সৌদি আরবে এবছর হজে গিয়ে বিভিন্ন দেশের ১ হাজার জন লাশ হয়ে ফিরছেন।
বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ ব্যবস্থাপনা পোর্টালের তথ্য বলছে, এবছর সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে হজ পালনে ৮৫ হাজার ২৫৭ জন গিয়েছেন। শনিবার পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, এদের মধ্যে ৩৫ জন মারা গেছেন।
সৌদি আরবে এবার হজ পালনের সময় যারা মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশেরই মৃত্যুর কারণ অত্যধিক তাপমাত্রা। মরুর দেশটিতে সাম্প্রতিক সময়ে তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
আরবের এক কূটনীতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মৃতদের মধ্যে ৬৫৮ জনই মিশরের নাগরিক। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার দুই শতাধিক ও ভারতের ৯৮ জনের বেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে সৌদিতে।
পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, জর্ডান, ইরান, সেনেগাল, তিউনিশিয়া, সুদান ও ইরাকের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কুর্দিস্তানেরও অনেকে মারা গেছেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন হজযাত্রীও রয়েছেন।
প্রতি বছর সৌদি আরবের মক্কা শহরে হজ অনুষ্ঠিত হয়। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলিমের তার জীবদ্দশায় অন্তত একবার হজ পালন করা আবশ্যক বলে বিবেচিত হয়।
সৌদি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, এ বছর প্রায় ১৮ লাখ মুসলমান হজে অংশ নেন।
এএফপি বলছে, সৌদিতে হজ পালনের সময় মৃতদের অধিকাংশই অনিবন্ধিত হজযাত্রী। তারা বিভিন্ন পন্থায় হজে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু ও বাসের সুযোগ সুবিধা পাননি।
শুক্রবার জর্ডানের কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা বেশ কয়েকজন ট্রাভেল এজেন্টকে আটক করেছে যারা মক্কায় হজযাত্রীদের অনানুষ্ঠানিক ভ্রমণে সহায়তা করেছিল। মিশরও একই ধরনের তদন্ত চালাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি কর্তৃপক্ষ হজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। তবুও বিশেষ করে অনিবন্ধিত হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে। সৌদি কর্তৃপক্ষ এখনও এবারের হজে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
বিবিসির প্রতিবেদনে হজযাত্রীদের মৃত্যুর কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।
অত্যধিক তাপমাত্রা
সৌদিতে সাম্প্রতিক সময়ে তাপমাত্রা অতীতের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এই ঘটনাকে হজযাত্রীদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলা হচ্ছে।
সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তীব্র গরমের হাত থেকে বাঁচতে হজ পালনরতদের পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পানের পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তারপরেও অনেক হজযাত্রী তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে ও হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন।
নাইজেরিয়ার হজযাত্রী আয়শা ইদ্রিস বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজডে’কে বলেন, “শুধু আল্লাহর রহমতেই আমি বেঁচে আছি। কারণ সেখানে অস্বাভাবিক গরম ছিল। আমাকে ছাতা ব্যবহার করতে হয়েছিল গরম থেকে বাঁচতে। আর ক্রমাগত জমজমের পানি দিয়ে শরীর ভিজিয়ে রাখতাম।”
নাইম নামের আরেক জন হজ পালনের সময় গরমে অসুস্থ হয়ে মারা যান।
তার ছেলে বিবিসিকে বলেন, “মায়ের সঙ্গে হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকদিন খোঁজার পর জানতে পারি মা হজের সময় মারা গেছেন।”
হজযাত্রীদের অধিকাংশই সৌদি আরবের তীব্র গরমে অভ্যস্ত নয়। ফলে ক্লান্তিকর শারীরিক পরিশ্রম ও বিশালাকার খোলা প্রান্তরে থাকার কারণে তারা বিভিন্ন ঝুঁকির মুখোমুখি হন। এসব হজযাত্রীদের মধ্যে অনেকেই আবার বয়স্ক ও অসুস্থ।
হজের সময় তীব্র গরমে মৃত্যুর ঘটনা নতুন কিছু নয়। সৌদি কর্তৃপক্ষ ১৪০০ সাল থেকে মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করছে।
এদিকে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
জার্মানির ক্লাইমেট অ্যানালাইটিকসের গবেষক কার্ল ফ্রেডরিক শ্লেউসনার বলেন, “হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে গরমের মধ্যে হজ হচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু সংকট এই পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তুলছে।”
তার গবেষণা বলছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে হজের সময় হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
অতিরিক্ত ভিড়, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা
অনেকের মতে, সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। হজযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত এলাকাগুলোতে অনেক সংকটের সৃষ্টি হয়।
হজযাত্রীদের অনেকের মতে, আবাসন ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা রয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ তাঁবুগুলোতে পর্যাপ্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব ছিল এবার।
ইসলামাবাদের বাসিন্দা আমিনা (ছদ্মনাম) বলেন, “মক্কার তীব্র গরমে আমাদের তাঁবুতে কোনও এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। যেসব কুলার বসানো হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশেই পানি ছিল না। তাঁবুগুলোর পরিবেশ এতটাই অস্বাস্থ্যকর ছিল যে, আমরা ঘামে ভিজে যাচ্ছিলাম। এটি আমার জন্য এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা।”
জাকার্তার হাজযাত্রী ফৌজিয়াও আমিনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত।
তিনি বলেন, “অনেক তাঁবুতে ভিড় ও গরমের কারণে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যান।” তবে তিনি এও বিশ্বাস করেন যে, এবারের হজ আয়োজন ছিল সবচেয়ে ভালো।
সৌদি সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, হজযাত্রীদের সুস্থতা নিশ্চিতে ১৮৯টি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও মোবাইল ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট শয্যা সংখ্যা ৬ হাজার ৫০০ এর বেশি। এছাড়া ৪০ হাজারের বেশি চিকিৎসা, প্রযুক্তি, প্রশাসনিক কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়েছে।
পরিবহন ব্যবস্থা
তীব্র গরমের মধ্যে প্রায়শই হজযাত্রীদের দীর্ঘপথ হাঁটতে হয়। কেউ কেউ এই রাস্তায় ব্যারিকেড থাকা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ করেছেন।
হজের বেসরকারি আয়োজক মুহাম্মদ আচা জানান, একজন সাধারণ হজযাত্রীকে দিনে কমপক্ষে ১৫ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হতে পারে। ফলে তীব্র গরমের প্রভাবে অসুস্থতা, ক্লান্তি ও পানির অভাব দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, “এটি আমার ১৮তম হজ। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, সৌদি নিয়ন্ত্রকরা সহায়ক নয়। তারা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু সাহায্য করে না। আগে তাঁবুতে প্রবেশের জন্য ইউ-টার্নগুলো খোলা ছিল। কিন্তু এখন সেগুলো বন্ধ। ফলে তীব্র গরমে একজন হজযাত্রী যদি ‘জোন-আই’ ক্যাটাগরির তাঁবুতে থাকেন, সেখানে পৌঁছাতে তাকে আড়াই কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়।
“এই রাস্তায় কোনও জরুরি পরিস্থিতি দেখা দিলে ৩০ মিনিটের মধ্যে কেউ আপনার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। রাস্তায় প্রাণ রক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। তেমনি পানি পানেরও নেই কোনও ব্যবস্থা।”
অনিবন্ধিত হজযাত্রী
হজ পালনের জন্য একজন হজযাত্রীকে অবশ্যই বিশেষ হজ ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। কিছু মানুষ সৌদি কর্মকর্তাদের কঠোর অবস্থানের পরেও যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই পাঁচদিনের হজযাত্রায় যাওয়ার চেষ্টা করেন।
যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া হজযাত্রীরা কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে চলে। এমনকি তাদের সাহায্যের প্রয়োজন হলেও তারা কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে পারে না। অনুমোদনহীন হজের এই সমস্যাতেই এবার মৃত্যুর সংখ্যা বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকা তাঁবুগুলোতে অতিরিক্ত ভিড়কেও দায়ী করা হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় হজ ও ওমরাহ কমিশনের চেয়ারম্যান মুস্তোলিহ সিরাজ বলেন, “আমরা সন্দেহ করি, যারা হজ ভিসা ব্যবহার করছে না, তারা হজ এলাকায় প্রবেশ করেছে।”
সৌদির জাতীয় হজ ও ওমরাহ কমিটির উপদেষ্টা সাদ আল কুরায়শি বলেন, “যাদের হজ ভিসা নেই, তাদের বরদাশত করা হবে না। তাদের অবশ্যই দেশে ফিরে যেতে হবে।”
তার মতে, অনিবন্ধিত হজযাত্রীদের নুসুক কার্ডের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। এই কার্ড নিবন্ধিত হজযাত্রীদের দেওয়া হয়। পবিত্র স্থানে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষকে এই কার্ড দেখাতে হয়।
বয়স্ক ও অসুস্থ হজযাত্রী
অনেকেই তাদের শেষ বয়সে জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে হজে যান। এই কারণেও হজে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে বলেও মনে করা হয়।
আবার অনেক মুসলিম এই আশায় হজে যান যে, যদি তারা সেখানে মারা যান, তাহলে তাদের সেখানে কবর দেওয়া হবে। একে তারা পুণ্য বলে মনে করেন।
হজ করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে কী হয়
হজের সময় মারা গেলে তার মৃত্যুর সংবাদ হজ মিশনে প্রথমেই জানানো হয়। তারা মৃতের পরিচয় নিশ্চিত করতে ওই হজযাত্রীর কব্জি বা গলায় থাকা পরিচয়পত্র ব্যবহার করেন। এরপর একজন ডাক্তারের সনদপত্র সংগ্রহ করে সৌদি সরকার মৃত্যুর সনদ দেয়।
মৃতের জানাজা মক্কার মসজিদুল হারাম বা মদিনার মসজিদের মতো গুরুত্বপূর্ণ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি কর্তৃপক্ষ মৃতের দেহ ধুয়ে, কাপড়ে মুড়িয়ে ফ্রিজে রেখে দেয়। এরপর মৃতের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর বা তার দেশে লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসবের খরচ সৌদি কর্তৃপক্ষই বহন করে।
কবরগুলো দেখতে খুব সাধারণ হয়। কোন চিহ্ন ছাড়াই একই কবরে অনেককে কবর দেওয়া হয়। তবে কাকে কোথায় সমাহিত করা হয়, তা কবরস্থানের বইয়ে তালিকাভুক্ত করা থাকে। এতে করে পরিবারগুলো তাদের স্বজনের কবর দেখতে যেতে পারে।
সৌদি সরকার বিভিন্ন সংগঠন ও রেড ক্রিসেন্টের সহায়তায় কবর দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে।