Beta
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

চীন-তাইওয়ান উত্তেজনার নেপথ্যে কী

গত এক দশকে চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা চরমে উঠেছে।
গত এক দশকে চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা চরমে উঠেছে।
[publishpress_authors_box]

মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় আবারও তাইওয়ানের ওপর পূর্ণ মাত্রার সামরিক হামলার মহড়া চালিয়েছে চীন। স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলটির জাতীয় দিবসে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাই চিংয়ের বক্তৃতা দেওয়ার ঠিক তিন দিন পরেই সোমবার ওই মহড়া চালানো হয়।

তাইওয়ানের ওপর পূর্ণ মাত্রার সামরিক হামলার প্রথম মহড়াটি চীন চালায় গত ২৩-২৪মে। সেটি ছিল তাইওয়ানকে ঘিরে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চীনা সামরিক মহড়া।

অঞ্চলটির নতুন প্রেসিডেন্ট গত ২০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিয়ে উদ্বোধনী ভাষণে চীনের প্রতি তাইওয়ানকে ‘ভয় দেখানো’ বন্ধের আহ্বান জানান। পাশপাশি তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “তাইওয়ানের গণতন্ত্রের একটি গৌরবময় যুগ এসেছে”। তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্পও পুনর্ব্যক্ত করেন তখন।

ওই ভাষণের দুদিন পরই চীন প্রথমবারের মতো তাইওয়ানকে ঘিরে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের মহড়া চালায়।

আর গত ১০ অক্টোবরের ভাষণে লাই বলেন, তিনি চীন কর্তৃক তাইওয়ানের যেকোনো ‘অধিভুক্তি বা দখল’ প্রতিরোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দ্বীপের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করা বা স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কোনও অধিকার বেইজিংয়ের নেই বলেও মন্তব্য করেন।

এদিন উইলিয়াম লাই দুই সরকারের ভিন্ন ভিন্ন বয়স বলার মধ্য দিয়ে তাইওয়ান ও চীনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবেও উল্লেখ করেন। লাই বলেন, “গত ১ অক্টোবর জাতীয় দিবস উদযাপন করার সময় কমিউনিস্ট সরকার শাসিত চীনের বয়স হয়েছে ৭৫ বছর। আর ১০ অক্টোবর জাতীয় দিবস উদযাপন করা তাইপের রিপাবলিক অব চায়না বা চীন প্রজাতন্ত্রের বয়স হয়েছে ১১৩ বছর।”

১৯১১ সালে চীনের গণতন্ত্রপন্থীরা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশটির চিং রাজবংশকে উৎখাত করে। এরপরই যাত্রা শুরু হয় চীন প্রজাতন্ত্রের। কিন্তু ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর সেই শাসকগোষ্ঠী তাইওয়ানে পালিয়ে যায়।

তবে লাইয়ের এসব বক্তব্যের জেরেই চীন সোমবারের এই সামরিক মহড়া চালিয়েছে। এবার মাত্র একদিনেই মহড়াটি শেষ করে চীন। এতে বিমানবাহী রণতরী ও যুদ্ধজাহাজসহ মোট ৩৪টি নৌযান এবং ১২৫টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয়।

চীনা সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড বলেছে, জয়েন্ট সোর্ড-২০২৪বি শিরোনামে মহড়াটি ‘তাইওয়ান দ্বীপের উত্তর, দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চলে’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত মে মাসের মহড়াটির নাম ছিল জয়েন্ট সোর্ড-২০২৪এ।

তাইওয়ানকে ঘিরে ৯টি স্থানে অবস্থান নিয়ে মহড়া চালায় চীন— দুটি দ্বীপের পূর্ব উপকূলে, তিনটি পশ্চিম উপকূলে, একটি উত্তরে এবং তিনটি চীন উপকূলের পাশে তাইওয়ান-নিয়ন্ত্রিত দ্বীপের চারপাশে।

তবে মহড়ার সমাপ্তির ঘোষণার পরপরই চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছে, এই মহড়া মে মাসে অনুষ্ঠিত আগের মহড়ার পুনরাবৃত্তি নয়। বরং একে তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চাপ বৃদ্ধি বলা যেতে পারে এবং সামনে এমন আরও মহড়া আসতে পারে।

বিবৃতিতে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, “তাইওয়ান সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত দেশটির প্রতিটি স্বাধীনতার উসকানির সঙ্গে সঙ্গে চীনের সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকেও আরও জোরদার করা হবে।”

ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড বলেছে, মহড়াগুলো “তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী বাহিনীগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের” প্রতি কঠোর সতর্কতা।

থিয়েটার কমান্ডের বিবৃতিতে এই মহড়াকে চীনের “রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য এটি একটি বৈধ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ” বলেও অভিহিত করা হয়।

তবে কমান্ড আরও বড় মাপের মহড়ার জন্য পরবর্তী কোনও তারিখ ঘোষণা করেনি।

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই মহড়াকে চীনের ‘অযৌক্তিক এবং উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড’ আখ্যায়িত করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

দেশটির প্রেসিডেন্ট কার্যালয় বলেছে, চীনের উচিৎ তাইওয়ানের জনগণের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক জীবনযাপনের পছন্দকে সম্মান করা এবং সামরিক উসকানি থেকে বিরত থাকা।

তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের বিমানবাহনী রণতরী।

এ বছর উত্তেজনা কেন এতো বাড়ল

গত জানুয়ারিতে নির্বাচিত হওয়ার পর মে মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করা তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তেকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসাবে আখ্যায়িত করে চীন। লাইয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে তাইওয়ানে প্রথমবারের মতো ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে।

১৯৯৬ সালে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুরুর পর থেকে দেশটিতে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি ও চীনের প্রতি নমনীয় কুওমিনতাং পার্টি দুই মেয়াদ করে ক্ষমতায় থাকত। কিন্তু এবারই প্রথম কট্টর চীন বিরোধীরা টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এল। আর এ কারণেই হয়তো চীন এবার একটু বেশিই চটেছে।

নির্বাচনের আগে থেকেই চীন সতর্ক করে আসছিল, লাই চেং-তে বিজয়ী হলে উত্তেজনা বাড়তে পারে এবং সংঘর্ষ হতে পারে। বেইজিং বারবার তাইওয়ানের এবারের নির্বাচনকে শান্তি বা যুদ্ধের মধ্যে যে কোনও একটিকে বেছে নেওয়ার নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করছিল। কিন্তু তাইওয়ানের ভোটাররা সেই সতর্কতা প্রত্যাখ্যান করে ডিপিপিকে ফের ক্ষমতায় আনে।

লাইয়ের রাজনৈতিক অতীতের জন্যই তাকে চীনের এতোটা অপছন্দ। ৬৪ বছর বয়সী এই সাবেক ডাক্তার এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ একসময় তাইওয়ানের স্বাধীনতার প্রকাশ্য সমর্থক ছিলেন।

অবশ্য একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো লাই মাত্র ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। বাকি ৬০ শতাংশ এমন দুটি দলের দুজন প্রার্থীর পক্ষে গেছে যারা কম স্বাধীনতা-মনস্ক।

তাইওয়ানের নতুন প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে।

২০১৬ সালে ডিপিপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তাইওয়ানের আশেপাশে তার সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে।

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরে গেলে চীন দেশটির উপর দিয়ে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভয় দেখিয়েছিল।

আর এ বছর থেকে শুরু করেছে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের মহড়া। চীনের দাবি, তাইওয়ান তার অংশ। স্বশাসিত তাইওয়ানের উপর নিজের সেই দাবিকে আরও জোরালো করাই চীনের এসব মহড়ার লক্ষ্য।

বেইজিং দ্বীপটিকে চীনের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসাবে দেখে এবং শেষ পর্যন্ত তা চীনের অংশ হবে বলেও মনে করে। আর সেটা অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে শক্তি প্রয়োগ করবে বলেও জানিয়েছে।

তবে তাইওয়ানের জনগণের একটি বিশাল অংশ নিজেদেরকে একটি পৃথক জাতি বলে মনে করে। অবশ্য দেশটির বেশিরভাগই স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে— যেখানে তাইওয়ান চীন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করবে না বা এর সঙ্গে একত্রিতও হবে না।

অবশ্য নতুন প্রেসিডেন্ট লাইয়ের মতে, তাইওয়ান এরই মধ্যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে আর স্বাধীনতা ঘোষণা করার প্রয়োজনও নেই। লাইয়ের এমন কথাবার্তার কারণেই চীন তাইওয়ানের ওপর চাপ বাড়ানো শুরু করে।

ইতিহাস কী বলে

তাইওয়ান দ্বীপে প্রথম পরিচিত বসতি স্থাপনকারীরা ছিলেন অস্ট্রোনেশিয়ান উপজাতীয় মানুষরা, যারা দক্ষিণ চীন থেকে সেখানে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।

চীনা নথিতে প্রথম ২৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বীপটির উল্লেখ পাওয়া যায়, যখন চীনের একজন সম্রাট এটি দখল করার জন্য একটি সামরিক অভিযাত্রী বাহিনী পাঠান। আর সেই ঘটনাকেই বেইজিং তাইওয়ানের ওপর তার কর্তৃত্বের দাবিকে সমর্থনের জন্য ব্যবহার করে।

আধুনিক যুগের শুরুতে (১৬২৬-৬৮) তাইওয়ান অল্প কিছু সময়ের জন্য ডাচদের উপনিবেশ ছিল। তবে পরে কিং রাজবংশ ফের তাইওয়ানকে চীনের অধীনে নিয়ে আসে। এরপর প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধের (১৮৯৪-৯৫) পর তাইওয়ান জাপানের নিয়ন্ত্রণে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পনের পর জাপান চীনের কাছ থেকে নেওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়। পরে তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিক অব চায়না বা চীন প্রজাতন্ত্রের অধিকৃত বলে বিবেচিত হয়। মিত্র শক্তির প্রধান দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও এতে সম্মতি দেয়।

তাইওয়ান প্রণালিতে চীনের যুদ্ধজাহাজ।

কিন্তু পরের কয়েক বছরে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং প্রজাতন্ত্রী চীনের তৎকালীন নেতা চিয়াং কাই-শেকের সৈন্যরা মাও সেতুং-এর কমিউনিস্ট সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়।

১৯৪৯ সালে চিয়াং তার কুওমিনতাং (কেএমটি) সরকারের অবশিষ্টাংশ এবং তার সমর্থকদেরসহ প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নিয়ে তাইওয়ানে পালিয়ে যান।

দ্বীপটির রাজধানী তাইপেতে গিয়ে চিয়াং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাইওয়ান শাসন করেন। তার মৃত্যুর পর তাইওয়ানের পূর্ণ গণতন্ত্রের উত্তরণ শুরু হয় এবং ১৯৯৬ সালে প্রথম দেশটিতে নির্বাচন হয়।

তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয় কারা

বিশ্বমঞ্চে তাইওয়ানের মর্যাদা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। দেশটির নিজস্ব সংবিধান, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা এবং সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় ৩ লাখ সক্রিয় সৈন্য রয়েছে।

১৯৪৯ সালে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ানে নির্বাসিত চিয়াং কাই-শেকের সরকার তাইপে থেকেই সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করেছিল এবং পুনরায় চীন দখল করতে চেয়েছিল।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও তাইওয়ান মূল চীনের আসনে অধিষ্ঠিত হয় এবং অনেক পশ্চিমা দেশ তাইপের সরকারকেই একমাত্র চীন সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।

কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে কিছু দেশ তর্ক করতে শুরু করে যে, তাইপেই সরকারকে আর চীনের মূল ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা যায় না।

১৯৭১ সালে জাতিসংঘ বেইজিংয়ের কমিউনিস্ট সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালে চীন তার অর্থনীতি ও বাজার বিশ্বের জন্য খুলে দেওয়া শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্রও বাণিজ্যের সুযোগ এবং সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

তারপর থেকে তাইপের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যায়। মাত্র ১২টি দেশ বর্তমানে দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেয়। তাইওয়ানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য চীন বিভিন্ন দেশের ওপর যথেষ্ট কূটনৈতিক চাপও প্রয়োগ করে।

চীন থেকে তাইওয়ানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। প্রতীকী ছবি।

চীন-তাইওয়ান সম্পর্কের উন্নতি

১৯৮০-র দশকে তাইওয়ান চীনে সফর ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিল করলে তাদের সম্পর্কের উন্নতি হতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে তাইপে ঘোষণা করে যে, কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে।

চীন ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’র প্রস্তাব করে, যার অধীনে তাইওয়ান স্বায়ত্তশাসন পাবে, যদি এটি বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে আসতে রাজি হয়।

১৯৯৭ সালে একই বন্দোবস্তের অধীনে হংকংও চীনে ফিরে আসে। তবে চীন পরে হংকংয়ের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।

তাইওয়ান প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে। এতে বেইজিং তাইওয়ানের সরকারকে অবৈধ বলে আখ্যা দেয়। এরপর ২০০০ সালে তাইওয়ান চেন শুই-বিয়ানকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত করলে বেইজিং আরও ক্ষিপ্ত হয়।

কারণ, চেন এবং তার দল ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) প্রকাশ্যে তাইওয়ানের ‘স্বাধীনতা’ সমর্থন করেছিল।

২০০৪ সালে চেন পুনঃনির্বাচিত হওয়ার এক বছর পর চীন একটি বিচ্ছিন্নতা বিরোধী আইন পাস করে। এতে তাইওয়ান যদি চীন থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ‘অশান্তিপূর্ণ উপায়’ ব্যবহারকে চীনের অধিকার ঘোষণা করা হয়।

এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নীরবে দেশটির নৌবাহিনীকে তাইওয়ান প্রণালিতে পাঠান, বেইজিংকে প্রদর্শনের জন্য যে যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপটিতে যেকোনো আক্রমণ প্রতিরোধ করবে।

২০০৮ সালে চীনপন্থী কেএমটি তাইওয়ানের ক্ষমতায় আসে। দলটির দুই মেয়াদে উত্তেজনা কম ছিল।

তাইওয়ান প্রণালিতে চীনা যুদ্ধজাহাজ।

২০১৬ সালে ফের ডিপিপি থেকে সাই ইং-ওয়েন প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। তার অধীনে পুনরায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সাই দায়িত্ব নেওয়ার পরে চীন তাইওয়ানের সঙ্গে সরকারি যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়। কারণ ডিপিপি একক চীনা জাতির ধারণা সমর্থন করে না।

সাই কখনও বলেননি যে, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন, তবে জোর দিয়ে বলেন যে, তা ইতোমধ্যে স্বাধীন।

সাইয়ের তিন বছর আগে থেকেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, যার সময়ে চীনের দাবি আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। শি এই বার্তাটি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, চীন তাইওয়ানের সঙ্গে ‘অবশ্যই পুনরায় একত্রিত হবে’ এবং তিনি এই ‘চীনা স্বপ্ন অর্জনের’ জন্য ২০৪৯ সালকে সময়সীমা হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।

তাইওয়ানকে যুক্ত করার বিষয়টি চীনের সংবিধানেও রয়েছে। মাও সেতুং থেকে শুরু করে কমিউনিস্ট চীনের সব রাষ্ট্রপ্রধানই তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে গেছেন।

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তাইওয়ান সাই-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম লাইকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে, যাকে চীন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই থেকেই চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা চরমে উঠে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী

যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক বজায় রাখে এবং ‘এক চীন নীতি’র অধীনে কমিউনিস্ট সরকারকেই একমাত্র চীনা সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক সমর্থক হিসাবেও রয়ে গেছে।

ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র সরবরাহ করতে আইনগতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে সামরিকভাবে রক্ষা করবে। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অস্পষ্টতা হিসাবে পরিচিত তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসে।

শি জিনপিং ও জো বাইডেন।

দ্বীপটি দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের সবচেয়ে বিতর্কিত ইস্যু। বেইজিং তাইপেইর জন্য ওয়াশিংটনের কাছ থেকে যেকোনো ধরনের সমর্থনের নিন্দা করে।

গত এক দশকে প্রথমে চীনা নেতা শি জিনপিং এবং তারপরে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের পর থেকে উভয় দেশই মৌলিকভাবে পরস্পরের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করেছে। বন্ধুভাবাপন্ন থেকে তা গড়ায় সতর্কতা ও শত্রুতার দিকে।

বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিকভাবে চীনের অস্বাভাবিক ও দ্রুত বেড়ে ওঠা এই শত্রুতাকে অনিবার্য করে তোলে।

যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে পুনরুদ্ধারে চীনের আগ্রাসন মেনে নেবে না। তবে চীন যদি জোর-জবরদস্তি ছাড়া তাইওয়ানকে তার সঙ্গে যুক্ত করতে পারে তাহলে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের উপর চীনের দাবি মেনে নিতে পারে।

তাইওয়ানের সামনের নির্বাচনের ফলগুলো যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের গতিপথকে রূপ দেবে। তাইওয়ানে যেই বিজয়ী হোক না কেন, তা যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে সম্পর্কের উপর অবিরাম প্রভাব ফেলবে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, সিএনএন, এপি, রয়টার্স

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত