”
তবে নেতৃস্থানীয় রিপাবলিকানরা, যাদের মধ্যে অনেকেই দলের মনোনীত প্রার্থীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে আদালতেও হাজির হয়েছিলেন, তারা দ্রুতই ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
যেমন পার্লামেন্টের হাউস স্পিকার মাইক জনসন এই রায়ের দিনকে আমেরিকার ইতিহাসে একটি লজ্জাজনক দিন বলেছেন। তিনি বলেন, “এটি একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক রায় ছিল, আইনগত নয়।”
গত আট বছর ধরেই বিশেষজ্ঞরা এবং বিরোধীরা ট্রাম্পের আসন্ন রাজনৈতিক পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন। অথচ তার কিছুই হয়নি।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানের সময়ও ট্রাম্প এমন সব কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হয়েছিলেন যা সম্ভবত একজন সাধারণ রাজনীতিবিদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিত।
এসব অভিযোগের মধ্যে টিভি হোস্ট বিলি বুশের সঙ্গে যৌন রসাত্মক কথোপকথনও রয়েছে, যেখানে তিনি অনুমতি ছাড়াই কোনও নারীর শরীরে হাত দেওয়া নিয়ে কথা বলেন। এই বিচারেও একাধিকবার সেটির উল্লেখ করা হয়েছিল।
এ ছাড়া ট্রাম্প দলের মধ্যেও দুবার অভিশংসনের মুখোমুখি হন এবং তার ক্ষমতার মেয়াদও শেষ হয় চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে।
২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে যাওয়ায় তার সমর্থকদের একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে আক্রমণ করে। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাম্প নিজেই তাদের উস্কে দিয়েছিলেন।
এতো কিছুর পরও ট্রাম্পের রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটেছে এবং ফের তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা বিস্ময়কর।
জেফ্রি এঙ্গেল বলেন, “আমেরিকার ইতিহাসে অন্য কোনও পূর্ববর্তী প্রার্থীকে আক্ষরিক অর্থেই ছুড়ে ফেলত- এমন সব কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও ট্রাম্পের প্রতি তার ভোটারদের অব্যাহত সমর্থন সত্যিই বিস্ময়কর।”
তারপর এই ঐতিহাসিক ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনার ফল ভিন্নও হতে পারে, বিশেষ করে যদি ট্রাম্পের আপিল ব্যর্থ হয় এবং তিনি কারাদণ্ডের সাজার মুখোমুখি হন।
বা এটি শুধু ট্রাম্পের ক্ষমতায় যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাযুক্ত অসংখ্য ঘটনার একটি হতে পারে, যার ফলে হয়তো অবশেষে ট্রাম্পের কিছুই হবে না।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যালান লিচম্যান এমন একটি রাজনৈতিক মডেল তৈরি করেছেন, যা ১৯৮৪ সাল থেকে প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে বিজয়ী হবে তা নিয়ে সফলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। তিনিও স্বীকার করেছেন, ট্রাম্পের দোষী সাব্যস্ত হওয়া এমন একটি ‘বিপর্যয়কর এবং অভূতপূর্ব’ মোড় হতে পারে, যা তার মডেলেও ঘাটতি আছে বলে প্রমাণ করতে এবং ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারে।
তিনি বলেন, “ইতিহাসের বইগুলো এটিকে সত্যিকারের অসাধারণ, অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে রেকর্ড করবে। তবে পরে যা ঘটবে তার উপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে।”
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কতটা প্রভাব পড়বে তার চূড়ান্ত রায় নভেম্বরে ভোটারদের হাত ধরেই আসবে। ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গেলে তার দোষী সাব্যস্ত হওয়াকে তার পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হতে পারে।
যদি তিনি জয়ী হন, তবে এটি শুধু ট্রাম্পের অশান্ত অথচ পরিণতিমূলক রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের একটি ফুটনোট হয়ে উঠতে পারে।
জেফ্রি এঙ্গেল বলেছন, “ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে, যা আমরা সবাই জানি।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি