ঈদ শেষ। এখন চলছে কোরবানির চামড়া কেনাবেচা। এবার দাম একটু বেশি। প্রতিটি গরুর চামড়া ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গতবার ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। তবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে সুখবর নেই। এই খাত থেকে রপ্তানি আয় কমছেই। দিন যতো যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততোই খারাপ হচ্ছে। এবার এই খাত থেকে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বিদেশি মুদ্রা আসবে কি না—তা নিয়ে সংশ্রয় দেখা দিয়েছে।
হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরিত হয়েছে ট্যানারিগুলো; সেখানে গড়ে উঠেছে চামড়াশিল্প নগরী। কিন্তু তার কোনও সুফল আসেনি এ খাতে।
বিভিন্ন দেশ থেকে মাঝে যে অর্ডারগুলো আসে, সেই সুযোগ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিফলে গেছে। আর চামড়াশিল্প নগরী পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত না হওয়ায়, কারখানার মানসনদ না মেলাসহ বিভিন্ন কারণে এখনও নতুন বাজারও সৃষ্টি করা যায়নি।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। এর বাইরে যে দু-তিনটি খাত থেকে ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি আয় দেশে আসে, তার মধ্যে চামড়া খাত একটি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ৯৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ১৭ শতাংশ কম। ১৩৫ কোটি (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে এই খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছিল ১১২ কোটি (১.১২ বিলিয়ন) ডলার। পুরো অর্থবছরে (জুলাই-জুন) এসেছিল ১২২ কোটি ৩৬ লাখ (১.২২ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে কম ছিল ১৫ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
বিদায় নিতে যাওয়া অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে কাঁচাচামড়া রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১২ কোটি ৫৭ লাখ ডলার, যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি।
চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ৩৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৮১ শতাংশ কম।
আর লেদার ফুটওয়্যার বা চামড়ার জুতো রপ্তানি করে জুলাই-মে সময়ে ৪৭ কোটি ৭২ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ কম।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২১-২২ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১২৪ কোটি ৫২ লাখ (১.২৪ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় এসেছিল প্রায় ২১ শতাংশ বেশি।
ইপিবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
এরপর থেকে এ খাতের রপ্তানি কমতে থাকে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে ১০২ কোটি ডলারে নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা নামে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে তা ফের বাড়তে থাকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ফের ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে এক লাফে ১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
তখন সরকার, ট্যানারি মালিক ও রপ্তানিকারকরা আশা করেছিলেন চামড়া শিল্প খাতে সুদিন ফিরবে। কিন্তু ইপিবির গত দুই অর্থবছরের (২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪) তথ্য বলছে, সেই আশা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধের ধাক্কায় ফের হোঁচট
বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রধান বাজার হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয় চামড়াজাত বিভিন্ন পণ্য। কোভিড মহামারীর কারণে প্রায় দুই বছর স্থবিরতা চলার পর আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে এই দেশগুলো। ছোট-বড় সব ধরনের শপিং মল খুলে যায়। মানুষজনও পুরোদমে কেনাকাটা করতে থাকে। অর্থনীতিতে আবার গতি ফিরে আসে। অন্যান্য পণ্যের মতো চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদাও বাড়তে থাকে। সে কারণে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিও বাড়ছিল।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে জুতার মোট বাজারের ৫৫ শতাংশ চীনের দখলে। ভারত ও ভিয়েতনামেরও ভালো অবস্থান আছে। বিশ্বে জুতার বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮তম। বিশ্বে এ খাতে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
কোভিডের পর তৈরি পোশাকের মতো চামড়া খাতের রপ্তানিতেও নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। প্রধান রপ্তানিকারক দেশ চীনের কিছু অর্ডার বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিল। ভিয়েতনাম থেকেও অর্ডার আসছিল।
কিন্তু আড়াই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সেসব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তারা অন্যান্য পণ্যের মতো চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাসহ অন্য পণ্যও কেনা কমিয়ে দিয়েছে। সে কারণেই এ খাতের রপ্তানি এখন কমছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
প্রতি বছর চামড়া খাত থেকে যে বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে, তার প্রায় ১৫ শতাংশ রপ্তানি করে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। প্রতিষ্ঠানটি জার্মানি, ইতালিসহ ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে জুতা রপ্তানি করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতেও জুতা রপ্তানি শুরু করেছে অ্যাপেক্স।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোভিডের মধ্যেও চামড়া রপ্তানিতে সুদিন ফিরে এসেছিল। চীন থেকে অনেক অর্ডার বাংলাদেশে আসছিল। সবকিছু মিলিয়ে চামড়া খাতে আমরা আশার আলো দেখছিলাম।
“কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সব তছনছ করে দিয়েছে। আমাদের চামড়া খাতের প্রধান বাজার হচ্ছে ইউরোপ। যুদ্ধের প্রভাব ইউরোপের দেশগুলোতেই বেশি পড়েছে। এসব দেশের মানুষকে এখন খাদ্যের পেছনেই অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সে কারণে তারা জুতাসহ অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। সে কারণেই রপ্তানি কমছে।”
এই ব্যবসায়ী নেতা জানান, সাভার চামড়াশিল্প নগরীর পরিবেশ নিয়ে মোটেই খুশি নন ক্রেতারা। ওখানকার চামড়া দিয়ে কোনও পণ্য উৎপাদন করলে ক্রেতারা কেনেন না। তাই বাধ্য হয়ে শিল্পনগরীর বাইরে তৃতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাঁচামাল কিনে পণ্য উৎপন্ন করে থাকেন রপ্তানিকারকরা। কোভিডের পর চামড়া রপ্তানিতে নতুন করে যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটা ধরে রাখতে সাভার শিল্পনগরীর পরিবেশ উন্নয়নে সরকার ও ট্যানারি শিল্পমালিকদের জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান এই শিল্পোদ্যোক্তা।
সম্ভাবনা হাতছাড়া হচ্ছে যে কারণে
চামড়া খাতকে একসময় সম্ভাবনাময় মনে করা হলেও এটি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় শীর্ষ এই রপ্তানি খাত চতুর্থ-পঞ্চম স্থানে নেমে গিয়েছিল। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছিল। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প নগরী সাভারে স্থানান্তর নিয়ে দীর্ঘ জটিলতার কারণেই এ শিল্পের এই হাল বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে চামড়াশিল্প নগরী সাভারে স্থানান্তরে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষের কথা ছিল। তবে দেড় যুগ শেষ হতে চললেও এই শিল্পনগরী এখনও পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠেনি।
প্রকল্প শেষ না হলেও ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত হাজারীবাগের চামড়া কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়। ফলে সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে বেশ কিছু চামড়া কারখানার বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ ছিল। এ সনদের সুবাদে তারা জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়া রপ্তানি করতে পারত। হাজারীবাগে কারখানা বন্ধ হওয়ায় সেই সনদ ও বায়ার (বিদেশি ক্রেতা) হারায় চামড়াশিল্প কারখানাগুলো।
এত দীর্ঘ সময়েও সাভারের চামড়াশিল্প নগরী পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত না হওয়ায় এখনও এলডব্লিউজির সনদ ফিরে পায়নি কারখানাগুলো। একইসঙ্গে নতুন বাজার সৃষ্টি হয়নি। সনদ না থাকায় জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় এলডব্লিউজির আওতায় চামড়া রপ্তানি করতে পারছে না কারখানাগুলো। আর এ বিধিনিষেধের কারণে এসব কারখানা থেকে কাঁচামাল নিয়ে পণ্য উৎপন্ন করে সে পণ্য রপ্তানিও করতে পারছে না রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিটিএ চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বলেন, “যে সুযোগটি এসেছিল, সেটা আসলে হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন চামড়াশিল্পের ঘুরে দাঁড়ানো খুবই কঠিন। তাই সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ, সাভার চামড়াশিল্প নগরীকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে যা কিছু প্রয়োজন তাই যেন করা হয়, এবং তা যেন দ্রুততর সময়ের মধ্যে করা হয়।”