গত অর্থবছর (২০২৩-২৪) শেষ হয়েছে ৩০ জুন। ১ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর (২০২৪-২৫)। এই অর্থবছরের ১০ দিন চলে গেছে। তবে বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনের পণ্য রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেনি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।
রপ্তানির হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে ইপিবি। এখন কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করা হবে—সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সংস্থাটি। সে কারণেই জুন মাসের তথ্য প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইপিবির কর্মকর্তারা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইপিবি প্রতি মাসের রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত চলমান মাসের ১ থেকে ৩ তারিখের মধ্যে আগের মাসের রপ্তানি তথ্য প্রকাশ করে সংস্থাটি। কোনও কোনও মাসে ১ তারিখেও আগের মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে ইপিবি।
কিন্তু জুলাই মাসের ১০ দিন পার হয়ে গেলেও জুন মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। কবে প্রকাশ করা হবে—তাও নিশ্চিত করতে পারছে না সংস্থাটির কোনও কর্মকর্তা।
এবার রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছে কেন—এ বিষয়ে জানতে বুধবার সন্ধ্যায় ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনকে কয়েক বার ফোন দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে এসএমএস করা হলেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইপিবির এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রপ্তানি তথ্যের গরমিল ধরা পড়ায় ইপিবি তথ্য বাছাই করা হচ্ছে। এজন্য এ মাসে একটু দেরি হচ্ছে।
“রপ্তানি তথ্যে অসংগতির যে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে, তা সবই ঠিক আছে। আমাদের দেশ থেকে দুইভাবে পণ্য রপ্তানি হয়। এর একটি হচ্ছে ব্যাংক টু ব্যাংক এলসি (ঋণপত্র)। প্রথমে কাপড় ও সুতা আমদানি করা হয়, তারপর রপ্তানি করা হয়। এখানে মোট মূল্য এক্সপোর্ট হিসেবে ধরা হয়। আবার আরেকটি হচ্ছে, কাপড় ও সুতা বিনামূল্যে ক্রেতারা (বায়ার) পাঠিয়ে দেয়। ওই পণ্য যখন রপ্তানি হয়, তখন ক্রেতারা আমাদের শুধু সিএমটি (কাটিং, মেকিং অ্যান্ড ট্রিমিং) পেমেন্ট করে।”
“আমরা (ইপিবি) এতদিন পুরো রপ্তানি মূল্য দেখিয়েছি। আর এনবিআর বায়াররা যে কাপড় ও সুতা পাঠান, তা বাদ দিয়ে রপ্তানির হিসাব করে। সে কারণেই ইপিবি ও এনবিআরের হিসাবে বড় গড়মিল হয়েছে।”
তিনি বলেন, “গত সোমবার (৮ জুলাই) ইপিবিতে এ বিষয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, পরিসংখ্যান ব্যুরো, এনবিআর, ইপিবি, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন ও বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের (বিএফটিআই) কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সবাই এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। ভবিষ্যতে এমন অসংগতি এড়াতে সবাই একটি মানদণ্ড ঠিক করে কাজ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন।”
সেই মানদণ্ড অনুযায়ী কয়েক দিনের মধ্যেই জুন মাসের রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করা হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে গত ৩ জুলাই বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (বিওপি) তথ্য নতুনভাবে হিসাবায়নের পর প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এতে ওলটপালট হয়ে গেছে হিসাব।
চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবে হঠাৎ বড় পরিবর্তন এসেছে; উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে। আগের মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবে ছিল উদ্বৃত্ত এবং ঘাটতিতে ছিল আর্থিক হিসাব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লেনদেনের ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বা বিওপি) হালানাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছি ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।
গেল অর্থবছরের নয় মাস অর্থাৎ জুলাই-মার্চ মাস পর্যন্ত এ চিত্র ছিল উল্টো। ওই নয় মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৯ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ১০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এতে দেখা যাচ্ছে, আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি কমেছে ৪৩ দশমিক ৮১ শতাংশ।
অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। এক্ষেত্রে আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত কমেছে ৩৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রকৃত রপ্তানি কত হচ্ছে, সেই তথ্য ব্যবহার করে আর্থিক হিসাব গণনা শুরু হয়েছে। এনবিআর আর ইপিবি একই রকম রপ্তানি তথ্য ব্যবহার করবে। ফলে রপ্তানি তথ্য নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছিল, তা কেটে যাবে।”
এই বিভ্রান্তি দূর করতে বেশ কিছুদিন ধরে আইএমএফ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছিল।
ইপিবির হিসাবে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি (৪৭.৪৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য। অন্যদিকে এনবিআর হিসাব কষে বলেছে, ওই সময়ে দেশ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
এনবিআরের এই হিসাবকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তিন সংস্থা মিলে গত দুই বছরের রপ্তানি হিসাব চূড়ান্ত করেছে। এতেও এনবিআরের হিসাবকে চূড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিটিএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, এটাই প্রকৃত তথ্য। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি দেখিয়ে আসছিল ইপিবি। দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়টি আমরা বলে আসছিলাম।
“বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবই যৌক্তিক। সঠিক হিসাব না দেওয়ায় এত দিন নীতিনির্ধারকদের কাছে ভুল বার্তা গেছে। এতে করে পুরো খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
নতুন হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থ আসার পার্থক্যও কমে এসেছে। এই সময়ে এ ক্ষেত্রে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৬৮ কোটি ডলার। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাবাসিত অর্থে ২৪৩ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
ফলে বড় ঘাটতিতে থাকা আর্থিক হিসাবে জুলাই-এপ্রিল সময়ে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।