ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মেগা প্রকল্প পেতে যাচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। দেশের অর্থনীতির ‘অক্সিজেন খ্যাত’ চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা কয়েকগুণ বাড়াতে ‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট’ নামের প্রকল্পটি রবিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের কথা রয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ১০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। বাকী ৪ হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা আসবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে।
পরিকল্পনা কমিশনের একনেক অনুবিভাগের প্রধান ড. নূরুন নাহার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই প্রকল্পটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, বিশেষ করে আমদানি-রপ্তানি অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাইলফলক প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির সক্ষমতা বিশ্বমানের হবে।”
রবিবার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে একনেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে এই মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্প গ্রহণের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে ওই কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টিইইউ (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার) কন্টেইনার ওঠানো-নামানো করতে পারে। নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমে ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ব্রেক ওয়াটার তৈরি, একাধিক কন্টেইনার ও মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ, কর্ণফূলী নদীর নাব্যতা বাড়াতে চ্যানেলে বড় জাহাজ ভেড়ানোর অবকাঠমো তৈরি করা হবে। এতে খুব সহজেই বড় আকারের জাহাজ সরাসরি বন্দরে এসে ভিড়তে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে বড় জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে রেখে ছোট ভেসেল দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কাজ পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের প্রধান এই বন্দর দিয়ে অতিরিক্ত ৫০ লাখ টিইইউ কন্টেইনার ওঠানো-নামানো যাবে। সেই হিসাবে বছরে ৮০ লাখ টিইইউ কন্টেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা অর্জন করবে চট্টগ্রাম বন্দর।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি আমদানি-রপ্তানি এই বন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। তবে সময়ের সাথে সাথে বন্দরের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভরশীলতা, বড় আকারের জাহাজ ভিড়তে না পারা এবং কন্টেইনার জট বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পটির মাধ্যমে বন্দরে যেসব উন্নয়ন হবে
এই প্রকল্পটির মাধ্যমে দুটি আলাদা কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১ দশমিক ২২ কিলোমিটার। এরফলে কন্টেইনার ধারণে সক্ষমতা বাড়বে প্রায় ৫০ লাখ টিইইউ।
যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি:
বে টার্মিনালকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য উন্নত সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা হবে। এতে পণ্য পরিবহন আরও দ্রুত ও সহজ হবে।
যেভাবে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হবে
ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ: প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ঢেউরোধী প্রাচীর নির্মাণ করা হবে। যা বন্দরের পোতাশ্রয়কে ঢেউ ও স্রোতের হাত থেকে রক্ষা করবে।
কর্ণফূলী নদীর নাব্য চ্যানেল খনন: বড় জাহাজ চলাচলের জন্য বন্দরের প্রবেশপথ এবং ভেতরের চ্যানেল খনন করা হবে, যার গভীরতা প্রায় ১২ থেকে ১৪ মিটার হবে।
মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ:
প্রকল্পের অধীন একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার। এখানে সাধারণ কার্গো ও অন্যান্য পণ্য ওঠানো-নামানো যাবে।
যোগাযোগ অবকাঠামো:
টার্মিনালের সাথে সড়ক ও রেল পথের সংযোগ স্থাপন করা হবে। যাতে খুব সহজেই দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহন করা যায়।
নেভিগেশন এইডস স্থাপন:
জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্য আধুনিক নেভিগেশনাল সরঞ্জাম স্থাপন করা হবে।
সক্ষমতা বৃদ্ধি হবে কয়েকগুণ:
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভরশীল। কর্ণফূলী নদীর নাব্যতা কম হওয়ায় এখন গভীর সমুদ্র থেকে বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) থেকে ছোট জাহাজ নিয়ে বন্দরের জেটিতে এনে পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণ করা হয়।
বে টার্মিনাল চালু হলে বড় ধরনের জাহাজ সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারবে। ফলে বন্দরের কন্টেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা প্রায় ছয়গুণ বাড়বে। বর্তমানে যেখানে বছরে প্রায় ৩২ লাখ টিইইউ কন্টেইনার ওঠানো-নামানো যায়। বে টার্মিনাল চালু হলে বছরে অতিরিক্ত ৫০ লাখ টিইইউ কন্টেইনার হ্যান্ডেল করা সম্ভব হবে।
২৪ ঘণ্টা চলবে পণ্য খালাস ও জাহাজীকরণ:
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানির কাজ জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল। জোয়ারের সময় বহির্নোঙর করা জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে করে পণ্য বন্দরের জেটিতে এনে পণ্য খালাস করতে হয়। একইভাবে জেটি থেকে রপ্তানি পণ্য ছোট জাহাজে করে নিয়ে বহির্নোঙর করা জাহাজে পাঠাতে হয়।
আবার কর্ণফূলী নদীর নাব্যতা কম থাকায় ভাটার সময় জাহাজগুলোকে দীর্ঘ সময় বহির্নোঙরে অপেক্ষা করতে হয়। এতে বিশেষ করে রপ্তানির লিড টাইম বেড়ে যায়। যা বাংলাদেশের রাপ্তানি বাণিজ্যের একটি নেতিবাচক দিক।
বে টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কর্ণফূলী নদীর নাব্যতা আরও গভীর করা হবে। এতে সব ধরনের জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারবে। পাশাপাশি রপ্তানির লিড টাইমও কমে আসবে। রপ্তানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভরশীলতা না থাকায় ২৪ ঘণ্টাই জাহাজ চলাচল এবং পণ্য খালাস করা যাবে।
দ্রুত জাহাজ খালাস:
বড় আকারের জাহাজ সরাসরি ভিড়তে পারায় এবং সার্বক্ষণিক কার্যক্রমের সুযোগ থাকায় জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। বর্তমানে একটি জাহাজকে পণ্য খালাসের জন্য গড়ে তিন দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এর ফলে শিপিং খরচও কমবে।
আধুনিকীকরণ:
বে টার্মিনালে অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। যা বন্দরের কর্মদক্ষতা এবং নিরাপত্তা বাড়াতে সাহায্য করবে।
স্থান সংকুলান:
চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান টার্মিনালগুলোতে স্থান সঙ্কট রয়েছে। বে টার্মিনাল নির্মিত হলে বন্দরের উপর চাপ কমবে এবং পণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত স্থান পাওয়া যাবে।
নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি:
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বন্দরের পরিচালনা এবং আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানিতে লাভ
পরিবহন খরচ হ্রাস: বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জাহাজ খালাসের সময় কমার কারণে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
সময় সাশ্রয়:
পণ্য পরিবহনে কম সময় লাগায় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা দ্রুত তাদের পণ্য আনা নেওয়া করতে পারবেন। যা সাপ্লাই চেইনকে আরও কার্যকর করবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি:
উন্নত বন্দর সুবিধা এবং কম পরিবহন খরচ বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।
বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ:
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বন্দর সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি:
আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য গতিশীল হওয়ার কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বৃহত্তর বাজারের সুযোগ:
বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশ বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সহজে যুক্ত হতে পারবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যোগান দেবে বলে জানা গেছে। কন্টেইনার ও মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাও রয়েছে।
বে টার্মিনাল প্রকল্প চট্টগ্রাম বন্দর এবং বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে গেম-চেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।