যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জেতার আগে থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধে তার পরিকল্পনার কথা বলে আসছিলেন। ক্ষমতায় বসার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ওই যুদ্ধ অবসানের প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছিলেন।
কিন্তু নির্বাচনে জেতার পরেও এখনও ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কোনো কার্যকর পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়নি। উল্টো ট্রাম্পের উপদেষ্টারা প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানের প্রস্তাব দিচ্ছেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, ইউক্রেনের বড় অংশ দীর্ঘমেয়াদে রাশিয়ার অধীনে চলে যাবে।
রয়টার্সের বিশ্লেষণ ও ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সাক্ষাৎকারে এ তথ্য উঠে এসেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন রাশিয়া-ইউক্রেন বিষয়ক নতুন দূত, অবসরপ্রাপ্ত সেনা লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিথ কেলগ। তাদের প্রস্তাবগুলোর একটি সাধারণ দিক হলো, ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো সদস্যপদ বাদ দেওয়া।
ট্রাম্পের উপদেষ্টারা মস্কো ও কিয়েভকে আলোচনার টেবিলে আনতে চাপ প্রয়োগের পরিকল্পনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রণোদনা ও শাস্তির ব্যবস্থাপনা।
তারা কিয়েভকে সামরিক সহায়তা বন্ধের হুমকি দিতে পারেন, যদি আলোচনা করতে রাজি না হয়। একই সঙ্গে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আলোচনা প্রত্যাখ্যান করলে কিয়েভের জন্য সাহায্য বাড়ানোর প্রস্তাবও রয়েছে।
বিশ্লেষক ও সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি নিয়ে গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এই সংঘাতের জটিলতার কারণে তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।
তবে, উপদেষ্টাদের বক্তব্য একত্রে বিশ্লেষণ করলে ট্রাম্পের সম্ভাব্য শান্তি পরিকল্পনার রূপরেখা বোঝা যায়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জনবল সংকট ও ক্রমবর্ধমান ভূখণ্ড হারানোর মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি আলোচনার জন্য প্রস্তুত।
জেলেনস্কি এখনও ন্যাটো সদস্যপদের প্রতি আগ্রহী। তবে, এই সপ্তাহে তিনি বলেছেন যে, দখলকৃত কিছু ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে ইউক্রেনকে কূটনৈতিক সমাধান খুঁজতে হবে।
তবে, বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কর্মকর্তাদের মতে, ট্রাম্প পুতিনকে আলোচনায় আগ্রহী করতে ব্যর্থ হতে পারেন। পুতিন বর্তমানে ইউক্রেনকে দুর্বল অবস্থায় রেখেছেন এবং আরও ভূমি দখলের মাধ্যমে বড় সুবিধা অর্জনের সুযোগ খুঁজছেন।
রাশিয়াবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শীর্ষ গোয়েন্দা বিশ্লেষক এবং বর্তমানে কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস থিঙ্ক ট্যাংকে কর্মরত ইউজিন রুমারের মতে, “যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে পুতিনের কোনো তাড়াহুড়ো নেই।”
তার মতে, পুতিন শান্তি চুক্তি ও আলোচনার জন্য তার শর্তাগুলো ছাড়বেন না। এর মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ থেকে সরে আসা এবং চারটি প্রদেশ রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া। এই দাবি কিয়েভ প্রত্যাখ্যান করেছে।
রুমার বলেন, পুতিন সম্ভবত সময় নেবেন, আরও ভূমি দখল করবেন এবং অপেক্ষা করবেন যে ট্রাম্প তাকে আলোচনায় আনার জন্য কোনো ছাড় দেন কি না।
রয়টার্সের গত মে মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিন যুদ্ধ থামাতে প্রস্তুত ছিলেন একটি আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি স্বীকার করে বর্তমান সম্মুখরেখা (ফ্রন্ট লাইন) মেনে নেওয়ার শর্তে। তবে কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলি প্রতিক্রিয়া না জানানোয়, তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান।
রাশিয়া এরই মধ্যে ক্রিমিয়ার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়া দনেৎস্ক ও লুহানস্ক নিয়ে গঠিত ডনবাসেরও ৮০ শতাংশ রাশিয়ার দখলে। এর বাইরে রুশ সেনাবাহিনী জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের ৭০ শতাংশের বেশি এবং মাইকোলাইভ ও খারকিভ অঞ্চলের কিছু অংশও দখল করেছে।
ট্রাম্পের চার উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহ পর্যন্ত, ট্রাম্প একটি কেন্দ্রীয় কার্যকরী দল গঠন করেননি যাতে শান্তি পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে কাজ করা যেতে পারে। বরং কয়েকজন উপদেষ্টা প্রকাশ্যে আলোচনা এবং কিছু ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কাছে শান্তির প্রস্তাব রেখেছেন।
উপদেষ্টাদের মতে, শান্তি চুক্তি সম্ভবত ট্রাম্প, পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে সরাসরি ব্যক্তিগত আলোচনা উপর নির্ভর করবে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, “পুরো পরিকল্পনার ধারণা না থাকলে একক বিবৃতির ওপর মন্তব্য করা সম্ভব নয়।”
ট্রাম্পের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট বলেছেন, ট্রাম্প জানিয়েছেন যে, তিনি শান্তি পুনঃস্থাপন এবং বিশ্ব মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনর্নির্মাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
ট্রাম্প কি দায়িত্ব গ্রহণের পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সংঘাত নিরসনের পরিকল্পনায় অটুট আছেন কিনা, এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল ট্রাম্পের এক প্রতিনিধিকে। কিন্তু তিনি ওই প্রশ্নের উত্তর দেননি।
ট্রাম্পের একজন সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, তিনটি প্রধান প্রস্তাব রয়েছে: কেলগের রূপরেখা, ভাইস প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত জেডি ভ্যান্সের একটি প্রস্তাব ও ট্রাম্পের সাবেক ভারপ্রাপ্ত গোয়েন্দা প্রধান রিচার্ড গ্রেনেলের আরেকটি প্রস্তাব।
কেলগের পরিকল্পনাটি সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল কর্মকর্তা ফ্রেড ফ্লেইটজের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা হয়েছে।
এই পরিকল্পনা অনুসারে, ট্রাম্প কিয়েভকে শান্তি আলোচনা শুরু করতে সম্মত হলে তবেই আরও অস্ত্র সরবরাহ করবেন। একই সময়ে, তিনি মস্কোকে সতর্ক করবেন যে, যদি রাশিয়া আলোচনায় অস্বীকার করে, তবে তিনি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বাড়িয়ে দেবেন। ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ স্থগিত রাখা হবে। প্রস্তাবে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেবে যুক্তরাষ্ট্র, এমনটাও বলা আছে।
ব্রিটিশ ডিজিটাল স্টেশনে টাইমস রেডিওতে গত জুনে সাক্ষাৎকার দেন ট্রাম্পের আসন্ন উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সেবাস্টিয়ান গর্কা। সেখানে তিনি বলেন, ট্রাম্প তাকে জানিয়েছেন যে, পুতিন যদি আলোচনায় না আসে, তবে তিনি ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের হুমকি দিয়ে পুতিনকে আলোচনায় বাধ্য করবেন।
ওদিকে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স সম্প্রতি ইউএস পডকাস্টার শন রায়ানকে বলেন, একটি চুক্তিতে সম্ভবত বর্তমান সম্মুখরেখায় একটি অস্থায়ী সামরিক এলাকা থাকবে, যাতে রাশিয়া আর আগ্রাসন চালাতে না পারে। তার প্রস্তাব অনুযায়ী, কিয়েভের ন্যাটো সদস্যপদ নাকচ করা হবে।
ট্রাম্পের আরেক কর্মকর্তা কূটনীতিক রিচার্ড গ্রেনেল গত জুলাইয়ে ব্লুমবার্গের একটি রাউন্ডটেবিল বৈঠকে ইউক্রেন প্রসঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তিনি ইউক্রেনে ‘স্বশাসিত অঞ্চল’ তৈরির পক্ষে মত দেন, তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি। তিনি আরও জানান, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের মধ্যে পড়ে না।