Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

মেসি নয়, যেখানে সবাই ইয়ামাল হতে চায়

লামিন ইয়ামালের বিখ্যাত উদযাপন। ছবি: সংগৃহীত।
লামিন ইয়ামালের বিখ্যাত উদযাপন। ছবি: সংগৃহীত।
[publishpress_authors_box]

“তুমি এখানে কেন?”

রোকাফোন্দার রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিক যখন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাকে এভাবেই প্রশ্নটা করে ওঠে শিশুটি।

ও হ্যাঁ, রোকাফোন্দা জায়গাটা কোথায় সেটা তো আগে বলে নিই। স্পেনের মাতারোয়ের উপকূলীয় শহরের একটা নিরিবিলি পাড়া বলতে পারেন এটাকে। সেখানেই চলছিল এই কথোপকথন।

শিশুটির প্রশ্নের উত্তরে সাংবাদিকের একজনের পাল্টা প্রশ্ন, “তুমি কি ভাবছো?” এতটুকু না ভেবে শিশুটি মায়ের সঙ্গে হেটে যাওয়ার আগে হাসিমুখে উত্তর দিল, “লামিনের জন্য এসেছো।”

রোকাফোন্দার রাস্তায় সব তরুণেরাই এখন বিখ্যাত ইয়ামালের উদযাপনে ব্যস্ত। ছবি: সংগৃহীত।

শিশুটি আবার একটু আগেই বিশেষ উপহার হিসেবে বার্সেলোনার একটা জার্সি পেয়েছে। উপহারটা তাকে দিয়েছে লামিন ইয়ামালের দাদি। যিনি এই এলাকাতেই থাকেন।

রোকাফোনদা স্পেনের এক কোণায় গড়ে ওঠা অবহেলিত এক পাড়া। যে লোকালয় চোখের সামনেই দেখেছে তরুণ এই ফুটবলারের বেড়ে ওঠা। শনিবার যে ছেলেটি পা দিয়েছে ১৭ বছরে।

কিন্তু বার্সেলোনার লা মাসিয়া ট্রেনিং কমপ্লেক্সের এই তারকা ফুটবলার, বর্তমানে স্পেন জাতীয় দলেরও সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ফুটবলার, যিনি পাড়াটাকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। কি অসাধারণ ভাবেই না কাজটি করেছেন তিনি!

গোল করার পর দুই হাতের আঙুলের ইশারায় ‘৩০৪’ দেখিয়ে উদযাপন করেছেন ইয়ামাল। এটা হচ্ছে রোকাফোন্দার পোস্টাল কোডের শেষ ৩ ডিজিট (০৮৩০৪)।

গোল করার পর দুই হাতের আঙুলের ইশারায় ‘৩০৪’ দেখিয়ে উদযাপন করেছেন ইয়ামাল। ছবি: সংগৃহীত।

সংখ্যাটা এখন রোকাফোন্দার দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা। শিশুরা হাসি মুখে ৩০৪ নিয়ে কথা বলছে সব জায়গায়। আগে যখন এই পাড়ার পরিস্থিতি নিয়ে পুরনো বাসিন্দাদের কিছু বলতে হতো, ভ্রু কুঁচকে যেত। চোখে থাকতো ভয়, শঙ্কা, লজ্জা। কিন্তু এখন সেই চোখেই গর্বের ছোয়া। তারা যে রোকাফোন্দার বাসিন্দা তা যেন গর্বের সঙ্গে বলতে চায়। এবং ইয়ামাল যেন তাদের কাছে ভবিষ্যতের আশার বাতিঘর।

ইউরোর সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে যখন ২৫ গজ দূর থেকে চোখ ধাঁধানো গুরুত্বপূর্ণ গোলটি করলেন ইয়ামাল, গর্জে উঠেছিল রোকাফোন্দার রাস্তা। সেদিন শুধু একটা গোলই করেননি ইয়ামাল, ইতিহাসেও যে নাম লিখিয়ে গড়েছেন বিরল কীর্তি। বিশ্বকাপ ও ইউরো মিলিয়ে সবচেয়ে কম বয়সে গোলের এমন কীর্তি আর কারও যে নেই!

যে রাস্তায়, গলিতে এত উল্লাস, সেখানেই শৈশবে ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতেন লামিন ইয়ামাল। আর সেখানে দাঁড়িয়েই হোসে পালাসিয়োস বলছিলেন, “ সে তরুণদের জন্য আদর্শ। অনেকে এখন তার মতো হতে চায়। এই যে ৩০৪ সংখ্যা, এটা আমাদের এখানকার প্রতীক। এটা দিয়ে আমাদের সবাইকে বোঝায়। সত্যিটা হলো, এটা দিয়ে সারা বিশ্বে সে আমাদের চিনিয়েছে।”

মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে লামিন ইয়ামাল। ছবি: সংগৃহীত।

হোয়ান ২৩ স্কয়ারে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন পালাসিয়োস। সেখানকার একটি ভবনের নিচতলায় থাকেন লামিনের বাবা, দাদি ও চাচা। সবাই বর্তমানে মরক্কোতে ছুটি কাটাচ্ছেন।

মাতারোর এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন আয়ের মানুষের বাস। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীদের জন্ম কাতালুনিয়া অঞ্চল এবং স্পেনের বাইরে। মূলত মরক্কোয়। ইয়ামালের জন্ম অবশ্য স্পেনে, কিন্তু তার বাবা মরোক্কান এবং মা ইকুয়েটেরিয়াল গিনির। ৬ বছর বয়সে ইয়ামাল নাম লেখান বার্সেলোনার একাডেমিতে। ১১ বছর বয়সে রোকাফোন্দা ছেড়ে চলে যান বার্সেলোনায়।

গত ১৬ বছর ধরে এখানকার মিশ্র জাতিসত্বার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসা মুস্তাফা এলহামিদ বলছিলেন, “লামিন ইয়ামাল শুধু আমাদের পাড়ার নয়, পুরো স্পেনের গর্ব।”

ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও এমন উদযাপন করতে চান ইয়ামাল। ছবি: সংগৃহীত।

আগে হোয়ান স্কয়ার ছিল খোলা মাঠ। এখন যেটা খেলার মাঠ, যেখানে এক সময় ফুটবল খেলা ছিল নিষিদ্ধ! মাঠের পাশের বেঞ্চে বসা এক ভদ্রমহিলা বলছিলেন, “এটা অন্য সব পাড়াগুলোর মতোই।” আরবিতে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। আর সেটা অনুবাদ করে দিচ্ছিল তার সঙ্গী।

 “ এখানে আছে নানা সংস্কৃতি । তবু এটা খুবই শান্ত একটা এলাকা। অনেকে এই এলাকার নামে নানা বাজে কথা ছড়াবে। কিন্তু যখন কেউ এখানে থাকবে, অবশ্যই ভালো লাগবে। এই জায়গা থেকে ওর মতো বড়ো ফুটবলার বেরিয়ে এসেছে, এটা তো আমাদের সবার জন্য গর্বের বিষয়। এই রাস্তায় ফুটবল খেলতে খেলতেই সে বিশ্বের সেরা জায়গায় খেলছে।”- পালাসিয়োস যোগ করেন। 

১৯৬০ সালে যে সব অভিবাসী দক্ষিণ স্পেন থেকে আসে তাদের নিয়ে গড়া হয়েছে এই রোকাফোন্দা এলাকা। এরপর ১৯৯০ সালে বিদেশিরা এসে ভরে যায় এখানে, যাদের বেশিরভাগই আফ্রিকান। এরা কেউ ফলের দোকানদার, কেউ মুদি দোকানী, কেউ নাপিত। অনেকে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে বিক্রি করে  পিএসজি, মরক্কো, বার্সা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি। কিন্তু এখন তাদের সবাই বিক্রি করছে স্পেনের জার্সি। যে জার্সিতে লেখা লামিন ইয়ামালের নাম। তাদের ব্যালকনিতে উড়ছে স্পেনের পতাকা। পতাকা টাঙানো আছে দোকানের সামনেও।

রোকাফোন্দার রাস্তায় এ যেন চেনা দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

এটা সত্যি রোকাফোন্দার বেশিরভাগ মানুষ বাস করছে দারিদ্রসীমার নিচে। ভবনগুলোতে নেই এলিভেটর। নোনা দেওয়াল দেখে মনে হয় এখনই ধ্বসে পড়বে। কিন্তু রোকাফোন্দা এর চেয়েও বেশি কিছু: এটা এমন একটা সম্প্রদায় যার প্রতিটা কোণে কোণে ফুটবল। লামিন ইয়ামালকে নিয়ে যখন উন্মাদনার শুরু হলো তখন থেকে আরও বেশি ছেলেরা রাস্তায় ফুটবল খেলছে, এমনটাই বলছিলেন আশ পাশের প্রতিবেশীরা।

হোয়ান স্কয়ারের ১০০ মিটার দূরেই একটা পাকা ফুটবল মাঠ, যেখানে ইয়ামাল প্রথম গোল দিয়েছিলেন। সেখানে এমন একজনকে খুঁজে পাওয় যায়নি যিনি ইয়ামালকে খেলতে দেখেননি। এবং সবাই তার নাম জানে। লামিন ইয়ামালময় এমন উন্মাদনা দেখে এই পাড়ারই একটা ফুটবল দলের কোচ সার্জিও মার্তিনেজ বলছিলেন, “লামিন ইয়ামাল নিয়ে এই উন্মাদনা খুবই ভালো। এখন ছেলেরা আরও বেশি অনুপ্রাণীত হচ্ছে। আরও বেশি উৎসাহিত হচ্ছে।  এর আগে তো ওরা খেলা ছেড়ে দিয়ে পার্কেই সময় কাটাতো।”

রোকাফোন্দার পানশালার দেওয়ালে ঝুলছে লামিন ইয়ামালের স্বাক্ষরিত জার্সি। ছবি: সংগৃহীত।

আলাপচারিতার ফাঁকে হাতে বল নিয়ে তার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করলো আরও অনেকে। এদেরই একজন ক্রিস্টিয়ান ব্লাসকো ইয়ামালের বাবার সঙ্গে সময় কাটান। তার মতে, “শিশুরা ওকে আদর্শ মানে। তরুণদের চোখে এখন ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন।”

এই তরুণদের একজন ১৫ বছরের মোহাম্মদ ইয়াসির। বার্সেলোনার জার্সি পরা ইয়াসির বলছিলেন, “লামিন ইয়ামাল ৩০৪ সংখ্যা দেখিয়ে উদযাপন করেছে, মানে সে তার প্রতিবেশীদের মূল্যায়ন করে। এখন সবাই তাকে নিয়ে ভালো কথা বলছে।”

ইয়ামালের পাড়ায় রয়েছে এল করদোবেস নামের পানশালা। খেলার আগে বা পরে সবাই এখানে এসে আড্ডা দেয়। ওই পানশালার দেওয়ালে ঝুলছে লামিন ইয়ামালের স্বাক্ষরিত জার্সি। যেন জার্সি না ইউরোর ট্রফিটাই ঝুলিয়ে রেখেছেন পানশালার মালিক হুয়ান কার্লোস সেরানো মুনোজ। এই পানশালাটি ইয়ামালের বাবা মুনিরের পরিবারের অর্থনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষীও। এই পানশালায় এলে ইয়ামালের বাবাকে বিনে পয়সায় কফি দেওয়া হতো, যাতে করে সেই পয়সা দিয়ে সে ছেলেকে ট্রেনে করে বার্সেলোনার একাডেমিতে অনুশীলনের জন্য নিয়ে যেতে পারে।

লিওনেল মেসির সঙ্গে লামিন ইয়ামালের ভাইরাল হওয়া সেই ছবি। ছবি: সংগৃহীত।

ইয়ামালের বাবাকে ফ্রি’তে কফি খাওয়ানো পানশালার মালিক মুনোজের এখন ভালোলাগার অন্ত নেই। বলছিলেন, “এই জার্সিটি আমাদের পাড়ার গর্ব! ওর বাবাকে আমি পয়সা দিতাম, যাতে সে তার ছেলেকে ট্রেনে করে বার্সেলোনা নিয়ে যেতে পারে।”

ইয়ামাল যেন পুরো পাড়াকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে। সেটাই বলছিলেন মুনোজ, “এটা এমন একটা পাড়া যেখানে অনেক রকমের জাতি সত্তার মানুষ আছে। আমরা এক সঙ্গে ভালোভাবে থাকি, যেভাবে সুখে দুঃখে মিলে মিশে পড়শিরা থাকে। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে আমরা এখন ভালো কিছুর জন্য খবরের শিরোনামে যা আসলেই আমাদের গর্বিত করেছে। এখন আমাদের এটা উপভোগ করার সময়। এখানে আমরা সবাই গর্বিত ও খুশি তাদের পরিবারের জন্য।”

লামিন ইয়ামাল হয়ে উঠেছেন রোকাফোন্দার উন্নতি, ভবিষ্যত আর আশার প্রতীক। ছবি: সংগৃহীত।

লামিন ইয়ামাল রোকাফোন্দাকে সবার কাছে চিনিয়েছে। শুধু তিনি এখানে থাকেন বলেই না, তিনি একজন ফুটবলারের চেয়েও যেন বেশি কিছু। তিনি হয়ে উঠেছেন রোকাফোন্দার উন্নতি, ভবিষ্যত আর আশার প্রতীক। এর আগে রোকাফোন্দার তরুণেরা মেসি হতে চাইতো। এখন কি হতে চায় জানেন?

লামিন ইয়ামাল!

* এল পায়ইস অবলম্বনে বদিউজ্জামান মিলন

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত