ইরান সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র শিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল পরস্পরের ওপর পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে।
হিজবুল্লাহ রবিবার ভোরে ইসরায়েলের ১১টি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ৩০০টির বেশি রকেট ছুড়েছে। হামলায় ইসরায়েলের একজন নৌসেনা নিহত ও দুজন আহত হয়।
ইসরায়েল অবশ্য হিজবুল্লাহ হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সংবাদ পেয়ে আগেই লেবাননের দক্ষিণ সীমান্ত অঞ্চলে বিমান হামলা চালায়।
হিজবুল্লাহর হামলার আধাঘণ্টা আগেই ইসরায়েল ১০০ যুদ্ধবিমান নিয়ে লেবাননে হামলা চালায়। এতে অন্তত তিনজন নিহত হয়।
ইসরায়েলের দাবি, হিজবুল্লাহ বড় ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ইসরায়েল আগাম হামলা চালানোয় হিজবুল্লাহ তা করতে পারেনি। তারা হিজবুল্লাহর হাজার হাজার রকেট লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছে।
তবে ইসরায়েলি বাহিনীর এমন দাবি নাকচ করেছে হিজবুল্লাহ।
রবিবার সন্ধ্যায় এক টেলিভিশন বক্তৃতায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নসরুল্লাহ দাবি করেছেন, হিজবুল্লাহর হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে ইসরায়েল কিছুই জানতে পারেনি। আর ইসরায়েল যে দাবি করছে, তারা হিজবুল্লাহর রকেট লাঞ্চারগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে তাও সত্য নয়।
হিজবুল্লাহপ্রধান বলেন, তারা ইসরায়েলে বড় পরিসরের কোনও হামলার পরিকল্পনা করেননি। তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই হামলা চালাতে পেরেছেন।
তিনি বলেন, “হিজবুল্লাহ ৬ থেকে ৮ হাজার রকেট ও ড্রোন উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করছিল এবং ইসরায়েল তা ব্যর্থ করে দিয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে তা মিথ্যা। ইসরায়েল আমাদের শুধু কয়েক ডজন রকেট লাঞ্চার ধ্বংস করেছে। কিন্তু তাও ঘটেছে ইসরায়েলের ওপর হিজবুল্লাহর হামলার পর।”
ইসরায়েল গত ৩০ জুলাই রাতে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর কমান্ডার ফুয়াদ শুকুরকে হত্যা করে। তার জবাবেই হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের ওপর এই হামলা চালিয়েছে।
ফুয়াদ শুকুরকে হত্যার কয়েক ঘণ্টা পরই ইরানের রাজধানী তেহরানে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়াকেও হত্যা করা হয়। হামাস ও ইরান সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেয়।
এরপর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইরান যেকোনও মুহূর্তে ইসরায়েলে হামলা চালাতে পারে। এর মধ্যেই হিজবুল্লাহর এই হামলা।
হামলাকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল সরকার দেশে ৪৮ ঘণ্টার জরুরি অবস্থা জারি করেছে। দেশটির বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর কয়েক ঘণ্টা বন্ধ রাখা হয়। ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে বোমা হামলার সময়কার আশ্রয়কেন্দ্রও খুলে দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে নিয়মিত বিরতিতে সংঘর্ষ চলে আসছিল।
তবে রবিবারের এই হামলা ছিল, ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে স্মরণকালের সবচেয়ে তীব্র পাল্টাপাল্টি হামলা। গত ১০ মাসে দুই পক্ষের মধ্যে চলমান সীমান্ত যুদ্ধেও এটি সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ ছিল।
ফুয়াদ শুকুরকে হত্যার জবাবের প্রথম পর্ব
হিজবুল্লাহ বলছে, রবিবারের হামলা ছিল তাদের কমান্ডার ফুয়াদ শুকরকে হত্যার জবাবের প্রথম পর্ব।
সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, কমান্ডার ফুয়াদ শুকুরকে হত্যার বদলা নিতে তারা ইসরায়েলে ৩২০টির বেশি রকেট ছুড়েছে। এর মধ্য দিয়ে হামলার ‘প্রথম পর্যায়’ সম্পন্ন হয়েছে।
হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহ বলেন, তার সংগঠন ইসরায়েলের ওপর এই হামলার ফলাফল মূল্যায়ন করবে। ফলাফল যদি শুকুরের মৃত্যুর প্রতিশোধের জন্য যথেষ্ট না হয়, তাহলে সামনে আবারও ইসরায়েলে হামলা চালানো হবে।
হিজবুল্লাহর দাবি, রবিবার তারা ইসরায়েলের ১১টি স্থাপনায় আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মেরোন সামরিক ঘাঁটি ও গোলান মালভূমিতে চারটি স্থাপনা।
টেলিভিশন ভাষণে হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, হামলার মূল লক্ষ্য ছিল তেল আবিবের কাছে গ্লিলোটে অবস্থিত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার সদরদপ্তর।
তবে বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভবনসহ তেল আবিবের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না।
তিনি আরও বলেন, রবিবারের হামলায় আরও শক্তিশালী ও নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারেরও কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তবে অদূর ভবিষ্যতে সেগুলো ব্যবহার করা হতে পারে।
এই হামলা কি ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর যুদ্ধের শুরু
বৈরুতভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক লীভান্ত ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সামি নাদের বলেন, “রবিবার যে পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় পরিসরে অঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ তা এড়ানোর চেষ্টাও করছে।”
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, ইসরায়েল পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ চায় না। তবে বাস্তব পরিস্থিতি যে দিকে যাবে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।
যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলের পাশে থাকার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইসরায়েলের ওপর ইরান বা হিজবুল্লাহর হামলা প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল সামরিক সরঞ্জাম স্থানান্তর করেছে। ইউএসএস আব্রাহাম লিঙ্কনসহ দুটি বিমানবাহী রণতরী মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হয়েছে।
বিশ্লেষক সামি নাদের মনে করেন, এই পাল্টাপাল্টি হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বাড়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তবে আল-জাজিরার সাংবাদিক ও বিশ্লেষক জেইনা খোদরের মতে, হিজবুল্লাহর ওপর হামলা চালানোর ক্ষেত্রে ইসরায়েল ‘নিজেদের নিরাপত্তা’ ও ইসরায়েলের নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বলছে। তাদের কথা থেকে ইঙ্গিত মিলছে, ইসরায়েল আপাতত বড় আকারে সংঘাতে জড়ানোর দিকে হাঁটবে না।
খোদর বলেন, “হিজবুল্লাহর কাছ থেকে স্পষ্ট বার্তা হল, যদি তাদের রবিবারের হামলার লক্ষ্য পূরণ হয়ে থাকে তাহলে আপাতত প্রতিশোধ নেওয়া শেষ। তারা অচিরে আর ইসরায়েলের ওপর বড় কোনও হামলা চালাবে না। আর তাহলে ইসরায়েলও সংযমের সঙ্গেই কাজ করবে।”
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, তারা পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ চান না। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “গল্প এখানেই শেষ নয়।”
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলছে, তারা দুটি ফ্রন্টে একযোগে যুদ্ধ চালাতে প্রস্তুত রয়েছে। এর একটি গাজা, অন্যটি লেবানন।
তবে গাজার হামাসের চেয়ে হিজবুল্লাহ অনেক বেশি শক্তিশালী। হিজবুল্লাহর ভাণ্ডারে আছে প্রায় দেড় লাখ রকেট। তাদের অনেক রকেট ইসরায়েলের যেকোনও জায়গায় হামলা চালাতে সক্ষম।
ফলে ইসরায়েল সেই ঝুঁকি নাও নিতে পারে। অবশ্য ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ উভয়েই বলছে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচানয় কী প্রভাব পড়বে
প্রায় ১১ মাস ধরে ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতার গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং হামাসের হাতে বন্দী ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তির জন্য মধ্যস্থতা করছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সেই প্রচেষ্টা আরও জোরদার হয়েছে। এই যুদ্ধ যাতে বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ না নেয়, এজন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কূটনীতিকেরা। গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকেই আঞ্চলিক উত্তেজনা কমানোর সর্বোত্তম আশা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হিজবুল্লাহ বলেছে, গাজায় যুদ্ধবিরতি হলে তারা ইসরায়েলে হামলা বন্ধ করবে। তবে হিজবুল্লাহ বা ইরান শুকুর ও হানিয়া হত্যার জন্য যে প্রতিশোধমূলক হামলার হুমকি দিয়েছে তা তারা প্রত্যাহার করবে কিনা সেটা অস্পষ্ট। অবশ্য, তাদের কেউই গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনা ভেস্তে দিয়ে চায় না।
যুক্তরাষ্ট্র গত মে মাসে প্রথম গাজায় যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব দেয়। হামাস সেই প্রস্তাব মেনে নিলেও ইসরায়েল বাড়তি শর্ত আরোপ করে। এতে তা ভেস্তে যায়।
গত ১৫ আগস্ট পুনরায় গাজা যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র ‘ব্রিজিং প্রপোজাল’ বা ‘সেতুবন্ধনের প্রস্তাব’ নামে নতুন একটি প্রস্তাব দেয়।
তবে এবার ইসরায়েল সম্মত হলেও হামাস এর বিরোধিতা করছে। কারণ নতুন প্রস্তাবে ইসরায়েল গাজা থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করবে না বলে জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মতে, প্রস্তাবটির লক্ষ্য গাজায় সহিংসতার অবসান ঘটাতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করা।
কিন্তু হামাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের আগের পরিকল্পনার ভিত্তিতেই গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চায় তারা।
হামাসের যুক্তি, নতুন কোনও প্রস্তাব নিয়ে এখন আলোচনা করতে গেলে শুধু সময় নষ্ট হবে। এতে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাও চলতে থাকবে। এরচেয়ে বরং ইসরায়েলকে আগের প্রস্তাব অনুযায়ীই আলোচনায় বাধ্য করা উচিৎ।
তাই হামাস নতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এটিকে ইসরায়েলকে গণহত্যা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের আগের প্রস্তাবে ফিরে যাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে হামাস।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স